Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নেপথ্যে চাঁদাবাজি

গুলিস্তান-মতিঝিলের ফুটপাত ফের দখলের পাঁয়তারা : আন্দোলনের নামে সক্রিয় হকারদের অনিবন্ধিত সংগঠন

| প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : রাজধানীর গুলিস্তান-মতিঝিল এলাকার ফুটপাতে নতুন করে হকার বসানোর পাঁয়তারা চলছে। সন্ধ্যা ৬টার আগে ফুটপাতে হকার বসার সিটি কর্পোরেশনের নিয়মকে তোয়াক্কা না করে দুপুর থেকে হকার বসা শুরু করে। এতে করে গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, পল্টন, মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকায় যানজট লেগেই থাকছে। ইতোমধ্যে হকারদের ফুটপাতে বসানোর দাবিতে সরব রয়েছে হকার্সদের কয়েকটি সংগঠন, যাদের বৈধ নিবন্ধন নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার নিবন্ধনবিহীন সেই সব সংগঠনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় শ্রম আদালতে মামলা হয়েছে (নং ৩৮২)। মামলায় বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স সমিতি, বাংলাদেশ হকার্স সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী হকার্স লীগ, ইসলামী হকার্স শ্রমিক আন্দোলন, বাংলাদেশ হকার্স সমন্বয় পরিষদসহ অন্যান্য অনিবন্ধিত হকার্স সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদেরকে বিবাদী করা হয়েছে। মামলার বাদী বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি এম এক কাশেম বলেন, অনিবন্ধিত এসব সংগঠনের আন্দোলনের একমাত্র উদ্দেশ্য চাঁদাবাজি কায়েম করা এবং চাঁদাবাজদের রক্ষা করা। এরা মুখে হকারদের কল্যাণের কথা বললেও নেপথ্যে হকারদের পুঁজি করে চাঁদাবাজি করা। জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ফুটপাতে হকারদের আর কখনওই বসতে দেয়া হবে না। দুপুরে ফুটপাতে হকারদের বসার প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, বিকালের আগে তারা কোনোভাবেই ফুটপাত আটকে রাখতে পারবে না। এজন্য বিভিন্ন পয়েন্টে আমাদের কর্মী নিয়োগ করা আছে। তারা না পারলে প্রয়োজনে পুলিশ দিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাজধানীর মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকার ফুটপাত থেকে মাসে কমপক্ষে দেড় কোটি টাকা চাঁদা উঠতো। দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতে প্রতিদিন তোলা এই চাঁদার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা। তবে রমজান মাসে এই চাঁদার পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতো। ফুটপাত দখলে রাখার কারণে মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ যানজট লেগেই থাকতো। ফুটপাতকে হকারমুক্ত করা গেলে যানজটের ভয়াবহতা অনেকটাই কমে যাবে-এমন তথ্য উঠে এসেছে বুয়েটসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সুপারিশে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বিষয়টি উপলব্ধি করার পর ফুটপাতকে হকারমুক্ত করার ঘোষণা দেন মেয়র সাঈদ খোকন। বিভিন্ন সংস্থার সাথে বৈঠক করে গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিল এলাকার ফুটপাত হকারমুক্ত করার অভিযান শুরু হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এ উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসা পেলেও হকার নামধারী কতিপয় অনিবন্ধিত সংগঠনের পক্ষ নিয়ে বাম ঘারানার নেতারাও মেয়রের বিপক্ষে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকন তাতে মোটেও কান দেননি।
হকারদের ফুটপাতে আবার বসানোর দাবিতে শুরু থেকেই যে সব সংগঠন আন্দোলনের নামে হুমকী ধমকী দিয়ে আসছে। তারা হকারদের দৈন্যদশার কথা বলে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। অথচ তাদের আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি প্রতিষ্ঠা ও চাঁদাবাজদের রক্ষা করা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন ও বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা তাদের চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখার জন্য ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার পথ বেছে নিয়ে নিরীহ হকারদের বিপথগামী করার চেষ্টা করছে। জানা গেছে, চিহ্নিত চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে এর আগে মামলা হলেও তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও চাঁদাবাজি করছে। এমনও অনেকে আছে আদৌ কোনো জামিন নেননি। কিন্তু ফুটপাত থেকে রাতের বেলায় তারা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আগের মতোই চাঁদা তুলছে। সূত্র জানায়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনের ফুটপাতে এখনও সক্রিয় সাইফুল মোল্লা। কয়েকদিন আগে এই সাইফুল মোল্লার বিরুদ্ধে আরও একটি চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। এখানকার হকাররা জানান, দুটো মামলা হওয়ার পরেও সাইফুল মোল্লাকে দমানো যায়নি। কয়েকদিন আগেও সে চাঁদা না পেয়ে হকারদের মারধর করেছে। এর বাইরে সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকী-ধমকী তো আছেই। অনেকেরই অভিযোগ পুলিশ ইচ্ছা করলেই সাইফুল মোল্লাকে ধরতে পারে। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরছে না। বরং পুলিশের সাথে সখ্যতার জোরেই সে এখনও বেপরোয়া।
গুলিস্তান এলাকায় এখনও তৎপর লাইনম্যানরূপী চাঁদাবাজরা। হকার নামধারী বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে পুরনো চাঁদাবাজরাই আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এরা রাতে চাঁদাবাজি করছে বলে কয়েকজন হকার অভিযোগ করেছেন। হকাররা জানান, চাঁদাবাজরা রাতে এসে হকারদের মাধ্যমে চাঁদা তুলে সটকে পড়ে। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাকে মারধর করা হয়। গুলিস্তান এলাকার এক হকার জানান, চাঁদা চাইতে গেলে অনেক হকার বেচাকেনা কম হচ্ছে বলে চাঁদা দিতে অস্বীকার করে। এ কারণেই চাঁদাবাজরা গত কয়েকদিন ধরে বলে আসছে এখন থেকে দুপুরেই হকাররা বসে যাবে। সে ব্যবস্থাও নাকি তারা করবে। চাঁদাবাজদের ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য দুপুর থেকেই হকারদের নিজ নিজ জায়গায় হাজির হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। হকাররা তাই দুপুর থেকেই তাদের দোকান, পসরা সাজানোর কাজ শুরু করে। এতে করেও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে দুপুর বিকাল করতে করতে হকাররা সকাল থেকে বসা শুরু করবে। তখন শৃঙ্খলা বলে কিছুই থাকবে না। গতকাল গুলিস্তান এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, হকারদের দিনের বেলায় বসতে না দেয়ার পর থেকে যানজট পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, যা আগে কখনও কল্পনাও করা যায়নি। এখন আবার নতুন করে দিনের বেলায় বসার সুযোগ দিলে আগের চেয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এটাকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না।
নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, ভয়াবহ যানজট এড়াতে ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদের কোনো বিকল্প নেই। হকাররা ফুটপাত থেকে শুরু করে রাস্তা দখল করে রাখার কারণে যানবাহন নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে না। দাতা সংস্থারা এ নিয়ে বহুবার সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে। সুপারিশ করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং এবারই প্রথম দিনের বেলায় হকারদের ফুটপাতে বসতে না দিয়ে সন্ধ্যার পর বসার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। চালু করা হয়েছে ৫টি হলিডে হকার্স মার্কেট। আরও ১৬টি হলি ডে মার্কেট তৈরীর কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। একই সাথে হকারদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১১ জানুয়ারি নগর ভবনে এক বৈঠক শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন, রোববার থেকে সাপ্তাহিক কোনো কর্মদিবসে আর গুলিস্তান ও আশপাশের এলাকায় দিনের বেলায় ফুটপাতে হকার বসতে দেওয়া হবে না। হকাররা দোকান নিয়ে বসতে পারবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরে। তবে ছুটির দিনে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এরপর রবি ও সোমবার সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকায় চালানো হয় হকার উচ্ছেদ অভিযান। উচ্ছেদের পর লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা একত্রিত হয়ে হকার সংগঠনের ব্যানারে মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দেয়। পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ না করা, হকারদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, হকারদের উপর ‘দমন-পীড়ন’ বন্ধ এবং প্রকৃত হকারদের তালিকা করে পরিচয়পত্র দেওয়াসহ ১০ দফা দাবির কথা সেখানে তুলে ধরেন তারা। অন্যদিকে নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে মেয়র সাঈদ খোকন সোমবার বলেন, জনগণের চলাচল নির্বিঘœ করতে করপোরেশেন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাঁদাবাজি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ