বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. আহমদ আবদুল কাদের : পাশ্চাত্য সভ্যতা বলতেই লোকেরা মনে করে এ সভ্যতা গণতন্ত্রের জন্মদাতা, মানবাধিকারের প্রবক্তা, সহনশীলতার লীলাকেন্দ্র আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎগাতা। এ চিত্র মহৎ, সুন্দর। সাধারণত লোকেরা এটাই বিশ^াস করে। আর পশ্চিমা পা-িত্য ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলো এটাই আমাদেরকে শিখিয়েছে। প্রাচ্যের লোকেরা এটাই মেনে নিয়েছে। যা কিছু পাশ্চাত্যের তাই মানবিক, মহৎ আর বিজ্ঞানসম্মত। আর যা কিছু প্রাচ্যের, তা-ই কুসংস্কার, অমানবিক, সংকীর্ণতা এবং অবৈজ্ঞানিক। আমাদের মনমগজে এ ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে আছে।
নিঃসন্দেহে বর্তমানে পশ্চিমা জগতে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর মানবাধিকার আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব চর্চা আছে। কিন্তু এটাই তার আসল রূপ নয়, তার ভিত্তিও নয়। পশ্চিমা সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রবল লোভ আর লালসার ওপর, ঘৃণা আর তীব্র বর্ণবাদী মানসিকতা আর গোটা পৃথিবীটাকে করায়ত্ত করার প্রবল আকাক্সক্ষার ওপর। আর নির্বিচারে মানুষকে হত্যা, খুন, অপহরণ আর অমানুষিক নির্যাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাদের সভ্যতা। ইতিহাস তার সাক্ষী।
আধুনিক যুগে ইউরোপ জন্ম দিয়েছে বেশ কয়টি সা¤্রাজ্যের বা উপনিবেশিক শক্তির। স্পেনীয় সা¤্রাজ্য, পর্তুগীজ সা¤্রাজ্য, ফরাসী সা¤্রাজ্য, বৃটিশ সা¤্রাজ্য, জার্মান নাজী সা¤্রাজ্য, কমিউনিস্ট রুশ সা¤্রাজ্য, ইতালীয় সা¤্রাজ্য, ডাচ সা¤্রাজ্য ইত্যাদি। ইউরোপের প্রতিটি সা¤্রাজ্যের হাত রঞ্জিত হয়ে আছে অগণিত মানুষের রক্তে। তাদের অতীত চেহারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের কালো স্মৃতিতে। তাদের লোভী বর্ণবাদী মনের চাহিদা মেটাতে কত যে মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। বস্তুত এক কালো অন্ধকার ইতিহাস তাড়া করে ফিরে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে। যতই গণতন্ত্র আর মানবতার ফেরি করুক না কেন তার মসিলিপ্ত অতীতকে মুছা যাবে না, ভুলা যাবে না। ইতিহাস তার সমস্ত অমানবিক অপকর্মের সাক্ষী। কয়েকটি দেশের কিছু উদাহরণ তুলে ধরলেই তা সবার কাছে স্পষ্ট হবে।
স্পেনীয় উপনিবেশিক শক্তিকৃত অপরাধ : ১৪৯২ থেকে ১৮৯২ পর্যন্ত চারশো বছর ধরে স্পেন উপনিবেশবাদী-সা¤্রাজ্যবাদী তৎপরতা চালিয়েছে। এই সুদীর্ঘ সময়ে দক্ষিণ আমেরিকায় সা¤্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটায়। এর মধ্যে টেনোসটিটল্যান্ডে প্রায় ২০ লাখ আজটেক জনগোষ্ঠির লোকেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বাকি ৩০ লক্ষ মানুষ স্পেনীয় দ্বারা আনিত বিভিন্ন ধরনের রোগের বিশেষত গুটি বসন্তের সংক্রমণের দ্বারা মারা যায়।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্যতম ঘৃণ্য উদাহরণ হচ্ছে স্পেনে ধর্মীয় আদালত প্রতিষ্ঠা ও তার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের ওপর নির্যাতন চালানো। ১৪৯২ সালে স্পেনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলা সর্বপ্রথম স্পেনের হাজার হাজার ইহুদী ও মুসলিমদেরকে জোর করে খ্রিস্টান বানানোর উদ্যোগ নেয়। তাদের স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো : “হয় খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করো নতুবা স্পেন ছাড়ো।” তখন লক্ষ লক্ষ মুসলমান ও অনেক ইহুদী স্পেন ছেড়ে পালিয়ে যায়Ñ তারা আশ্রয় নেয় মুসলিম শাসিত উত্তর আফ্রিকায়। সব লোকতো সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশ ত্যাগ করতে সক্ষম ছিলো না। কাজেই কয়েক লক্ষ লোক বাহ্যত খ্রিস্টান হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করলো। কিন্তু এ অসহায় লোকগুলো খ্রিস্টান হওয়ার ঘোষণা দেয়ার পরও কিন্তু নিরাপদে থাকতে পারেনি। তাদেরকে শুক্রবারে ঘরের দরজা খোলা রাখতে বাধ্য করা হয় যাতে জানা যায় যে সেদিন তারা অজুগোসল করে জুম্মাহর নামাজ পড়ছে কি না। রমজানের সময় তাদেরকে দুপুরের খাওয়ার সময় দরজা উন্মুক্ত রাখতে হতো যাতে বুঝা যায় যে তারা রান্না করছে কি না, খাচ্ছে কি না। এমনকি তাদের ঘরে কোন আরবী লিখা পেলে সন্দেহ করা হতো যে এগুলো কোরআন হাদিসের অংশ। তাই তাদেরকে গ্রেফতার করা হতো এবং নির্যাতন চালানো হতো। উল্লেখিত নব্য খ্রিস্টানদের ধর্ম বিশ^াস পরীক্ষা করার জন্য বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে হাজার হাজার লোকের ওপর নির্যাতন চলে, অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়। এরপর শুরু হয় স্বজাতির ভিন্ন মতাবলম্বীর ধর্ম বিশ^াস পরীক্ষার করার পালা। এ সময়ের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ লোককে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন চালানো হয়। প্রায় তিন সহ¯্রাধীক মানুষকে গোড়া ক্যাথলিক ধর্মবিশ^াসের কিছুটা ব্যত্যয় ঘটার কারণে অপরাধী সাব্যস্থ করে নির্মম শাস্তি প্রদান করা হয়। নির্যাতন চালানোর জন্য যে সমস্ত পদ্ধতি সচরাচর ব্যবহার করা হতো তার অন্যতম ছিলো মাথা চূর্ণকারী যন্ত্র ‘হেড- ক্রাশার’ এবং হাঁটু ও পায়ের হাড় ভেঙে দেয়ার যন্ত্র ‘নী-স্লিটার’।
হেড ক্রাশার হচ্ছে এমন একটি ধাতব টুপি যা মাথার উপর বসানো হতো। এরপর টুপিটিকে স্ক্রু দিয়ে ক্রমাগতভাবে শক্ত করে চেপে ধরা হতো যতক্ষণ না মাথার খুলি চূর্ণ হয়ে যেতো। আর নী-স্লিটার হলো সুতিক্ষè আংটা লাগানো একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে হাঁটু ও পায়ের হাড়কে ভেঙে দেয়া হতো যাতে সে আর হাঁটতে না পারে। এসব যন্ত্র ব্যবহার করেই প্রোটেস্টান ধর্মবিশ^াসীদের শাস্তি দেয়া হতো। ভিন্ন মতাবলম্বী ধর্মবিশ^াসীদেরকে এমন লোমহর্ষক নির্যাতনের কোন নজির আধুনিক যুগে অন্যকোন ধর্মে দেখা যায় না।
পর্তুগীজ উপনিবেশিক ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির মানবতা বিরোধী অপরাধ : তাদের ব্যাপ্তিকাল হচ্ছে ১৪১৫ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো বছর। উপনিবেশিক যুগের প্রথম দিকে তারা সারা দুনিয়ায় ক্যাথলিক খ্রিস্ট ধর্ম প্রসার ও সবাইকে এ ধর্মে দীক্ষিত করার লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করে। তৎসঙ্গে তারা বিভিন্ন দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করার পদক্ষেপ নেয়। অন্যদের জমি কেড়ে নেয়া, সমুদ্রে জলদস্যুতা করা, মানুষকে নির্বিচারে হত্যা-খুন করাসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যে তারা করেনি। তাদের মুনাফার লোভ আর লালসার কাছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হলো। তারাই প্রথম আফ্রিকা থেকে দাস ব্যবসার চালু করে। এর মাধ্যমে প্রায় ৫৫ লক্ষ আফ্রিকার মানুষকে আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাচার করে। তারা আমাদের দেশে দুর্ধর্ষ জলদস্যু হিসাবে পরিচিত। তারা ভারতের গোয়া অঞ্চলে ধর্ম বিশ^াস পরীক্ষার জন্য আদালত স্থাপন করে হিন্দু মুসলমান বহু লোকের ওপর নির্যাতন চালায়। এক কথায় পর্তুগীজরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার অপরাধে অপরাধী।
ফরাসী উপনিবেশ ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ : এর সময়কাল হচ্ছে ১৫৩৪Ñ১৯৮০ পর্যন্ত প্রায় চারশো বছর। এই চারশো বছরে ফরাসীরা আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়াতে সা¤্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। বিশেষত নেপোলিয়ানের অধীন ফরাসী কলোনী হাইতিতে নিকৃষ্টতম ঘটনাটি ঘটে। সেখানে দ্বীপটি থেকে চিনির কাঁচা মাল আখ সংগ্রহের জন্য ক্ষুধার্ত দাসদের বাধ্য করা হয়। দাসরা যাতে আখ খেতে না পারে তার জন্য মুখে লাগাম পরানো হয়। এরপরও যারা পালিয়ে যেতো বা অবাধ্য হতো তাদেরকে কাউকে আগুনে দিয়ে কাবাব বানানো হতো, কারোর শরীরে বারুদ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেহ ছিন্ন ভিন্ন করা হতো, কারো হাত পা কেটে ফেলা হতো আরো কত কি? প্রায় ১ লাখের মতো হাইতিবাসীকে হত্যা করা হয়। জাহাজের খোলে সালফার ডাই অক্সাইড দিয়ে মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই সালফার ডাই অক্সাইড হাইতির আগ্নেয়গিরি থেকে সংগ্রহ করা হতো। যারা বিদ্রোহ করতো তাদেরকে কুকুর দিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করা হতো। কুকুর দ্বারা ছিন্ন ভিন্ন করার দৃশ্য প্রকাশ্যে থিয়েটার মঞ্চে প্রদর্শন করা হতো যাতে বিদ্রোহ করতে কেউ সাহস না পায়।
বেলজীয় উপনিবেশিক শক্তির অপরাধ(১৮৮৫Ñ১৯৬২) : বেলজিয়ামের উপনিবেশিক কাল হচ্ছে মাত্র ৭৭ বছর। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত সময়ে পাশবিকতার দিক থেকে অনেক উপনিবেশকেই তারা হার মানিয়েছে। বেলজীয় রাজা ২য় লিওপোল্ড কঙ্গো দখল করে সেখানকার জনগণকে দাস বানিয়ে নেয়। রাবার ও আইভরি যোগান দেয়ার জন্য পাশবিকভাবে দেশটির ওপর শোষণ ও নির্যাতন চালানো হয়। মাত্র ৫০ বছরে নির্যাতনে প্রায় এক কোটি লোক মারা যায়। লিওপোল্ড মুনাফার লোভে ফোর্স পাবলিক নামক এক ভীতিপ্রদ সেনাবাহিনী গঠন ও ব্যবহার করেন যাতে করে গ্রামবাসীরা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হয়। রাবার ও আইভরির কাঁচামাল সংগ্রহের কোটা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হতো, অনেককে অপহরণ করে নিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হতো। কঙ্গোর মহিলাদের ওপর ধর্ষণসহ নানা ধরনের অকথ্য যৌন নির্যাতন চালাতো। তাদের উপনিবেশিক ডিভাইড এ্যান্ড রুল পলিসির কারণেই কঙ্গোর প্রতিবেশী হুতি সম্প্রদায়কে বর্ণগতভাবে নিকৃষ্ট মনে করা হতো। যার ফলে ১৯৯০-এর দশকে রুয়ান্ডার গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৮ লক্ষ মানুষ নিহত হয়।
বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদের মানবতার বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ : এই সা¤্রাজ্যের ব্যাপ্তিকাল হচ্ছে ১৫৮৩-১৯৯৭ পর্যন্ত চারশো বছরেরও বেশি। এ সময়ের মধ্যে বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তি এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ও ইউরোপের প্রায় ১৫ কোটি মানুষকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়। আঠারো শতকের শেষার্ধে তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষত বাংলায় দখলদারিত্ব লাভ করে। বৃটিশপূর্ব ভারত বিশেষত বাংলা ছিলো খাদ্যে উদ্বৃত্ত। কিন্তু বৃটিশরা বাংলার দেওয়ানী লাভ করেই সেখান থেকে খাদ্য নিয়ে নিজ দেশে গুদামজাত করে রাখে। ভূমির ফসলের ওপর বৃটিশ পূর্ব সময়ের চেয়ে ৫গুণ বেশি কর ধার্য করা হয়। তৎসঙ্গে কৃষকদের সতর্কতামূলক ফসল সংরক্ষণ করা নিষিদ্ধ করা হয়। নীল চাষ ও আফিং চাষে কৃষকদের বাধ্য করা হয়। ফলে কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। তদুপরি অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। শুরু হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সরকারি কোন সাহায্য না পেয়ে বাংলার সাধারণ মানুষ ঘাস ও মৃত মানুষের মাংস খেতে বাধ্য হয়। এ দুর্ভিক্ষে বাংলার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মারা যায়। বৃটিশ শাসনের ১৯০ বছরে ভারতবর্ষের বিভিন্œ অঞ্চলে পনেরটির মতো বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হয়। এতে প্রায় ৫ কোটি ৬০লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বৃটিশরা আমেরিকা (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) শাসন করে। শুধু শাসনই তারা করেনি বরং স্থানীয় লোকদের উৎখাত করে তারা বৃটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাদা চামড়ার লোকদের বসতির ব্যবস্থা করে। তাদের অত্যাচারের কারণে আদিবাসী আমেরিকানরা ধ্বংস হয়ে যায়। কলম্বাস পূর্ব অর্থাৎ প্রায় ছয়শো বছর আগে উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের সংখ্যা ছিলো সর্বনি¤œ ২১ লক্ষ আর সর্বোচ্চ ১ কোটি ৮০ লক্ষ আর ২০১০ সালের আদম শুমারীতে সেখানে আদিবাসীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯ লক্ষ ৩২ হাজার। শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার, অনাচার, জবরদখল, ইউরোপের বিভিন্ন রোগব্যাধি রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, আদিবাসীদের ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন যুদ্ধ ইত্যাদির কারণে আমেরিকার আদিবাসীরা ও তাদের সভ্যতা আমেরিকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সোভিয়েত সা¤্রাজ্যের নির্দয়তার রেকর্ড (১৯২২Ñ১৯৮৯) : পৃথিবীর ইতিহাসে সোভিয়েত সা¤্রাজ্যের মতো এতটা নির্দয় রাষ্ট্র পৃথিবীতে খুব একটা দেখা যায়নি। সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের সময়ে প্রায় দু’কোটি ৭০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাইবেরিয়ায় শ্রম শিবিরেÑ গোলাগে পাঠানো হয়। সেখানে বন্দিদের বাধ্যতামূলক শ্রমদান, ভুখা থাকতে বাধ্য করা ও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদ- দেয়া হতো। যাদেরকে বিশ^াসঘাতকতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হতো তাদেরকে নানা লোমহর্ষক পন্থায় তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো। লোম হর্ষক পন্থার অন্যতম ছিলো’ ইঁদুর নির্যাতন’ পদ্ধতি। রক্ষীরা বন্দিদের উলঙ্গ করে একটা ইঁদুরের খাঁচার সঙ্গে তার তলপেটের সঙ্গে আটকে দেয়া হতো। খাঁচাটি গরম করলে ইঁদুরগুলো গরম থেকে বাঁচার জন্য বন্দিদের তলপেটে ছিদ্র করে গভীরে প্রবেশ করতে চাইতো। এতে বন্দিদের অমানসিক যন্ত্রণা ও কষ্ট হতো।
সরকার দেশের সমস্ত কৃষি জমি কেড়ে নেয়ার হুকুম জারি করে। স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা জমি দিতে অস্বীকার করে। তখন স্ট্যালিন সরকার পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে কৃষকদের সরকারি নির্দেশের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য করে। দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়, সমস্ত শস্যাদি জব্দ করা হয়। ফলে ৭০ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়। এসবকে অনেকে কমিউনিস্ট নির্যাতন বলে আখ্যায়িত করেন অথচ দুঃখী মানুষের মুক্তির কথা বলে তারা ক্ষমতা দখল করেছিলো আর ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্র চালাতে ব্যর্থ হয়ে তারা অত্যাচারকেই ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার পন্থা হিসাবে গ্রহণ করে।
নাজী জার্মানী ভয়াবহ অপরাধ(১৯২৮Ñ১৯৪৫): নাজী জার্মানী মাত্র দেড় দশকে ষাট লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করে। ২০ হাজার শ্রম শিবির স্থাপন করে। প্রতিদিন ছয়হাজার মানুষকে শ্রম শিবির থেকে গ্যস চেম্বারে পাঠানো হতো যেখানে শাওয়ার রূমে গ্যাস ছেড়ে দেয়া হতো। ফলে মিনিটখানেক সময়ের মধ্যে মানুষ মারা যেত। সরকারি রক্ষীরা তখন তার দেহ থেকে চুল ও অলংকার (থাকলে) সরিয়ে ফেলতো। চুল দ্বারা রশি তৈরি করা হতো, স্বর্ণ ব্যাংকে জমা রাখা হতো। জার্মান চিকিৎসা ক্যাম্পে ভয়াবহ মানব পরীক্ষা চালানো হতো। বন্দিদেরকে হিমশীতল পানিতে কয়েক ঘণ্টা ধরে ডুবিয়ে রাখা হতো যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মরে ফ্রিজ হয়ে যেত। বন্দিদের দেহে যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার জীবাণু ইনজেকশন দিয়ে ঢুকানো হোত। তাছাড়া এনেস্থেশিয়া ছাড়াই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংস্থাপন করতো।
উপরে ইউরোপের বিভিন্ন উপনিবেশবাদী সা¤্রাজ্যবাদী কয়েকটি দেশের কিছু অপকীর্তি তুলে ধরা হয়েছে। এসব থেকে এটি স্পষ্ট যে মানবতাবিরোধী অপরাধে ইউরোপ অপরাধী। তারা কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ। তারা আমেরিকার আদিবাসী জনগণ ও তাদের সভ্যতা বিধ্বংসকারী। শুধু অতীতেই নয় বরং এখন পর্যন্ত তাদের অনেকের মধ্যে ঘৃণ্য বর্ণবাদী মানসিকতা ও আচরণ বর্তমান। তারা এখনও দ্বৈত চরিত্র নিয়ে দুনিয়ার সঙ্গে আচরণ করছে। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে দু’দু’ বিশ^^ যুদ্ধ বাধিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় ছয় কোটির উপরে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। তাদের ঘৃণ্য ভূমিকায় মানবজাতি জর্জরিত, আতংকিত, পিষ্ট। পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে তাদের বন্ধু হচ্ছে তারা যারা জনগণের বিরাগভাজন, তাদের স্বার্থ বিসর্জনকারী; যারা স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংসকারী। জনগণের কথা বলে নিজেরাই জনগণের প্রভু হয়ে বসেছে। কেউ সর্বহারার একনায়কত্বের কথা বলে সর্বহারার দ-মু-ের কর্তা হয়ে বসেছে। কেউ শোষিতের গণতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে লাগাতার শোষণ করে যাচ্ছে। তাদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা নিছক লোক দেখানো। তারা আন্তর্জাতিকভাবে যেসব তত্ত্বের ফেরি করছে তাতে মানবজাতির কোন কল্যাণ নেই। তাই মানব জাতিকে নতুন পথ খুঁজতে হবেÑ যে পথ তাদের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত অগ্রগতির নিশ্চয়তা দেবে।
লেখক : মহাসচিব, খেলাফতে মজলিস
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।