পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা : শনিবারের হামলায় নিহত বেড়ে ৬ : আইএসের দায় স্বীকার : হামলা নয়, বোমাটি আগেই পোঁতা ছিল -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : ‘জঙ্গিদের নিউট্রলাইজ করা না পর্যন্ত অভিযান চলবে’ : মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা শাহানাদের আতঙ্ক কাটেনি : প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান দুই ওসির পরিবার
উমর ফারুক আলহাদী, সিলেট থেকে : সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’-এ টানা তিনদিনের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ‘আতিয়া মহল’-এ আরও জঙ্গির অবস্থান এবং বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক মজুদ রয়েছে- এমন আশঙ্কায় অভিযান চলমান রাখা হবে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।
তিনি গতকাল বিকেলে প্রেসব্রিফিংয়ে বলেন, ‘পুরো ভবনটিতে আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) রেখে জঙ্গিরা ঝুঁকিপূর্ণ করে রাখায় সতর্কতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তাই অভিযান শেষ হতে আরও সময় লাগবে। অভিযান শেষ হয়নি। জঙ্গিদের নিউট্রলাইজ না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে।’
দুই জঙ্গির মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দুই জঙ্গি দৌড়াদৌড়ি করার সময় আমাদের প্যারা-কমান্ডোরা তাদের গুলি করেছে। তারপর তাদের পড়ে থাকতে দেখা গেছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে।’
তিনি জানান, ভবন থেকে বাসিন্দাদের উদ্ধারের পর জঙ্গিরা ওই ভবনের ওপরে নিচে ওঠা-নামা করছে। কিন্তু তারা থাকছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। তাদের মধ্যে সুইসাইডাল ভেস্টও থাকতে পারে।
এদিকে জঙ্গি আস্তানার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আগের চেয়ে আরও বেশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি এবং নিরাপত্তার স্বার্থে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। মাইকিং করে এলাকাবাসীকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। মূল প্রবেশপথ ছাড়াও এলাকাভিত্তিক রাস্তাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে সাংবাদিকসহ অন্যদের অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই এলাকা থেকে দূরে থাকতে বলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখন ওই এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রেনেডের স্পিøন্টার সংগ্রহ করা হচ্ছে।
গতকাল রোববার সকাল ৭টার দিকে আতিয়া মহলের আশপাশে চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ওই এলাকার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও বাহন ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করছে না। এ ছাড়া একসঙ্গে তিনজনের বেশি লোকজন চলাচল করা যাবে না বলেও জানানো হয়েছে।
হুমায়ূন রশীদ চত্বর ও লালমাটিয়া এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের বন্ধ করে দেওয়া অংশে কয়েকটি শাখা সড়ক আছে। এই শাখা সড়কগুলোর মুখও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুসা বলেন, গত শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের দুটি স্থানে পৃথক বোমা হামলা হয়। এই ঘটনার পর থেকে সড়কটিতে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়।
শিববাড়ি এলাকার লোকজনকে ঘরের ভেতর বা নিরাপদ জায়গায় থাকতে মাইকিং করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। কি হচ্ছে তা জানতে অনেকে কৌতূহলবশত ঘরের বাইরে বের হয়ে যেতে পারে, তাই এ মাইকিং করা হচ্ছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া শনিবার রাতের দুই দফা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার প্রসঙ্গে বলেন, এ ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত চলছে। তদন্তের স্বার্থে এ বিস্ফোরণে কারা জড়িত থাকতে পারে সে সম্পর্কে কিছুই বলা যাচ্ছে না। আইএস এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। ‘আমাক’ নামক জঙ্গি ওয়েবসাইটে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সেটি কোন হামলা ছিল না, বোমাটি আগে থেকেই পুঁতে রাখা ছিল।
‘আতিয়া মহলে’ জঙ্গি আস্তানাকে ঘিরে অভিযান শুরুর পর থেকে ওই এলাকায় উৎসাহী মানুষজন ভিড় করলেও শনিবার রাতের বোমা বিস্ফোরণে ৬ জন লোক নিহত হওয়ার পর গতকাল রোববার থেকে অতি-উৎসাহী, উৎসুক মানুষের সংখ্যা কমে এসেছে।
নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার জানাযা সম্পন্ন
জঙ্গি দমন অভিযান চলাকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় জোড়া বোমা বিস্ফোরণে নিহত জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও সিলেট মহানগর পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মোহাম্মদ কয়সরের জানাজা সম্পন্ন হয়েছে।
গতকাল রোববার বাদ জোহর নগরীর রিকাবি বাজারের পুলিশ লাইন মাঠে তাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় সহকর্মীদের মাঝে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জানাযা শেষে নিহতদের লাশ নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার জানাজায় মানুষের ঢল নামে। সাধারণ জনগণ ছাড়াও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন।
পুলিশ লাইন জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মো. সিরাজুল ইসলাম এই দুই কর্মকর্তার জানাজা পড়ান। এর আগে দুই কর্মকর্তার পুলিশ জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা তুলে ধরেন পুলিশ কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম।
পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানোর পর মনিরুল ইসলামের পক্ষে তার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম শামীম এবং মোহাম্মদ কয়সরের পক্ষে তার মামা আব্দুল ওয়াদুদ লাশ গ্রহণ করেন।
জানাযা শেষে মনিরুল ইসলামের লাশ নোয়াখালীর উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
অন্যদিকে আবু কয়সরের লাশ তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে নিয়ে যান তার স্বজনরা।
প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান দুই ওসির পরিবার
দেশের জনগণের সেবা করতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দেয়া দুই পুলিশ কর্মকর্তার (ওসি) পরিবারের এই দুর্যোগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্য কামনা করেছেন উভয় পরিবারের সদস্যরা।
জানাযার প্রাক্কালে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের পক্ষে তার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম শামীম এবং মোহাম্মদ কয়সরের পক্ষে তার মামা আব্দুল ওয়াদুদ বক্তব্য রাখেন। এসময় এই দুই পরিবারের সদস্যরা বলেন, ‘আমরা এই ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদের নিরসন চাই।’ এছাড়া দোষী ও পেছনের হোতাদের অচিরেই বের করে এই হত্যাকাÐের বিচার চান তারা।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা শাহানাদের আতঙ্ক কাটেনি
দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ‘আতিয়া মহল’সহ দুটি ভবনে ৩০ ঘণ্টার বেশি আটকে থাকা ৭৮ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধারের পর গতকাল তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
শনিবার সকাল ৯টায় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরুর পর ওই জঙ্গি আস্তানায় জিম্মি হয়ে পড়া ৭৮ জনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে সেনাবাহিনী। অভিযানকালে তারা চারতলা ও পাঁচতলা দুই ভবনে আটকা পড়েছিলেন। তাদের উদ্ধারের পর পাশের একটি ভবনে দিনভর নিরাপদে রাখা হয়। মুক্ত হওয়ার পর গতকাল কথা হয় তাদের কয়েকজনের সঙ্গে।
এদের একজন শাহানা আক্তার। পেশায় তিনি ব্যাংকার। ছিলেন পাঁচতলা ভবনটির দ্বিতীয় তলায়। শাহানাদের একতলা নিচেই জঙ্গি আস্তানা, যার কারণে অন্যদের থেকে বেশিই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন-বলছেন এই ব্যাংকার।
তিনি বলেন, ‘শুক্রবার ভোররাতে বিকট শব্দে ঘুম ভাঙার পর আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। পরে হ্যান্ড মাইকে পুলিশ ভবনে জঙ্গি আস্তানা জানিয়ে সবাইকে নিরাপদে থাকতে নির্দেশনা দেয়। নিচেই জঙ্গি আস্তানা জানার পর আরও আতঙ্কে ছিলাম।’
জঙ্গি আস্তানাটি ঘিরে রাখার পর ওই দুই ভবন ও আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় আতঙ্কের মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি অবরুদ্ধ থাকার পর শনিবার সেনা অভিযানে উদ্ধার হয়ে ‘নতুন জীবন’ পেয়েছেন বলে মনে করছেন শাহানা।
একই মালিকের ওই দুই ভবনে একটির নিচ তলায় এক জঙ্গি দম্পতি রয়েছে, ধারণা থেকে বৃহস্পতিবার ভোররাতে প্রথম অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরপর যায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং সোয়াট; সবশেষে অভিযানের নেতৃত্ব নেয় সেনাবাহিনী।
সোয়াট শুরুতে এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। কিন্তু সেনাবাহিনী নেতৃত্ব নেয়ার পর অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।
ওই দুই বাড়ির মধ্যে পাঁচতলা ভবনটিতে ৩০টি ফ্ল্যাটে সমানসংখ্যক পরিবারের বসবাস। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যে বাকি পরিবারগুলো হয়ে পড়েছিল কার্যত জিম্মি।
পাঁচতলা ভবনটির তৃতীয় তলায় বসবাস করা উজ্জ্বল চক্রবর্তী বলেন, ‘শুক্রবার সকালে হঠাৎ বোমার বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে, জানতে পারি ভবনে জঙ্গি রয়েছে। দুই দিন অবরুদ্ধ ছিলাম, বিদ্যুৎ-গ্যাস ছিল না।’
এদিকে জঙ্গিদের বোমা হামলায় প্রবাসী অধ্যুষিত এ শান্তির জনপদের সবখানেই এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ। মহানগরের দক্ষিণসুরমার শিববাড়ি জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ জঙ্গিদমন অভিযান চলাকালে শনিবার রাতে দু’দফায় বোমা হামলায় পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হওয়ার পর এ আতঙ্ক সবাইকে কাবু করে ফেলে। শুধু সিলেটেই নয়, এ আতঙ্কে উদ্বিগ্ন বিশ্বের বিভিন্নস্থানে অবস্থানরত সিলেটীরা। তারা প্রতিমুহূর্তেই সিলেটে অবস্থানরত স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে খবর নিচ্ছেন।
গতকাল রোববারও কয়েক দফা থেমে থেমে গুলি ও বেশ কয়েকটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তবে, এদিন কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এদিন সকালে আটকেপড়া ‘আতিয়া মহল’ থেকে এক বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বোমা হামলায় নিহত ছয়জনের লাশ গতকাল রোববার বিকেলে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া নিহত পুলিশের দুই পরিদর্শকের জানাযার নামাজ সিলেট পুলিশ লাইন মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড় আহতদের দেখতে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ছিল স্বজন ও উৎসুক জনতার ভীড়। জোড়া বিস্ফোরণে পুলিশসহ ছয়জন নিহত হওয়ার পর শিববাড়ি থেকে নগরীর কদমতলী পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। এছাড়া মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তবে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ অব্যাহত রয়েছে। সেনাকমান্ডো, সোয়াট, র্যাব, পুলিশ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনতার উৎকণ্ঠা। তবে ‘অপারেশন টোয়ালাইট’ সফলে বিলম্বের বেশ কয়েকটি কারণ ইতোমধ্যে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আতিয়া মহলে প্রবেশের প্রতিটি গেটে শক্তিশালী বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছে জঙ্গিরা। এছাড়া ভবনের নিচে বাঙ্কারে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও গোলাবারুদসহ বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অবস্থান করছে জঙ্গিরা।
ফলে ভবনের ভেতরে ঢুকতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গিরা গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত ১০টি গ্রেনেড ও ৫ থেকে ৬টি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সিলেটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান প্রতিহত করতে জঙ্গিরা ভয়াবহ কৌশল নিয়েছে। একদল জঙ্গি আস্তনায়, আরেকদল বাইরে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে জঙ্গিরা উৎসুক জনতার মধ্যে ঢুকে দুই দফা হামলা চালিয়েছে।
এছাড়া জঙ্গিদের পরিকল্পনা ছিল সোয়াটসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আক্রমণ করলে তারা বাইরে থেকে আক্রমণ করবে। এই এলাকার আশপাশে আরও জঙ্গিদের অবস্থান রয়েছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিত হয়েছে।
পুলিশ জানায়, এই অভিযান কখন শেষ হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানে না তারা। লোকালয়ে জঙ্গিদের এমন শক্তিশালী অবস্থান ভাবিয়ে তুলেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। জঙ্গিদের মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালেও তারা আত্মসমর্পণ করেনি।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হাসান জানান, সেনা কমান্ডোরা চেষ্টা করছেন জঙ্গিদের জীবিত অবস্থায় গ্রেফতার করতে।
তিনি বলেন, জঙ্গিরা বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ জমা করেছিল। তারা বিস্ফোরক দিয়ে কমান্ডোদের প্রবেশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। এ জন্য অপারেশনটি অনেক সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হচ্ছে। জঙ্গিদের জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তাই অনেক সময় লাগছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ধারণা করা হচ্ছে আতিয়া মহলের নিচতলার বাঙ্কারে ৫-৭ জন জঙ্গি থাকতে পারে। অভিযানে অংশ নেয়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গতকাল রোববার সকাল ১০টার পর থেকে দুপুর বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এর মধ্যে অন্তত তিনটি বিস্ফোরণ খুবই শক্তিশালী।
ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সকাল ১০টা ১মিনিট, ১০টা ৭মিনিট ও ১১টা ৪৩ মিনিটে শক্তিশালী তিনটি বোমার বিস্ফোরণ হয় আতিয়া মহল ও আশপাশে। এর মধ্যে শেষ বিস্ফোরণটি ছিল খুবই শক্তিশালী। বিস্ফোরণের পর গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বিস্ফোরণের পর আতিয়া মহলের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে ভবনটি কিছুটা হেলে পড়েছে।
গতকাল সকালে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. গোলাম কিবরিয়া শনিবারের হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের দেখতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, জঙ্গি আস্তানার অভিযানস্থলের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ধরনের গাফিলতি ছিল না। যে যার মতো চেষ্টা করে গেছেন। পুলিশ সব সময় সতর্ক ছিলো।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি। যে যার কাজ করেছি। শনিবারের ঘটনার পর সিলেট নগরীতে নিরাপত্তা ও তল্লাশি চৌকি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান মহানগর পুলিশ কমিশনার।
হামলার ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ পরিদর্শকের ময়নাতদন্তের পর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বেলা ২টার দিকে রিকাবীবাজারস্থ পুলিশ লাইন মাঠে বোমায় নিহত দুই পুলিশ পরির্দশকের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নিহতদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে লাশ পাঠিয়ে দেয়া হয়।
শনিবার রাত ১২টা ১মিনিট থেকে পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত দক্ষিণ সুরমার হুমায়ূন রশীদ চত্বর, সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক, পাড়াইরচক থেকে পীর হবিবুর রহমান চত্বর পর্যন্ত সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এদিকে জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’ থেকে উদ্ধার করা ৭৮ জনকে রোববার সকালে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহলে দুই দিন ধরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামের এ অভিযান পরিচালনা করছে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার পাঠানপাড়া সড়কের পাশে অবস্থিত পাঁচতলা বিশিষ্ট দুটি ভবনের নাম ‘আতিয়া মহল’। সিলেট নগরের আতিয়া ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির বান্দরঘাটের বাসিন্দা সাবেক সরকারি কর্মচারী উস্তার মিয়া ওই ভবনের মালিক।
এই বাড়িতে জঙ্গিরা আস্তানা করেছে এমন সন্দেহে গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় থেকে বাড়িটি ঘিরে রাখে পুলিশ। শুক্রবার দিনভর পুলিশ, সোয়াট ও সেনা সদস্যরা বাড়িটিকে ঘিরে রাখেন। এসময় হ্যান্ডমাইকে করে বার বার সন্দেহভাজন জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহŸান জানানো হয়। তবে এতে সাড়া মিলেনি।
অবশেষে বাড়িটি ঘিরে রাখার প্রায় ত্রিশ ঘন্টা পর শনিবার সকালে চূড়ান্ত অভিযান ‘টোয়াইলাইট’ শুরু করেন সেনা সদস্যরা।
‘আতিয়া মহলে’ তিনদিন না খেয়ে ছিলেন বৃদ্ধা:
জঙ্গি আস্তনা ‘আতিয়া মহলের’ পাশের চারতলা ভবন থেকে অসুস্থ এক বৃদ্ধাকে উদ্ধার করেছেন সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা।
তিন দিন পর রোববার বেলা সোয়া ১১টার দিকে আতিয়া মহলের পাঁচতলা ভবনের লাগোয়া চারতলা ভবনের চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে নব্বইয়োর্ধ জোসনা রাণী রায়কে উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়া নারী অসুস্থ থাকায় তাকে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের চতুর্থ তলার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন তিনি। জোসনা রাণী সাংবাদিকদের জানান, শুক্রবার থেকে চা ছাড়া আর কিছুই খাননি তিনি। জোসনা রাণী তার ছেলে ও ছেলের বউয়ের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন। ছেলে ও ছেলের বউ বেড়াতে যাওয়ায় ফ্ল্যাটে তিনি একা ছিলেন।
জোসনা রানীর ছেলে সুরঞ্জিত ঘোষ জানান, বৃহস্পতিবার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ায় ফ্লাটে তার মা একা ছিলেন। কিন্তু পরদিন থেকে অভিযান শুরু হওয়ায় তারা আর ফ্লাটে ঢুকতে পারেননি। সেনাবাহিনী ওই এলাকা ঘিরে রাখায় ভয়ে মায়ের অবস্থান বিষয়ে কাউকে বলতেও সাহস করেননি বলে জানান সুরঞ্জিত ঘোষ। শনিবার বন্ধু ইকবালকে ফ্লাটে মায়ের অবস্থানের বিষয়টি জানালে তিনি রাতে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মুসাকে অবহিত করেন। এরপর তিনি জোসনা রানীকে উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। এরই অংশ হিসেবে গতকাল সকালে সেনাবাহীনির একটি দল জোসনা রানীকে ওই ভবন থেকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
ওসমানী হাসপাতালে জোসনা রাণীকে চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তার জানান, জোসনা রাণী আশঙ্কামুক্ত। তবে দীর্ঘক্ষণ না খাওয়ার কারণে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাকে কয়েকটা পরীক্ষা করানো হচ্ছে।
জোসনা রানী আশংকামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে দীর্ঘ সময় খাবার গ্রহণ না করায় তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
এর আগে শনিবার আতিয়া মহলে অবরুদ্ধ ৭৮ জনকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছিল সেনাবাহিনী।
জঙ্গিদের শক্তিশালী ঘাঁটি:
সিলেট মহানগর পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ধারণার চেয়ে জঙ্গিদের শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে ‘আতিয়া মহলে’। টানা চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের আটক বা আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি সেনাবাহিনী। তবে তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শুরুতে দুজন জঙ্গির কথা ধারণা করা হলেও ভেতরে থাকা জঙ্গির সংখ্যা বেশি হতে পারে বলেই এখন ধারণা করা হচ্ছে। শনিবার ও রোববার দফায় দফায় তারা অভিযান দলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একাধিক শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, ওই জঙ্গি আস্তানায় সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়ে সন্ধ্যায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। এর অল্প সময় পরই আতিয়া মহল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পাঠানপাড়ায় অবস্থান নেওয়া কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় বাইরে থেকে মোটরসাইকেলে আসা অজ্ঞাত দুই জঙ্গি। এর কিছুক্ষণ পর অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেড সরাতে গিয়ে সেটির বিস্ফোরণ ঘটে।
দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
‘আতিয়া মহল’-এ অভিযান যেভাবে:
সিলেটের দক্ষিণসুরমার শিববাড়ি এলাকার ‘আতিয়া মহল’ নামের দু’টি বাড়ির একটির নিচতলায় এক জঙ্গি দম্পতি রয়েছে- এ ধারণা থেকে পুলিশ অভিযান শুরু করেছিল বৃহস্পতিবার রাতে। এরপর যায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং সোয়াট; সবশেষে অভিযানের নেতৃত্ব নেয় সেনাবাহিনী। এ সময় হ্যান্ড মাইকে করে বারবার সন্দেহভাজন জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। তবে এতে সাড়া মেলেনি। র্যাব-পুলিশ প্রায় ৩০ ঘণ্টা ঘিরে রাখার পর শনিবার সকাল ৯টায় শুরু হয় সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অভিযান। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উপস্থিত সংবাদকর্মীসহ সবাইকে এক কিলোমিটার দূরে সরে যেতে বলা হয়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল বলেন, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ঘটনাটি দেখে সোয়াটকে ডেকেছিল, সোয়াট এসে দেখে এ অভিযান চালানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়।
সোয়াট শুরুতে এ অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। কিন্তু সেনাবাহিনী নেতৃত্ব নেওয়ার পর অভিযানের নাম বদলে হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল কায়েস।
তখন আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশেদুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন টোয়াইলাইট পরিচালনা করছে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন।
শনিবার দুপুর ২টার আগ পর্যন্ত দুবার গুলির শব্দ পাওয়া গেলেও এরপর মুহুর্মুহু গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল ভেতর থেকে। বেলা ২টার পর পরই দুটি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এরপর পৌনে এক ঘণ্টায় অন্তত ছয়বার বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়।
ঘণ্টা দুয়েক বিরতি দিয়ে বিকাল ৫টায় আবার দুটি বোমার শব্দ পাওয়া যায়। এরপর শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলি, যা ৫টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত চলে। গুলি ও বোমার শব্দ থেমে যাওয়ার পর ব্রিফিংয়ে আসেন সেনাকর্মকর্তা ফখরুল আহসান।
তিনি বলেন, ভেতরে থাকা জঙ্গিরাই এই আইইডি (ই¤েপ্রাভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণ ঘটায়।
ভবনে কতজন জঙ্গি আছে? সাংবাদিকদের প্রশ্নে ব্রিগেডিয়ার আহসান বলেন, তারা ভবনের ওপর-নিচ করছে। অর্থাৎ জঙ্গিরা একটি তলায় থাকছে না, স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন তলায় থাকছে।
অভিযান রাতেও চলবে কিনা প্রশ্ন করা হলে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, সেটি অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কমান্ডারই ঠিক করবেন। বেলা আড়াইটার দিকে তিন সেনাসদস্যকে আহত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। বেলা ২টায় মুহুর্মুহু গুলি-বোমার আওয়াজ শোনার আগে অ্যাম্বুলেন্সটি পুলিশ বেষ্টনী অতিক্রম করে ভেতরে ঢোকানো হয়েছিল।
টানটান উত্তেজনার মধ্যে এক দিন ও এক রাত পার করে বৃষ্টির মধ্যে শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর এ চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয়। ফায়ার ব্রিগেডের দুটি গাড়ি রাতেই ঘটনাস্থলে এনে রাখা হয়। সকালে সাঁজোয়া যান ও অ্যাম্বুলেন্সও আসে।
অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানান, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টার মধ্যে তিন দফায় দ্বিতীয়তলা থেকে পঞ্চমতলা পর্যন্ত অবরুদ্ধ বাসিন্দাদের সবাইকে উদ্ধার করা হয়। ভবনটির একটি ফ্ল্যাটে এ মুহূর্তে জঙ্গিরা ছাড়া কোনো বাসিন্দা নেই বলে শনিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ‘আতিয়া মহলে’ অভিযানে অংশ নেওয়া একাধিক সেনাসদস্য সাংবাদিকদের জানান।
রোববার সকাল নয়টা ৫৭ মিনিট, ১০টা ৭ মিনিট, ১১টা ৪৩ মিনিট ও সর্বশেষ বেলা দুইটা ৪১ মিনিটে শক্তিশালী চারটি বোমার বিস্ফোরণ হয় আতিয়া মহল ও আশপাশে; এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ বিস্ফোরণটি ছিল খুবই শক্তিশালী। বিস্ফোরণের পর গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
১১টা ৪৩ মিনিটের বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলের কাছাকাছি এলাকায় থাকা পুলিশের এক সদস্য বলেন, বিস্ফোরণের পর আতিয়া মহলের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে ভবনটি কিছুটা হেলে পড়ে।
রোববার সকাল ১০টার দিকে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া শনিবারের হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের দেখতে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন।
সিলেট মহানগর পুলিশের প্রধান গোলাম কিবরিয়া আরও বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি। যে যার কাজ করেছি। শনিবারের ঘটনার পর সিলেট নগরীতে নিরাপত্তা ও তল্লাশিচৌকি বাড়ানো হয়েছে। হামলার ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ পরিদর্শকের ময়নাতদন্তের পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’
প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতর তারা:
জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসা চলছে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাদের একজন বিপ্লব পাল। তিনি পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
গতকাল রোববার দুপুরে ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন বিপ্লবের পা দুটো ব্যান্ডজে মোড়ানো। তিনি জানালেন, ‘তার পায়ে কোনো শক্তি নেই, তবে আছে প্রচন্ড যন্ত্রণা।’
তাঁর বিছানার পাশে বসে আছেন তাঁর বোন অর্পণা পাল। কী থেকে কী হয়ে গেল, তা-ই নিয়ে দুই ভাইবোন অঝরে কাঁদছিলেন।
বিপ্লব বললেন, তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখায়। তিনি চিড়া, মুড়ির মোয়া তৈরি করে বিক্রি করেন। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক দিয়ে বাড়ি যেতে হয় তাঁকে। হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে রওনা হয়ে একটু সামনে গিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আটকে যান তিনি। এরপরও ফাঁক দিয়ে শিববাড়ি পার হওয়ার কথা ভাবতে থাকেন তিনি। কারণ, একটু এগিয়ে গেলেই বাড়ি যাওয়ার গাড়ি পাবেন। ভাবনামতো হেঁটে রওনা হতে না হতেই সন্ধ্যার দিকে বিস্ফোরণ হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যান। অন্যরা উদ্ধার করে তাঁকে হাসপাতালে নেয়।
শুধু বিপ্লবই নন, এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন নাজিম, রাসেল, ওয়াহিদুল, ইসলাম আহমেদ পাপ্পু, হোসেন, আবদুর রহিম, মামুন, রহিম, মোস্তাক, ফারুক মিয়া ও সালাহউদ্দিন। সবাই বোমায় আঘাতপ্রাপ্ত। সবার হাতে, পা, বুকে ব্যান্ডেজ মোড়ানো। সবাই যে বাকরুদ্ধ। কথা বলতে চাচ্ছেন না। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।
সিলেটে নিহত মোট ৬
সিলেটে জঙ্গি বিরোধী অভিযান স্থলের কাছে বোমা বিস্ফোরণে আরও একজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ নতুন করে আহত দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এরা হলেন জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম এবং ছাত্রলীগের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা শাখার উপ-পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফাহিম। বোমা বিস্ফোরণে আহত হয়ে তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রাত আড়াইটায় জালালাবাদ থানায় যোগাযোগ করা হলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা জানান, মনিরুল ইসলাম রাত ১টা ৫০ মিনিটে ওসমানী মেডিকেলে মারা গেছেন। সিলেট মহানগর পুলিশের কন্ট্রোল রুম থেকে রাত আড়াইটায় জানানো হয়েছে মনিরুল ইসলাম ও জান্নাতুল ফাহিমসহ এ পর্যন্ত মোট ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।
‘হামলার দায়’ স্বীকার করলো আইএস
সিলেটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লক্ষ্য করে ‘বোমা বিস্ফোরণের দায়’ স্বীকার করেছে কথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস। ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে আইএস এ দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে আইএস-এর বার্তা সংস্থা হিসেবে পরিচিত ‘আমাক’। এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় বিমানবন্দরের বাইরের সড়কে পুলিশ চেকপোস্টের কাছে বোমা বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর একইভাবে আইএস-র পক্ষ থেকে সেটিকে ‘আত্মঘাতী হামলা’ দাবি করে দায় স্বীকারের খবর এসেছিলো।
হামলা নয়, বোমাটি আগে থেকেই ছিল : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
তবে সিলেটে হামলা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিবিসিকে বলেছেন, ‘লক্ষ্য করে কোনও হামলা হয়নি’। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেটে যে বোমা বিস্ফোরণে পুলিশের দু’জন কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন, সেটি আগে থেকে পেতে রাখা ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘সেটি কোনো হামলা ছিল না’। তিনি বলছিলেন, বৃহস্পতিবার রাতে যখন শিববাড়ির ওই সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানাটি নিরাপত্তা বাহিনী ঘেরাও করে ফেলে, তখনই বোধহয় কোনো একসময় এখানে আশপাশে তারা বোমাটি রেখে গিয়েছিল বা আগেই রেখে গিয়েছিল।
‘পুলিশরা যখন দেখেছে, তখনই এটা বিস্ফোরিত হয়েছে, ধাক্কা-ধোক্কা খেয়ে’, বলছিলেন জনাব খান। গত শনিবার সন্ধ্যাবেলা আলোচিত ‘আতিয়া মহল’ নামের ভবনটিতে চলমান কমান্ডো অভিযান সম্পর্কে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফ দেয়ার কিছু পরেই সেখান থেকে কাছেই একটি জায়গায় বিস্ফোরণটি হয়। এ বিস্ফোরণে বহু মানুষ আহত হয়। নিহত হন দুজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং চারজন ‘উৎসুক’ জনতা।
এ ঘটনায় র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আবুল কালাম আজাদ গুরুতর আহত হন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেবার আগ পর্যন্ত একটি ধারণা ছিল, একদল হামলাকারী অতর্কিতে এসে বোমা হামলাটি চালায়। ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বিস্ফোরণের সময় একজন মোটরসাইকেল আরোহীর আগমণের বিবরণও পাওয়া যায়।
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বর্ণনায়, ‘এটি লক্ষ্য করে কোনও হামলা নয়’।
তবে বিস্ফোরণটি ঘটবার কারণ সম্পর্কে জনাব খান বলেন, ‘কীভাবে হয়েছে এটা আমরা এখনো ঠিক জানি না। তদন্ত শেষে বলতে পারবো বিস্ফোরণ কীভাবে হয়েছে এবং বোমাটা কিভাবে আসলো’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।