Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আস্থা সঙ্কটে এলাকাবাসী

যমুনার ভাঙন ঠেকাতে কাজ চলছে চৌহালীতে

প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : চলতি বছর এপ্রিলের মধ্যে ভাঙন প্রতিরোধ কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে আসন্ন বর্ষায় চৌহালী উপজেলার অন্তত আরও ২ কিলোমিটার চলে যাবে যমুনা গর্ভে। গেল বছর চৌহালীর পুরো ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন ছিল। ভাঙনকবলিত চৌহালীবাসীর কাছে যমুনা মানেই এক দুঃখের ইতিহাস, যা চলছে বছরের পর বছর। একসময় চীনাদের কাছে হোয়াংহু নদীর ইতিহাসও ছিল এমন করুণ।
যমুনার ভাঙনে চৌহালীর অন্তত ৫০ হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। সর্বশান্ত হওয়া এমনই এক পরিবারের প্রধান ইউনুস মোল্লা জানান, যমুনা তার বসতবাড়ী, আবাদি জমি সবই গ্রাস করেছে। গত বিশ বছরে তিন দফা নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এখন তার আর কিছুই নেই। বয়সের ভারে নতজানু এই মানুষটির দিন চলে অনাহারে-অর্ধাহারে। তবুও স্বপ্ন দেখেন, যমুনার করাল থাবা থেকে চৌহালী রক্ষার। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর কাজের উপর তার আস্থা নেই বললেই চলে। তার ভাষায়, ‘বাজান হেরা কী কাম করে বুঝি না, যমুনার ভাঙনতো ঠ্যাহে না। মাইনসে কয় নদীতে কয়ডা পাথর-বস্তা ফেলি সব টেহা (টাকা) নিয়া গেছে।’
চৌহালী উপজেলাটি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা সংলগ্ন সিরাজগজ্ঞ জেলার অর্ন্তভুক্ত। সিরাজগঞ্জের সবকটি উপজেলা যমুনার ওপারে হলেও একমাত্র উপজেলা চৌহালীর অবস্থান এপারে। বেশ কয়েকবার আলোচনাতেও এসেছিল-এই উপজেলাকে টাঙ্গাইলের মধ্যে দিয়ে দেয়ার। কিন্ত সিরাজগঞ্জবাসী সায় দেয়নি। চৌহালীবাসীকে এজন্য জেলার সব কার্যক্রম চালাতে হয় যমুনা নদী পারি দিয়ে সিরাজগঞ্জে যেয়ে। এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন একটা ভালো নয়। নদী ভাঙনকবলিত এই উপজেলার মূল অর্থের উৎসই হচ্ছে-কৃষি। একটি ক্ষুদ্র অংশ জীবিকানির্বাহ করছে যমুনা থেকে মাছ ধরে।
চৌহালী উপজেলাকে রক্ষায় পাউবো ১৯৯৮ সাল থেকেই নদী ভাঙন রক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে চৌহালী উপজেলা রক্ষায়। কিন্তু রক্ষা করা যায়নি এই উপজেলা ভবন, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, হাটবাজার, ব্রিজ, কালভার্ট, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্টার অফিস, থানা কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ভবন, আবাদিজমি, বসতবাড়ি। শুধু গত বছরই যমুনার ভাঙনে দেড় কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এলাকাবাসী আতঙ্কে রয়েছে, আগামী এপ্রিলের মধ্যে এখানকার চলমান নদীভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারলে আসন্ন বর্ষায় আরও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
যমুনার কবল থেকে চৌহালীকে রক্ষায় প্রতিবছরই টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কাজও চলে। কিন্তু ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পায় না সিরাজগঞ্জ থানার চৌহালী উপজেলা। এখানকার কাজ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগেরও শেষ নেই। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবো থেকে থেকে এই এলাকার কাজ নিয়ে উঠা অভিযোগ ক্ষতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটিও হয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগের কারণে কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বরং তদন্ত কমিটির রিপোর্টে যাই থাক না কেন-দুর্নীতির অভিযোগের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা ঠিকই পদোন্নতি নিয়ে ভালো জায়গায় কাজ করছেন দাপটের সাথে। অন্যদিকে, দুর্বল কাজের কারণে চৌহালী উপজেলার অর্ধেক বিলীন হয়ে গেছে যমুনা গর্ভে।
চলতি বছর এডিবি’র অর্থায়নে ভাঙনকবলিত চৌহালী উপজেলার বাকি অংশ রক্ষায় ৫ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদীভাঙন প্রতিরোধের কাজ চলছে। এই কাজের মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ যোগান দিচ্ছে এডিবি। বাকী ১২ শতাংশ যোগান দিচ্ছে পাউবো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জামিল ইকবাল লিমিটেড (আইজে-জেভি) এখানে কাজ করছে।
চলতি বছর এপ্রিলের মধ্যে এই কাজ শেষ করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী শাজাহান সিরাজ। তিনি বলেন, সেটেলাইটভিত্তিক টোটাল স্টেশন দিয়ে বার্জের অবস্থান ঠিক করে এখানে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। ডাম্পিংয়ের কাজ চলছে চারটি বার্জ দিয়ে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই কাজ শুরু করা হয় এবং শেষ হবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে। মোট ৯ লাখ ৭২ হাজার জিও ব্যাগের মধ্যে বাকী ৩ লাখ ৭২ হাজার জিও ব্যাগ মার্চের মধ্যেই ডাম্পিং করা হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্পের পিডি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আগামী বছর ব্লক পিসিংয়ের কাজ শুরু হবে। বর্তমানে ভাঙন প্রতিরোধে নদী তীরে জিও ব্যাগ বসানো হচ্ছে। আগামী শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়া মাত্রই এসব জিও ব্যাগ তুলে ব্লক পিসিং করা হবে। তিনি বলেন, ব্লক নির্মাণের কাজ চলছে।
কাজের অগ্রগতিতে দেখা যায়, উজানে আটারপাড়া থেকে ভাটিতে খাস কাউলিয়া পর্যন্ত জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। যমুনা নদীর বালিই এই জিও ব্যাগে ভরা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নদী থেকে বালু তুলে তা পরীক্ষা করা হয়। কমপক্ষে ১ এফএম-এর ২৫০ কেজি ওজনের বস্তায় ভর্তি করা হয়। আর ব্লক নির্মাণ করা হচ্ছে সিংগেজ পাথর দিয়ে। স্টন চীপার ঠিকমতো সরবরাহ না পাওয়ায় এই সিংগেজ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে ঠিকাদার কোম্পানি জানায়।
প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার জিও ব্যাগের বস্তা নদীতে ডাম্পিং করা হচ্ছে। মোট ৫.৪ কিলোমিটার কাজের মধ্যে ডাম্পিংয়ের জন্য বাকী রয়েছে মাত্র ১৬শ’ মিটার। এখন স্লোপ কাটিংয়ের কাজ চলছে। মার্চেও মধ্যে স্লোপ তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে এবং এপ্রিলের মধ্যেই এতে জিওব্যাগ বসানো হবে। এজন্য চেইন ডোজার দিয়ে নদী তীরে স্লোপ তৈরি করা হচ্ছে। যমুনার ভাঙন ঠেকাতে নদীর পার থেকে ৪৩ মিটার পর্যন্ত আন্ডার ওয়াটার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে।
গতবছর চৌহালীতে ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভাঙন ছিল। এপ্রিলের মধ্যে চলমান নদী ভাঙন প্রতিরোধ কাজ শেষ করতে না পারলে আসন্ন বর্ষায় কমপক্ষে দুই কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিওন) মো. আবদুল হাই বাকী ইনকিলাবকে বলেন, প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। এ বছরের কাজের জন্য অর্থের ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, মূল কাজের অতিরিক্ত আরও ২ কিলোমিটার নদী তীর শাসন করা হবে। যাতে করে মূল কাজে ভাঙন দেখা না দেয়। এই কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। এজন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বানের প্রয়োজন হবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আস্থা সঙ্কটে এলাকাবাসী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ