দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইতিহাসের নিরিখে হজের পুরস্কার : ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের প্রতিটি অক্ষর আরব ভ‚মি ও পবিত্র হেরেম শরীফের প্রতিটি ধূলি-কণার সমৃদ্ধি লাভ করেছে। হযরত আদম (আ.) হতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) পর্যন্ত এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.) হতে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে, এর সার্বিক সম্পর্ক পবিত্র ভূমির পাহাড় ও সমতল এবং ঘর-বাড়ীর সাথে অবিচ্ছেদ্য রয়েছে। এখানেই হযরত আদম (আ.) বসবাস করেছেন, আরশের ছায়াতে আল্লাহর ঘর তৈরি করেছেন, এখানে এসেই বিবি হওয়া (আ.) তার সাথে মিলিত হয়েছেন। এখানে এসেই হযরত নূহ (আ.)-এর কিশতী স্থির হয়েছিল, হযরত হুদ (আ.) এবং হযরত সালেহ (আ.) এখানে এসেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এখানেই হিজরত করেছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এখানেই বসতি স্থাপন করেছিলেন। হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-ও এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এখানেই ওই পর্বত রয়েছে (সাফা) যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.) নিজেদের সাওয়ারী গাধার পিঠ হতে অবতরণ করেছিলেন। এখানেই অপর পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে (মারওয়াহ) যার ওপর পিতা স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এখানেই সেই ঝরনা (জমজম) যা পিপাসাকাতর অবস্থায় বিবি হাজেরা অবলোকন করেছিলেন। এখানেই রয়েছে আল্লাহর ঘর যার চার দেয়াল হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) বুলন্দ করেছিলেন। এটাই ওই স্থান যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করেছিলেন। এরই নিকটে রয়েছে মীনা, আরাফাত এবং মাশয়ারে হারাম, যা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতীক। এখানেই রয়েছে ওই পাথর (হাজারে আসওয়াদ) যা হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত ইসমাঈল (আ.) এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) পবিত্র হাত দ্বারা স্পর্শ করেছেন। এটাই সেই ভূখÐ যেখানে মিল্লাতে ইব্রাহীমীর বুনিয়াদ রাখা হয়েছে। এটাই সেই আবাদি, যেখানে ইসলামের আরক্তিম সূর্য উদিত হয়েছে। এখানেই রয়েছে এমন সব গলিপথ, যেগুলো হযরত জিব্রাঈল (আ.)-এর পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছে। এখানেই সেই ‘হেরা’ গুহা, যেখানে কোরআনের আলো প্রথম বিকশিত হয়ে উঠেছিল। এখানেই রয়েছে এমন একটি ‘হেরেম অঙ্গন’ যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘ তিপ্পান্নটি বছর অতিবাহিত করেছেন। এটা সেই স্থান যেখানে জান্নাতি ‘বুরাক’ কদম রেখেছে। এখানে এমন সব বাড়ি রয়েছে, যার প্রতিটি ইট, ধূলিকণা ইসলামী ইতিহাসের এক একটি পৃষ্ঠা হয়ে রয়েছে। তবে কি কোরআনুল কারীমের ইঙ্গিত এ সকল দৃশ্যাবলী ও সাক্ষ্যস্থলসমূহের প্রতি নয়? যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে : “এই হেরেম শরীফ রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দশনাবলী যা ইব্রামীম (আ.)-এর দÐায়মান স্থল।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু ১০)
এ সকল দৃশ্যাবলী ও স্থানের প্রতি যখন কোনও জিয়ারতকারীর দৃষ্টি পতিত হয়, তখন শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসার টানে তা স্বভাবতই অধোগতি হয়ে পড়ে। তার বিশ্বাসের উচ্চ শির অবনমিত হয়। তার বিশ্বাসের রক্তে বান ডাকে এবং তার উদগ্র আশা-আকাক্সক্ষার সমুদ্রে দেখা দেয় তীব্র প্রভঞ্জন। প্রতিটি স্থানেই তার কপাল মাটি স্পর্শ করে ধন্য হতে চায়। একই সাথে ভালোবাসায় প্রাণ বন্যায় তার প্রতিটি শিরা-উপশিরা ও ধমনী আপ্লুত হয়ে যায়। যেদিকেই সে চোখ ফিরায় সেদিকের দৃশ্যাবলীই তার অন্তরে অনুকম্পনের সৃষ্টি করে। চোখে নেমে আসে অশ্রæবন্যা। তার জবান ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাসবীহ ও তাহলীল পাঠে। আর এতেই রয়েছে এমন এক ভালোবাসা ও আস্বাদ, যা ঈমানকে তরতাজা করে বিশ্বাসকে মজবুত করে তোলে এবং আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মহব্বতকে সঞ্জীবিত করে তোলে। আল-কোরআনে এ জন্যই ঘোষণা করা হয়েছে :
“এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও স্মৃতিচিহ্নগুলোর সম্মান করে তবে তার অন্তরের পবিত্রতার কারণেই।” (সূরা হজ : রুকু-৪) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা ও বিধানাবলীর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে, তবে তার এ কাজ আল্লাহর নিকট খুবই উত্তম বলে বরিত হয়।” (সূরা হজ : রুকু-৪)
সুনির্মল আধ্যাত্মিকতা : হজের হাকিকত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আগেই বলা হয়েছে যে, হজ মূলত প্রচলিত কোরবানি ও দৌড়ঝাঁপ নয়; বরং এগুলো হচ্ছে হজের আধ্যাত্মিক রূপরেখার বস্তু এবং উপাদানভিত্তিক প্রতিকৃতি। বস্তুত হজের আরকানসমূহ আমাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ও উদাহরণ মাত্র। এ জন্যই সরওয়ারে কায়েনাত রাসূলুল্লাহ (সা.) আসল এবং সহিহ হজের নামকরণ করেছেন, ‘হজের মাবরুর’ বা মাকবুল হজ। অর্থাৎ এমন হজ, যার সর্বাঙ্গ নেকী ও পুণ্যে পরিপূর্ণ। আর এই শ্রেণীর হজই হচ্ছে এ সকল বরকত এবং রহমতের ভাÐার, যা আরাফাতে প্রার্থনাকারীদের জন্য নির্ধারিত। হজের আধ্যাত্মিক রূপ মূলত তাওবাহ, এনাবত অতীতে ক্ষয়কৃত জীবনের ক্ষতিপূরণের মাঝেই নিহিত। এরই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ইব্রাহীম (আ.)-এর এই দোয়ার মাঝে পাওয়া যায়। ইরশাদ হচ্ছে : “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের সন্তান-সন্ততির মাঝেও একটি অনুগত শ্রেণী সৃষ্টি করুন এবং আমাদেরকে আপনার হজের আহকাম ও নিয়মাবলী শিক্ষাদান এবং আমাদের তাওবাহ কবুল করুন, অবশ্যই আপনি তাওবাহ কবুলকারী দয়াময়।”
(সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫)
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর এই প্রার্থনাও অন্যান্য প্রার্থনাগুলোর মতো কবুল হয়েছিল। এতে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, হজ হচ্ছে, যে পবিত্র ভূমিতে অধিকাংশ নবী ও রাসূল এবং মহাত্মাগণ উপস্থিত হয়ে নিজেদের আনুগত্য ও আত্ম নিবেদনের স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন, যেখানে তারা আত্মোৎসর্গের চ‚ড়ান্ত পথ খুঁজে পেয়েছিলেন, ঠিক সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে নিজের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করা এবং পুণ্য স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহের পরিভ্রমণ করে তাওবাহ, ইস্তেগফার করা এবং স্বীয় প্রতিপালককে রাজি ও খুশি করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এই খোশ-খবরী প্রদান করেছেন যে, “আরাফার দিন হতে উত্তম কোনো দিন নেই। এই দিনে আল্লাহপাক স্বীয় বান্দাহদেরকে দোজখের আজাব হতে মুক্তিদান করেন, সেদিন তিনি স্বীয় বান্দাহদের অতি নিকটে আগমন করেন এবং ফেরেশতাদের সামনে নিজ বান্দাহদের ব্যাপারে গর্ব প্রকাশ করে বলেন, তারা যা প্রার্থনা করেছে, আমি তা কবুল করেছি।” (সহীহ মুসলিম, সুনানে নাসাঈ) রাসূলুল্লাহ (সা.) এই বেশারতও প্রদান করেছেন যে, “বদর দিন ব্যতীত আরাফার দিন হতে বেশী লজ্জিত, অপমানিত ও রুষ্ট শয়তান কোনো দিন হয় না। কেননা, সে সেদিন দেখতে পায় যে, আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে, গোনাহসমূহ ক্ষমা করা হচ্ছে।”। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)
অনুরূপভাবে অসংখ্য হাদিসে খালেসভাবে হজ আদায়কারীদের সম্পর্কে খোশ-খবরী রয়েছে। এ সকল হাদিস মূলত হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর এই দোয়ারই তাফসীর, “হে আল্লাহ। আমাদেরকে হজের সত্যিকার পথ বলে দিন এবং আমাদের তাওবাহ কবুল করুন।” এ সকল বেশারত দ্বারা এ কথাই প্রতিপন্ন হয় যে, প্রকৃতই হজ হচ্ছে তাওবাহ এবং এনাবত। এ জন্যই ইহরাম বাঁধার সাথে সাথে হজ আদায়কারীর মুখ হতে বেরিয়ে আসে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ ধ্বনি। অনুরূপভাবে তাওয়াফ, সাঈ, আরাফাত, মুজদালিফা, মীনা প্রতিটি স্থানে যে সকল দোয়া পাঠ করা হয়, এগুলোর বৃহদাংশই হচ্ছে তাওবাহ এবং ইস্তেগফার সম্বলিত। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “গোনাহ হতে তাওবাহকারী ওই ব্যক্তির মতো যার কোনোই গোনাহ নেই।” (সূনানে ইবনে মাজাহ : তাওবাহ অধ্যায়) সুতরাং মাকবুল হজ আদায়কারীর অতীত জীবনের যাবতীয় অপরাধই ক্ষমা করা হয়।
যদিও তাওবাহ সব স্থানেই গোনাহ মাফের কারণ হতে পারে। এর জন্য কা’বা শরীফ ও আরাফাতের কোনোই নির্ধারিত নিয়ম নেই। কিন্তু হজের নিদর্শনাবলী, মাকামাত এবং আরকানগুলোর স্বকীয় প্রভাবের দরুন এমন কিছু উপকারিতার পথ সুগম হয়, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই স্থানগুলো সত্যিকার তওবাহর জন্য সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। একজন মুসলমানের অন্তরে এই স্থানগুলোর পবিত্রতা, মর্তবা ও শ্রেষ্ঠত্বের যে প্রভাব কার্যকরী রয়েছে, তা তাদের অন্তরে গভীর থেকে গভীরতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ওই সকল স্থান যেখানে আম্বিয়ায়ে কেরামের ওপর রহমত ও বরকতের এবং আনওয়ারে ইলাহীর বর্ষণ হয়েছে, সেই পরিবেশে, সেই স্থানে, সেই পরিমÐলে সকল গোনাহগারদের একত্রিত হয়ে দোয়া করা, রোনাজারী করা, ফরিয়াদ ও কান্নাকাটি করা এবং প্রতিটি কদমে নবুয়তের দৃশ্যাবলী ও ঐশী নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করে দোয়া ও মোনাজাত করার সাথে তা কবুল হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করা যায় এবং যে সকল স্থানে আল্লাহপাকের পিয়ারা বান্দাহগণ অসংখ্য নাজ ও নিয়ামত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। এ সকল স্থান প্রকৃতই পাপী-তাপী মানুষের আশ্রয় লাভের উত্তম আশ্রয়স্থল।
হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.) যেখানে নিজেদের গোনাহ মাফের জন্য দোয়া করেছিলেন, যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) নিজের জন্য এবং স্বীয় আওলাদ-ফরজন্দের জন্য দোয়া করেছিলেন, যেখানে হযরত হুদ (আ.) ও হযরত সালেহ (আ.) নিজেদের কাওম বরবাদ হওয়ার পর আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং যেখানে অন্যান্য পয়গাম্বরগণও দোয়া করেছেন, সে সকল স্থান, সে সকল মোকাম প্রত্যক্ষ করে দোয়া করা এবং দোয়ার জন্য যে সকল আরকান তারা পালন করেছেন, তা আমাদের মতো গোনাহগারদের ক্ষমা ও মার্জনা লাভের জন্য কতখানি উপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাছাড়া মানুষের অন্তর অধিকাংশ সময় পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয় এবং এতে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নির্দিষ্ট সময়ে ওই সকল স্মৃতিময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হওয়া এবং নতুনরূপে সেগুলোকে প্রত্যক্ষ করার ফলে কঠিন হতে কঠিনতর অন্তরও মোমের মতো বিগলিত হয় এবং যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এতে করেই অলক্ষ্যে বর্ষিত হয় তাদের ওপর করুণার অজ¯্র বিন্দু, যা প্রকৃতই আরশে ইলাহীর অফুরন্ত ক্ষমার ভাÐার বিস্তৃত ও অবারিত করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এ সকল পুণ্য স্মৃতিবহ স্থানগুলোতে রহমত ও বরকতের বারিবিন্দু প্রতিনিয়ত তাই বর্ষিত হতে থাকে অজ¯্র ধারায়।
মানুষের মনোবিজ্ঞান হচ্ছে এই যে, সে জীবনে কোনও বড় পরিবর্তন ও গতিময়তার জন্য সর্বদাই একটা প্রাপ্ত প্রাচীরের তালাশে ব্যাপৃত থাকে। মানুষের দৈনন্দিন কাজের ও চিন্তা-চেতনার অভিজ্ঞতা এ কথারই সাক্ষ্য প্রদান করে। যে প্রাপ্ত প্রাচীরের দ্বারে পৌঁছে তার অতীত জীবনের ও ভবিষ্যৎ জীবনের দুটি পৃথক অংশ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ জন্য মানুষ এই পরিবর্তনের প্রত্যাশায় শীত, গ্রীষ্ম বর্ষার এন্তেজার করে।
অনেক লোক বিয়ের পর কিংবা সন্তানের জনক হওয়ার পর, অথবা শিক্ষা সমাপনের পর অথবা চাকরির পর, অথবা কোনও বিরাট সফলতা অথবা কোনও খাসবৃহৎ ঘটনা এবং বিদেশ ভ্রমণের পর কিংবা কারও নিকট মুরিদ হওয়ার পর বদলে যায়, কিংবা নিজেকে বদলে নিতে সক্ষম হয়। কেননা তার জীবনের এ সকল বিশেষ ঘটনাবলী ও জীবনেতিহাস তার আগের এবং পেছনের জীবনের সাথে পৃথকীকরণ প্রাচীরের রেখা অঙ্কন করে দেয়। সেখান হতে সে এদিকে কিংবা ওদিকে গমনাগমন করতে পারে। হজ মূলত মানব জীবনের মাঝে একটি পৃথিকীকরণ প্রাচীরের কাজ দেয়। এর ফলে সংস্কার ও পরিবর্তনের দিকে নিজের জীবনকে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ এনে দেয়। এই প্রান্ত-সীমা হতেই মানুষ তার অতীত জীবন যা-ই হোক না কেন, তা পরিহার করে পরবর্তী সময়ের জন্য নতুন জীবন পথ চলা আরম্ভ করতে পারে এবং ওই মাকামগুলোতে দাঁড়িয়ে ও উপস্থিত হয়ে, যেখানে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আল্লাহর প্রিয় পাত্রগণ দাঁড়িয়ে আল্লাহর গৃহের সামনে কিবলার দিকে মুখ করে যা তার নামাজসমূহের, ঈমান ও বিশ্বাসের এবং মোনাজাতসমূহের গায়েবানা মোনাজাতের দিক, নিজের অতীত জীবনের ত্রæটিসমূহের ওপর লজ্জিত হয়ে এবং নিজের গোনাহসমূহের স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করতে পারে এবং আগামীতে আনুগত্য ও ফরমাবরদারীর অঙ্গীকার করতে পারে। এই স্বীকৃতি ও অঙ্গীকার এমন এক প্রভাব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে যে, সে মন্দ হতে ভালোর দিকে এবং ভালো হতে অধিকতর মঙ্গলের দিকে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এতে করে তার জীবনের অতীত গতি-পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং নতুন প্রবেশ-পথ উন্মোচিত হয়। বরং এ বক্তব্যকে এভাবে বলা যায় যে, সে এরপর নতুন কর্মকাÐের জন্য নতুনভাবে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে এবং নতুন দিকদর্শনের আলোকে পথ চলার উদ্যম লাভে সক্ষম হয়। এর প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেই নূরনবী রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ আদায় করল এবং সে সময় খাহেশাতে নফসানীর পায়রবী করল না, গোনাহের কাজ করল না, সে এমনভাবে প্রত্যাবর্তন করে, যেমন ওই দিনে ছিল, যেদিন তার মায়ের কোলে সে আগমন করেছে।” (সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিজী, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজাহ) অর্থাৎ সে এক নতুন জীবন, নতুন জিন্দেগী এবং এক নতুন অধ্যায় রচনা করে। যেখানে দুনিয়া আখেরাত উভয় দিকের মঙ্গল নিহিত থাকে এবং উভয় জগতের সফলতা সম্পৃক্ত থাকে। এই দর্শন ও অভিজ্ঞানের বর্ণনা কোরআনুল কারীমের ওই সকল আয়াতে বিধৃত আছে যার মাঝে হজের বিধিনিষেধ ও হুকুম-আহকাম পাওয়া যায় এবং যেগুলোর শেষ আয়াতসমূহ তাওয়াফের দোয়ার সর্বশেষ অংশবিশেষ। ইরশাদ হচ্ছে : “তারপর তাওয়াফের জন্য ওই স্থান হতে অগ্রসর হও, যেখান থেকে অন্যান্য লোকজন অগ্রসর হয় এবং নিজের গোনাহের জন্য আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অবশ্যই আল্লাহপাক ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।
এবং যখন হজের সকল হুকুম ও আরকান আদায় করবে, তখন আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা বাপ-দাদাদের কথা স্মরণ কর, কিংবা এর চেয়েও বেশি। সুতরাং কোনো কোনো লোক হজের দোয়াতে বলে, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে বরকত দান করুন, সুতরাং তার জন্য আখেরাতে কোনো অংশই থাকবে না। তবে কোনো কোনো লোক এমনও আছে, যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে ও আখেরাতে মঙ্গল প্রদান করুন। তাহলে আমি তাদেরকে দোজখের আজাব হতে মুক্তি দেব এবং তারাই ওই লোক যারা নিজেদের কর্মকাÐের অংশ লাভ করবে এবং আল্লাহ সকল কর্মকাÐের হিসাব দ্রæত গ্রহণকারী।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫) এ ছাড়াও হজের ছোট ছোট নৈতিক সংস্কারসমূহ রয়েছে। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই :
১। হজের মাধ্যমে মানুষ তার যাবতীয় জিম্মাদারির অবস্থা অনুভব করতে পারে। হজ তখনই ফরজ হয়, যখন পরিবার-পরিজনদের প্রয়োজনীয় খরচ-পত্রের পর কিছু অংশ উদ্বত্ত থাকে এবং হজ ওই ব্যক্তিই আদায় করতে পারে যিনি এই উদ্বৃত্তাংশ হতে প্রকৃতই মুক্ত ও অমুখাপেক্ষী। এ জন্য মোয়ামালাত বা ব্যবহারিক জীবনে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিপুলভাবে দেখা দেয়। সাধারণ ব্যবহারিক কায়-কারবারে এবং জাগতিক কর্মকাÐে মানুষ নিজের অসংখ্য দুশমন সৃষ্টি করে। কিন্তু যখনই আল্লাহর বারগাহে প্রত্যাবর্তন করার ইচ্ছা করে, তখন সবকিছু থেকে বিমুক্ত ও নির্মল হয়ে ফিরে যেতে চায়। এ জন্য বিদায়ের বেলা সকল প্রকার শত্রæতা ও ঘৃণা হতে নিজের অন্তরকে পাক-সাফ করে নেয়। মানুষের নিকট হতে নিজের ত্রæটি ও অপরাধসমূহ ক্ষমা করিয়ে দেয়। যারা বিরূপ ও অসন্তুষ্ট হয়ে আছে, তাদের মনোতুষ্টির ব্যবস্থা করে এবং ঋণ দানকারীদের ঋণ আদায় করে। এদিক থেকে হজের মাঝে পরস্পর ব্যবহারিক নৈতিক এবং রূহানী সংস্কারের কথাও প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
২। সমতা হলো ইসলামের ভিত্তি প্রস্তর। সাম্য মৈত্রীর মধুর বন্ধনে ইসলামী জীবন প্রকৃতই গৌরবান্বিত ও মহিমামÐিত। কিন্তু যদিও নামাজ সীমিতগÐির মাঝে এই সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করে কিন্তু পরিপূর্ণ বিস্তৃতির সাথে এর মৌলিক প্রদর্শনী হজের সময়েই শুরু হয়। যখন আমির ও গরিব জাহেল ও আলেম, বাদশাহ এবং প্রজা একই সুরতে একই ময়দানে, একইভাবে আল্লাহর সামনে দÐায়মান হয়। এতে কারও জন্য স্থানের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে না, এমনকি আগে-পিছের শর্তও আরোপিত হয় না।
৩। বহু নৈতিক সৌন্দর্যের প্র¯্রবণ হচ্ছে হালাল রুজি অর্জন করা। যেহেতু প্রত্যেক মানুষ হজের ব্যয় নির্বাহের প্রাক্কালে হালাল মাল-সম্পদ খরচ করার প্রচেষ্টা করে, এ জন্য স্বয়ং তাকে হালাল হারামের পার্থক্য নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এতে করে এর যে প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব মানুষের রূহানী অবস্থার ওপর পতিত হয়, তা খুবই সুস্পষ্ট।
মোটকথা, হজ ইসলামের একটি ধর্মীয় রোকনই নয়; বরং তা হচ্ছে নৈতিক, সামাজিক অর্থনৈেিতক, রাজনৈতিক অর্থাৎ জাতীয় জীবনের প্রত্যেক দিক এবং প্রত্যেক অংশকে পরিব্যাপ্তকারী এবং মধুর পরশে মুসলমানদের মাঝে গড়ে উঠেছে বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রাণবন্ত রূপ এবং বিশ্বজনীন সহমর্মিতার সুউচ্চ মিনার। যে মিনারায় দাঁড়িয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান করে বিশ্ব নিয়ন্তার তরফ হতে এ ঘোষণাই জারি করা হয় যে, ‘মুক্তি ও নিষ্কৃতির মহিমামÐিত কার্যক্রম এ হজের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।