Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হুমকির মুখে শিশুস্বাস্থ্য

প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : দেশের অন্যতম চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় তলায় নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডের ওপরে বসানো হয়েছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দুটি মোবাইল টাওয়ার। সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, এটি দেশের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল, যেখানে রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। এসব টাওয়ার থেকে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা বিকীরিত হয়। যা নবজাতক ও শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পৃথিবীখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের নকশায় নির্মিত এ হাসপাতাল ভবনের তৃতীয় তলার উত্তর দিকে দুটি মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। এর একটি ১১ নম্বর ওয়ার্ড (নবজাতক বিভাগ) এর ওপরে। অপরটি ১২ নম্বর ওয়ার্ড (শিশু ও গাইনী) এর ওপরে। টাওয়ার দুটো হাসপাতালের বাইরে থেকে কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এই হাসপাতালে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। যারা হাসপাতাল প্রশাসনকে ছাপিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সিন্ডিকেটই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়েই মোবাইল ফোন কোম্পানীকে টাওয়ার বসানোর অনুমতি দিয়েছে। টাওয়ার বসানোর জন্য ফোন কোম্পানী হাসপাতালের ছাদে দুটি ছোট কক্ষও নির্মাণ করেছে। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সেখানে রয়েছে দুটি জেনারেটরও। সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিনের পুরনো ভবনের ছাদের ওপর স্থাপিত এসব জেনারেটরের শক্তিশালী ভাইব্রেশনে যেকোন সময় ধসে পড়তে পারে ছাদের অংশ। এতে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে পারে নিচের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের রোগীরা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ও ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. মোয়াররফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, যেকোন ধরনের রেডিয়েশনই মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। তবে এই ক্ষতি দৃশ্যমান নয়। আজকে যে রেডিয়েশনের শিকার হচ্ছেন, আগামী ১০ বছর পরে হয়তো এর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। তিনি বলেন, এসব দিক বিবেচনায় এনে উন্নত বিশ্বে আবাসিক এলাকা থেকে যথাসম্ভব দূরে টাওয়ার স্থাপন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বাড়ির ছাদে ছাদে এসব স্থাপন করা হচ্ছে। নবজাতক ও প্রসূতীদের জন্য এটা ক্ষতি কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই ক্ষতিকর।
ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হায়দার আলী ইনকিলাবকে বলেন, টাওয়ারের ক্ষমতা নির্ণয় না করে এটা বলা কঠিন।
১৯৬৩ সালে নির্মিত এই হাসপাতাল ভবনের ছাদে জেনারেটার স্থাপন ভবনের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শরিফ উদ্দিন। তিনি বলেন, যখন ভবনের নকশা করা হয় বা নির্মাণ করা হয়, তখন এ ধরনের কোন বিষয় ছিল না। ফলে জেনারেটর দীর্ঘ মেয়াদে ভবনের জন্য ক্ষতির সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, জেনারেটরে এক ধরনের ভাইব্রেশনের সৃষ্টি হয়। তাই সব ক্ষেত্রে এটা ভবনের নীচে স্থাপন করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের ছাদে স্থাপিত মোবাইল টাওয়ার দুটির একটি গ্রামীণফোনের অপরটি বাংলালিংকের। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন কোম্পানী দুটিতে যোগাযোগ করলে টাওয়ার সম্পর্কিত বিষয়গুলো গোপন উল্লেখ করে তারা তথ্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানান, এই হাসপাতালের জায়গায় মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই একটি ফার্মেসিকে ব্যবসার অনুমতি দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের বিশাল জায়গার ওপর নির্মাণ হয়েছে পার্কিং জোন। যেখানে শত শত মোরটসাইকেল, গাড়ি পার্কিং-এর নামে চলছে চাঁদাবাজি। এছাড়া হাসপাতালের ইন্টারনেট লাইনও যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে কোয়ার্টারের বাড়িতে বাড়িতে। যা হাসপাতালের সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আব্দুল কাদের নামের একজন রোগী জানান, টিকেট কেটে আউটডোরে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ডাক্তার দেখিয়েছেন। ডাক্তার তাকে বুকের এক্স-রে করতে বলেছেন। কিন্তু এক্স-রে বিভাগ থেকে বলেছে আজ হবে না, কাল আসেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা ছোটখাটো চাকরি করে খাই। চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন কি আমাদের পক্ষে আসা সম্ভব। অনেক অনুরোধ করলাম কিন্তু কাজ হলো না।
গাইনী ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর স্বজন আসমা জানান, রোগী ভর্তি আছে। ওয়ার্ডের পাশেই ডাক্তারদের রুম। কোন সমস্যায় তাদের ডাকলে বা কথা বলতে চাইলে তারা আসতে চান না। এমনকি খারাপ ব্যবহারও করেন। এসময় নান্নু ও শহীদ নামের আরো দুজন রোগীর স্বজন এই অভিযোগের সপক্ষে অবস্থান নেন। জানাগেছে, সম্প্রতি ৩৭৫ শয্যার এই হাসপাতালকে ৮৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও সেই তুলনায় বাড়ানো হয়নি সুযোগ-সুবিধা। রয়েছে রোগ নির্ণয়ের নানা যন্ত্রের অপর্যাপ্ততা। হাসপাতাল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন বহির্বিভাগের প্রায় আড়াই হাজার রোগীকে এবং আন্তঃবিভাগে সেবা দেয়া হচ্ছে প্রায় ৫ শতাধিক রোগীকে। এছাড়া এদের মধ্য থেকে প্রতিদিন ভর্তি করা হচ্ছে অন্তত ১শ’ জনকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মচারী বলেন, এই হাসপাতালের আরেক সমস্যা রাজনীতি। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। তাদের নানা কর্মকা-ে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার হাসপাতাল এলাকায় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে হাসপাতালের সামগ্রিক চিকিৎসা পরিবেশ বিঘিœত হয়েছে।
সকাল ৯টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে দেখা গেছে, সকাল থেকেই হাসপাতালের যত্রতত্র নিয়মবহির্ভূতভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এমনকি বহির্বিভাগের চিকিৎসকদের কক্ষের সামনেও তাদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। হাসপাতালের সামনে ও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সেবা-পরিষেবার নির্দেশনা থাকলেও বিশাল পরিসরের হাসপাতাল ভবনে অনেক রোগী হারিয়ে যান। রোগীদের সুবিধার্থে তথ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে কাউকে পাওয়া যায় না। হাসপাতাল ভবনের অভ্যন্তরে সুন্দর ফুলের বাগান থাকলেও বাথরুমগুলোর অবস্থা বেহাল। তৃতীয় তলার দক্ষিণ দিকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে নানা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি।
এসব প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. উত্তম বড়ুয়া বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে হাসপাতালের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। সরকারি হাসপাতালে চাইলেই অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এই বিশাল হাসপাতালের জন্য নিরাপত্তা রক্ষী মাত্র ১৫ জন। যার ১২ জনের মতো কর্মক্ষম। তিনি বলেন, শয্যা বৃদ্ধি করা হলেও সামগ্রিক সুবিধা এখনো বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তাই রোগী সেবায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। তবে তিনি হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বলেও জানান। মোবাইল টাওয়ারের বিষয়ে প্রফেসর উত্তম বলেন, এই হাসপাতালের নির্মাণ অন্য হাসপাতালের থেকে আলাদা। হাসপাতালের ভেতরে মোবাইলের কোন সংযোগ পাওয়া যায়না। ফলে চিকিৎসক এবং রোগী সকলের সমস্যা হয়। সেই চিন্তা থেকেই মোবাইল টাওয়ার বসানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। টাওয়ারের রেডিয়েশনে ঝুঁকি হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষ যে মোবাইল সেট ব্যবহার করে, সেটা থেকেও রেডিয়েশন ছড়ায়। পার্কিং সম্পর্কে তিনি বলেন, আগে এখানে অনেক গাড়ি চুরি হতো। সমস্যা সমাধানে ডিএমপিকে জানানো হয়। পরে ডিএমপির পরামর্শেই এই পার্কিং বসানো হয়েছে। এখন আর কোন গাড়ি চুরি হয় না। এখানে চাঁদাবাজির কোন সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইন্টারনেট সংযোগ সম্পর্কে তিনি বলন, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও জানান।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হুমকির মুখে শিশুস্বাস্থ্য
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ