Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

এটিএম কার্ড জালিয়াতি

প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : এটিএম কার্ড জালিয়াতির সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ঘটনার সাথে ১৩০ জনের জড়িত থাকার তালিকা রয়েছে কাউন্টার টেরোরিস্ট অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। তাদের মধ্যে পুলিশ, ব্যংাক কর্মকর্তা, হোটেল ব্যবসায়ী, আদম ব্যবসায়ী, ডলার ব্যবসায়ী এবং ট্রাভেল এজেন্সির কয়েকজন মালিকও রয়েছেন। আছে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নাম। অন্যদিকে গতকাল পিটারসহ ৪ জনকে পুনরায় ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি পুলিশ।
এর আগে রিমান্ডে থাকা থমাস পিটার এই জালিয়াতি সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে তদন্তকারীদের। জালিয়াতির সাথে জড়িত আরেক বিদেশির পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, বড় ধরনের ব্যাংক জালিয়াতির পরিকল্পনা ছিল তাদের।
কাউন্টার টেরোরিস্ট অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম গতকাল আবারো বলেছেন, এ ঘটনায় রাঘব বোয়াল অনেকের নাম আসছে। ঘটনাগুলো বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ড শাখা, প্রতারক ও বিদেশিদের মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকের কর্মকর্তা, আবাসিক হোটেল ও ট্রাভেল এজেন্সির লোকজন জড়িত রয়েছেন। তিনি বলেন, জড়িত রাঘব বোয়ালদেরও গ্রেফতার করা হবে। কাইকে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। মনিরুল ইসলাম বলেন, কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই সব কিছু বলা যাচ্ছে না। গতকাল তিনি ইনকিলাবকে এসব কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেন, অন্যান্য যেসব ব্যাংকেও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে গ্রেফতার চার ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
এছাড়া সদ্য গুলশান থানা থেকে রংপুর ডিআইজি রেঞ্জে বদলি হওয়া পুলিশ পরিদর্শক ফিরোজ কবিরের নামও রয়েছে। তিনি এটিএম জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সেইসঙ্গে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য খুঁজে পেয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সম্প্রতি এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় এক বিদেশি নাগরিক ও তিন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করায় এ তথ্য বেরিয়ে আসে। গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত পোলান্ডের নাগরিক পিটার বাংলাদেশে অবস্থানকালে গুলশান থানার পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) ফিরোজ কবিরের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। তার সঙ্গে থানার কক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা পেটাতেন। ঘুরতে বের হলে ফিরোজ কবিরের কেনা কালো রংয়ের র‌্যাভ-৪ (জঅঠ-৪) গাড়িতে করে থানা থেকে বের হয়ে যেতেন।
গোয়েন্দাদের দাবি, এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত ৫১ জনের মতো ব্যাংক কর্মকর্তার নামের তালিকা করা হয়েছে। এ তালিকা অনুযায়ী অতি সর্তকতার সাথে সব কিছু যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে হয়তো ১০/১২ জন সরাসরি জড়িত থাকতে পারে। তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
ডিবির কর্মকর্তারা আরো জানান, ফিরোজ সাহেবের ব্যবহৃত কালো রঙের র‌্যাভ-৪ গাড়িটি রাশিয়ান। এটির দাম প্রায় কোটি টাকা। একজন পুলিশ পরিদর্শক হয়ে কীভাবে এতো টাকা দিয়ে গাড়ি কিনলেন। সাধারণত একজন পুলিশ কর্মকর্তা এরকম গাড়ি ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখেন না। তার টাকার উৎস নিয়েও খোঁজ খবর নিচ্ছে গোয়েন্দারা। তার ওই গাড়িটি জব্দ করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে।
গুলশান থানার একজন এসআই (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সাদা চামড়ার একজন বিদেশি লোক (পিটার) পুলিশ পরিদর্শক ফিরোজ সাহেবের সঙ্গে সবসময় ঘোরাফেরা করতেন। তার রুমে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন। রুমে কেউ গেলে তাদের কথা বলা বন্ধ থাকতো। কম্পিউটারের মধ্যে কী যেন দেখতেন তারা। তিনি আরো জানান, কয়েকদিন আগে এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে পুলিশের রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। তিনি এখন রংপুরে রয়েছেন।
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের আরেকটি সূত্র বলছে, এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় অনেক বড় বড় লোকের নাম বেরিয়ে এসেছে যারা জড়িত। কাকে ধরবে আর কাকে ধরবে না তা নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকায় পড়েছে পুলিশ। কারণ, এই কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় শুধু ব্যাংক কর্মকর্তা ও পিটার জড়িত নয়। পুলিশের কয়েকজন সদস্যও জড়িত। এছাড়া গুলশান এলাকায় সরকারী দল করেন এমন বিশিষ্ট কয়েকজন নেতার নাম এসেছে। মানব সম্পদের ব্যবসা করেন তাদের নামও জড়িতদের তালিকায় এসেছে। গুলশান এলাকায় হোটেলগুলোতে নারী সাপ্লাই করে এমন একজন লোকের নামও বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া মতিঝিলকেন্দ্রিক যারা ডলারের ব্যবসা করেন তাদের নাম এবং পল্টনকেন্দ্রিক যারা মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের নামও বেরিয়ে এসেছে।
এটিএম কার্ডের তথ্য চুরিতে সহায়তা করার অভিযোগে গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইবিএল (ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড) এর কর্মকর্তারা। একইসঙ্গে এটিএম কার্ড জালিয়াত চক্রের সদস্যদের খুঁজে বের করতে আরও কয়েকটি ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের কর্মকর্তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ হয়েছেও। প্রয়োজনীয় কিছু তথ্যর বিষয়ে নিশ্চিত হলেই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
ডিবি পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদেই চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। সেই তথ্যের আলোকে এই চক্রের আরও কয়েক সদস্যকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এদের সবাই ব্যাংক কর্মকর্তা বলে জানিয়েছে পুলিশ। বেসরকারি ব্যাংক ইবিএল এর কিছু কর্মকর্তা পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। এই জালিয়াত চক্রের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের আরও কয়েকজন জড়িত রয়েছে এমন তথ্য পেয়েছে ডিবি পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় তিনশ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে হ্যাকাররা। অর্থাৎ বিদেশি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে এদেশের বুথগুলো থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে বিদেশিদের টাকার পরিমাণই বেশি। তাই দেশীয় ব্যাংকগুলো এতোটা উদ্বিগ্ন হয়নি। কিন্তু এ মাসে দেশীয় টাকা খোয়া যাওয়ার পরপরই বিষয়টি ব্যাংকারদের নজরে আসে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি বনানী থেকে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে সবশেষ টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ সিটি ব্যাংকের তিনকর্মকর্তা ও পোলান্ডের একজন নাগরিককে গ্রেফতার করে। প্রথম দফায় তাদের ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য পুনরায় তাদের ৪ দিনের রিমান্ডে নেয়।
এ ব্যাপারে কয়েকদিন আগে এক অনানুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে রাঘববোয়ালদের নাম বেরিয়ে এসেছে। বিষয়টি যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। তাদেরকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তদন্ত শেষে শীঘ্রই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চারজনকে পুনরায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। নতুন করে কোনো তথ্য এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই।
পিটারসহ ৪ জনের ৫ দিনের রিমান্ড
ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় তথ্য-প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় পোলিশ নাগরিক পিটারসহ চারজনকে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মাসুদ শুনানি শেষে ওই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ছয় দিনের রিমান্ড শেষে আসামিদেরকে গতকাল আদালতে হাজির করে আরও ৮ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক সোহরাব মিয়া। আদালত রিমান্ডের আবেদন শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
রিমান্ডে নেয়া আসামিরা হলেন, পোলিশ নাগরিক পিটার সাজেপেন মাজুরেক, সিটি ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের তিন কর্মকর্তা মকসেদ আল ওরফে মাকসুদ, রেজাউল করিম ওরফে করিম ওরফে শাহিন ও রেফাজ আহমেদ ওরফে রনি। এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি এই আসামিদেরকে ছয়দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদের সাথে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ অনেকেরই জড়িত থাকার কথা মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও ২২ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, একটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশে এই জালিয়াতির সাথে সম্পৃক্ত। গ্রেপ্তারকৃত পোলিশ নাগরিকও ওই চক্রের সদস্য।
এর আগেও তারা অনেকবার বিদেশি অ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম বুথের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু বিদেশে অ্যাকাউন্ট হওয়ায় তা ধরা পড়েনি। কিন্তু এবার বাংলাদেশের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আত্মসাৎ করায় তা কয়েকটি ব্যাংকের নজরে আসে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, এই জালিয়াতি চক্রের সাথে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন ও পোল্যান্ডভিত্তিক চক্র ইউরোপসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে সক্রিয় আছে।
বাংলাদেশে এটিএম বুথে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের ঘটনার সাথে একজন বুলগেরিয়ান, একজন ইউক্রেনিয়ান, লন্ডন প্রবাসী একজন বাংলাদেশি এবং সিটি ব্যাংকের ওই ৩ কর্মকর্তা জড়িত। তবে ওই দুই বিদেশি ঘটনাটি প্রকাশের আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছে পুলিশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ