Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের ৮টি জেলায় বাম্পার ফলন হলেও দাম পায়নি কৃষকরা

সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ী ও মিলারদের ঘরে লাখ লাখ মণ ধান মজুদ

| প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার : চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নি¤œ আয়ের মানুষদের উপর। কারণ দাম বাড়ার দৌড়ে মোটা চাল এগিয়ে আছে। উচ্চবিত্তদের আহারযোগ্য চিকন চালের দাম অপেক্ষাকৃত কম বেড়েছে। ফলে দাম বাড়ার যাঁতাকলে নিষ্পেতিত হচ্ছে দেশের সিংহভাগ খেটে খাওয়া নি¤œআয়ের মানুষেরা। অথচ গত কয়েক বছর ধরে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। যার ৭০ শতাংশই মোটা জাতের ধান। এই তথ্য মাঠ পর্যায় থেকে সরকার পর্যায়ের। বাস্তবেই বাম্পার ফলন হয়েছে। ধানের বাম্পার ফলন হলেও হঠাৎ করেই এ বছর চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। যা অব্যাহত রয়েছে। চালের দাম বাড়ার ব্যাপারে অনেকেই দুষছেন মিল মালিকদের। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে ধানের অভাবে অনেক মিল বন্ধ হওয়ার খবরও রয়েছে। তাহলে বাম্পার ফলনের এত ধান কোথায় গেল। এর কোনো সঠিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। গরিব অসহায়দের বাঁচাতে ভর্তুকি দিয়ে সরকার ১০ টাকা কেজি চাল সরবরাহ করছে বিরতিহীনভাবে। দিনাজপুর জেলাতেই খাদ্য বিভাগের তালিকাভুক্ত নি¤œআয়ের পরিবারের সংখ্যা এক লক্ষ ৩৬ হাজার। তার পরেও গরিব-অসহায় মানুষদের হাহাকার কমছে না। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী জানালেন, ভর্তুকি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ বা গরিব মানুষের হাহাকার থামানো যাবে না। এর জন্য দরকার সঠিক তদারকি, ট্রেডিং ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থলগ্নিকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নজরদারি। এর বাদেও রয়েছে মাঠ পর্যায়ের সঠিক চিত্র সরকারের উপর মহলে না থাকা। লাগাতারভাবে মোটা ধানের দাম না পেয়ে হঠাৎ করেই গত আমন মৌসুমে হাইব্রিড জাতের মোটা ধান আবাদ কমে যাওয়ার বিষয়টি সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলে সাড়া না ফেললেও ব্যবসায়ীরা সময়কে কাজে লাগাতে ভুল করেনি। আর এ কারণেই ৭শ’ টাকার বস্তার ধান এখন বিক্রি করছে ২ হাজার টাকায়। কয়েক মাসে কোটিপতি হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরা হাসলেও কাঁদছে কৃষক আর খেটে মানুষে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, গত কয়েক বছর ধরে দিনাজপুুর ও রংপুর অঞ্চলের ৮টি জেলাতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু মোটা ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কম হওয়ায় কৃষকেরা সর্বশান্ত হয়েছে। বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে কৃষকেরা মোটা ধানের আবাদ থেকে সরে আসে। গম-ভুট্টার পাশাপাশি চিকন ধান আবাদে ঝুঁকে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় গত আমন মৌসুমে মোটা ধানের আবাদ অর্ধেকে নেমে আসে। গত আমন মৌসুমে দিনাজপুরের ১৩ উপজেলায় দুই লক্ষ ৫৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে  আমনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড বা উফশী জাতের আবাদ হয়েছে মাত্র ১৩৭৫০ হেক্টরে। যা মোট আবাদী জমির মাত্র ৬ শতাংশ।
সূত্র মতে মোটা ধানের আবাদ কম হওয়ার বিষয়টি ব্যবসায়ীরা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কৃষি ও খাদ্য বিভাগ বুঝতে পারেনি এবং সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলের নজরেও আনতে পারেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ মন ধান কিনে গোডাউন ভর্তি করে ফেলে আগে-ভাগেই। তার মতে আমন কাটা মারা মৌসুমের শুরুতে হাই ব্রিড জাতের মোটা ধানের বস্তা ৭ থেকে ৮শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এই ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকা বস্তা দরে। উচ্চ মূল্যের এই ধানের ক্রেতা মূলত মিল মালিকরাই। আবার বড় বড় অটো মিল মালিকদের ঘরেও রয়েছে লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন ধান। যা তাদের মিল সচল রাখার জন্য অপরিহার্য বলে মিল মালিকেরা দাবি করছে। স্বাভাবিকভাবেই ২০/২২ টাকা কেজি মূল্যের চাল ৪০/৪২ টাকায় বিক্রি হলেও কারো কিছু করার নেই। এক কথায় এই মুহূর্তে অর্থাৎ নতুন ধান না ওঠা পর্যন্ত সরকার বা কারো’র পক্ষেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দিনাজপুরে হাটে-বাজারে চাল প্রতি কেজি মিনিকেট ৪৬-৪৭, আঠাশ ৪৫-৪৬, পাইজাম ৪৮-৫০, স্বর্ণ ৪০-৪২, গুটি স্বর্ণ ৩৮-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দিনাজপুরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম তদারকি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। তার মতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক ব্যাংক তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ঋণ দিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এসব ঋণের ১০ শতাংশ শিল্প খাতে নয়। অধিকাংশ ঋণই হচ্ছে সিসি, হাইপো, প্লেজ ইত্যাদি। ট্রেড ও ফুড গ্রেইন (রাইস ও হাসকিং মিল)-এর লাইসেন্সের বিপরীতে দেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব টাকা ব্যবহার হচ্ছে কেবলমাত্র ধান, ভুট্টা ইত্যাদি গুদামজাত করার কাজে। প্রশ্ন থাকতে পারে বাজার থেকে ধান ক্রয় করার কারণেই চাহিদা বাড়ে। এটা যেমন ঠিক তেমনি এটাও ঠিক ক্রয়-বিক্রয় নীতি মানা হচ্ছে না এক্ষেত্রে। এক বছর মেয়াদি এসব ঋণ মূলত বছর শেষেই নবায়ন করা হয়ে থাকে। যা তদন্তে বের হয়ে আসবে। সূত্রটির মতে বড় বড় অটো রাইস মিলারদের তুলনায় এসব সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীদের ঘরেই বেশি ধান মজুদ হয়ে থাকে। এসব মজুদদারদের কাছেই অতিরিক্ত মূল্যে মিলাররা এখন ধান ক্রয় করছে তাদের চাহিদা পূরণ করছে।
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার আবদুল হান্নান একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার কয়েকটি মেজর অটো মিল রয়েছে। জহুরা অটো রাইস মিলের এই ব্যবসায়ী জানালেন ধান না থাকায় তার মিলগুলি বন্ধ রয়েছে। আগামী বোরো ধান উঠলে আবার চালু হবে তার চাল তৈরি কার্যক্রম। এরকম আরো বেশ কয়েকটি মিল রয়েছে যারা ধানের অভাবে মিল বন্ধ রয়েছে।
জেলা খাদ্য বিভাগ জানিয়েছে, খোলা বাজারে চাল বিক্রি অনেক আগেই বন্ধ রয়েছে। এখন চালু রয়েছে কার্ডের বিপরীতে পরিবারপ্রতি ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি কার্যক্রম। মাসে একবার করে দিনাজপুরে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার পরিবারকে চাল বিক্রি কার্যক্রম চলছে। যদিও এসব চাল বিতরণে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়ছে ১০ টাকার চাল কালোবাজারে বিক্রি করার সময়। এসব চাল বিতরণে দলীয় পরিচয় কাজ করায় প্রকৃত অসহায় ও দুস্থ পরিবারেরা এই কার্ড পায়নি এই অভিযোগ কার্যক্রমটি শুরুর পর থেকেই আলোচিত হচ্ছে। সচেতন একজন ব্যবসায়িক রাজনীতিবিদ বলেন, মজুদদারি বন্ধ ও সরকারের দেয়া ভর্তুকি’র চাল বিতরণ সঠিকভাবে সঠিক মানুষ ও পরিবারদের মধ্যে দেয়া হলে নি¤œ আয়ের মানুষদের মধ্যে হাহাকার থাকবে না। আর নিম্ন আয়ের মানুষদের চাহিদা কমে বাজারেও চালের দামে অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমে আসবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাল

১১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ