বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ : বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় দূষিত নগরগুলোর একটি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। অপ্রিয় হলেও সত্য ঢাকাবাসীকে আজ একটি দূষিত নগরীর বাসিন্দা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে হচ্ছে। খাদ্য দূষণ, পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, শব্দ দূষণ ইত্যাদি নানান পরিবেশগত দূষণের সাথে তাকে সহাবস্থান করতে হচ্ছে। বর্তমানে নগরীতে শব্দ দূষণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়। এ শব্দ দূষণ জনজীবনে নানান অসুবিধার সৃষ্টি করছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নানাভাবে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজধানীতে শব্দের সহনীয় মাত্রা দিনের বেলা ৪০ থেকে ৪৫ ডেসিবল (বিজ্ঞানীদের ভাষায় শব্দ মাত্রার যন্ত্র অনুযায়ী) এবং রাতের বেলা ৩০ ডেসিবল হলেও প্রকৃত অবস্থা সহনীয় মাত্রার চেয়ে তা বহুগুণ বেশি। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত- রাজধানীতে শব্দ দূষণের মাত্রা ১০০ ডেসিবলের ওপরে যা একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য ভয়াবহ অসহনীয় রূপ নিয়েছে। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর জরিপ করে যে তথ্য প্রদান করেছে তাতে দেখা যায়- ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শব্দ দূষণ দিনের বেলায় ৭৪ ডেসিবল এবং রাতের বেলায় ৮২.৫ ডেসিবল, শাহবাগে দিনের বেলায় ৭৫ ডেসিবল এবং রাতে শব্দ দূষণের মাত্রা ৮২ ডেসিবল, আগারগাঁও এলাকায় দূষণের মাত্রা দিনে ৬৯ ডেসিবল এবং রাতে ৭২ ডেসিবল, আজিমপুরে দিনে ৭৪ ডেসিবল এবং রাতে ৮২ ডেসিবল, ধানমন্ডিতে দিনে ৭৫ ডেসিবল এবং রাতে ৮০ ডেসিবল এবং চাঁনখারপুল এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা দিনের বেলা ৬৯ ডেসিবল এবং রাতে ৮০ ডেসিবল।
ঢাকার শব্দ দূষণ বিষয়ক আরেক জরিপে দেখা গেছে- ২০ জন স্কুটার চালকের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ লোক কানে কম শুনে। বিভিন্ন পেশায় জড়িত ১০০ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখে গেছে- সবাই কমবেশি শব্দ দূষণের কারণে কোন না কোন রোগে আক্রান্ত। রোগগুলো হলো- চরম মাথা ব্যথা ও মাথা ধরায় ভুগছে ২৫.৮০ শতাংশ। শ্রবণশক্তি হারানোর সংখ্যা ১২.৩১ শতাংশ। নিদ্রাহীনতা ১৭.৫৮ শতাংশ, কানের অন্যান্য রোগ ১৪.৩৬ শতাংশ, শারীরিক-মানসিক অস্থিরতা ও অসুস্থতা ২৭.৫৯ শতাংশ এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২.৬৪ শতাংশ। রাজধানীর শব্দ দূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে যানবাহন। বিশেষভাবে স্কুটার, টেম্পো বা দুই স্টোকবিশিষ্ট যানবাহন যেগুলো একই সঙ্গে বায়ু ও শব্দ দূষণে সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়া যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন যা শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
রাজধানী ঢাকার যানবাহনের শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ ভাগই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে। নগরীতে যানবাহন ছাড়াও বিভিন্ন কলকারখানা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদিও শব্দ দূষণে প্রভাব ফেলে। এক জরিপে দেখা গেছে নগরীর স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ হয়। এ শব্দ দূষণের মাত্রা সর্বনি¤œ ৫৩ ডেসিবল এবং সর্বোচ্চ ৮৩ ডেসিবল। শব্দ দূষণের ফলে নানান রোগের সৃষ্টি হয়। শব্দ দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। বেশিরভাগ শিশু সম্প্রতি কানে কম শোনা রোগে ভুগছে বলে শিশু বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তাররা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। শব্দ দূষণের ফলে কানের নানারকম ব্যাধির কথা এখন শোনা যায়। কানের পর্দা ফেটে যায় অসহনীয় শব্দ হলে। বয়স্কদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং ডায়াবেটিক রোগ হওয়ার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে শব্দ দূষণ একটি বড় কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উচ্চ শব্দ হলে হার্টের বিট বেড়ে যায়। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
অনবরত শব্দ দূষণের ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় রোগীদের ক্ষতি করে। তাদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটায়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। মহল্লায় বা কোন এলাকায় উচ্চ ভলিয়মে সিডি বাজালে, মাইকিং হলে এলাকার লোকদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যারা অসুস্থ বা পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন তাদের শব্দ দূষণে বেশি ক্ষতি হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় বা কোন উৎসব পর্বে কোন আন্তর্জাতিক দিবসে খেলাধুলায় জয়লাভ করলে বাজি, আতসবাজি, বোমাবাজি, ককটেল ফোটালে এতে দুর্ঘটনা যেমন হয়, তেমনি পরিবেশ দূষণে এই শব্দ দূষণ সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। উচ্চ ক্ষমতাসম্প¤œ বাজি ফোটানো হৃদরোগীদের মৃত্যু ঝুঁকিও বেড়ে যায় আতংকগ্রস্ত থাকার কারণে।
শব্দ দূষণে এত খারাপ দিক থাকা সত্তে¡ও এর প্রতিকারের জন্য অদ্যাবধি ব্যাপক কোন কর্মসূচি সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়নি। সরকার সম্প্রতি ঢাকার তিনটি সড়কে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহাকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। কিন্তু ঐ পর্যন্তই শেষ। সত্যিকারভাবে আইন এখনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করেনি।
এই সড়ক তিনটি ভিআইপি সড়ক বলে সর্বমহলে পরিচিত। আমরা নগরীর প্রতিটি সড়কে শব্দ নিয়ন্ত্রণের হর্ন ব্যবহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে আসু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রত্যাশা করবো। বিদেশে শব্দ নিয়ন্ত্রণের মেশিন ব্যবহার করা হয়। ফলে শব্দ একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। ফলে নগরীতে বসবাসরত মানুষের ক্ষতি হয় না।
পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে সবাইকে জাতীয় স্বার্থে এই আন্দোলনে যোগ দিতে হবে। এটা সবারই নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলে আমরা কেউই সুস্থভাবে জীবনধারণ করতে পারবো না। মুমূর্ষু রোগীর মতো একটি জাতি বেঁচে থাকতে পারে না। নগরীর জনজীবনের দিকে তাকালে সেরকমেরই একটি ধারণা সবার মধ্যে জন্মাবে। এই অবস্থা থেকে অবশ্যই আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে।
ঢাকাবাসীকে একটি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ দিতে হলে অবশ্যই শব্দ দূষণ রোধ করার বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে এবং এই আইনের বিধান লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক আরেকটি আইন জারি করতে হবে।
মার্চের (২০১৭) প্রথম সপ্তাহে একটি টিভি চ্যানেলে একটি সংবাদ প্রচারিত হয় তাতে দেখানো হয়- রাজধানীতে রাতে বায়ু দূষণ সবচেয়ে বেশি। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, রাতে যেহেতু ভারী যানবাহন বিশেষ করে ট্রাক ও লরিজাতীয় যান চলাচল বেশি করে। এদের নির্গত ধোঁয়া বায়ু দূষণ ঘটাচ্ছে। তাছাড়া রাজধানীর সিংহভাগ সড়কজুড়ে চলছে গ্যাসলাইন বসানো ও মেরামতের কাজ। এ কারণেও বাতাসে ভয়াবহ বায়ু দূষণ ঘটাচ্ছে। সংবাদ প্রতিবেদনে আরো বলা হয় রাতে মহানগরীতে যে হারে ট্রাক চলাচল করে এবং এর ফলে সৃষ্ট জ্যাম নিয়ন্ত্রণের জন্য গভীর রাতে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালুর পক্ষে মত প্রকাশ করে অধিকাংশ ট্রাকচালক।
আমরা নানা দূষণে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি পত্রিকায় উঠেছে বায়ু দূষণে বছরে মারা যাচ্ছে ৪৫ হাজার মানুষ। শ্বাসকষ্টে ভুগছে ৭০ লাখ মানুষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন এবং সেই অনুযায়ী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক অবকাঠামো গড়ে উঠছে যার কারণে দূষণের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। আইন আছে কিন্তু তা মানছে না কেন সেই দিকে দৃষ্টি দেয়ার কেউ আছে বলে মনে হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদÐ অনুসারে বায়ু দূষণ পরিমাপ করা হয়ে থাকে পিএম ২ দশমিক ৫-এর লেভেল অনুসারে। পিএম ২ দশমিক ৫-এর লেভেল দৈনিক ২০ থাকলে সেটাকে স্বাভাবিক এবং লেভেল ৩০০-এর অধিক হলে সেটাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে হুমকি বলে মনে করা হয়। ঢাকার বাতাস পিএমের লেভেল বর্তমানে চারশ অতিক্রম করছে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী বাড়ার মূল কারণও এসব দূষণ।
য় লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।