Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপরাধ সাম্রাজ্যের আলোচিত এক পরিবারের গল্প

সিন্ডিকেট প্রধান সুমন পলাতক : বিদেশি মদ ও নগদ ৫৫ লাখ টাকা উদ্ধার

প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : নাম তার ওয়াসিম আহমেদ সুমন (৪০)। ঢাকার গুলশানে ইতালীয়ান এক বারের ওয়েটার। মাসে বেতন মাত্র ১২ হাজার টাকা। চলেন বিলাসবহুল গাড়ি দিয়ে। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সারাক্ষণ আমোদ-ফুর্তিতে থাকেন। এলাকার অনেকেই তাকে ‘প্লেবয়’ মনে করে। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, বিদেশি মদ, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ মাদক ও জাল টাকার ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর কদমতলী থানার ১৫৩নং মাদ্রাসা রোডের বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব। উদ্ধার করে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মদ, মদ বিক্রির নগদ ৫৫ লাখ টাকা ও কয়েক লাখ টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা। গ্রেফতার করে চারজনকে। ওই সময় মাদক ব্যবসা সিন্ডিকেটের হোতা সুমন ওই বাড়িতে না থাকায় তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি র‌্যাব।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কদমতলীর মুরাদপুর এলাকায় অপরাধ সাম্রাজ্যের ‘আলোচিত পরিবার’ বলে খ্যাত সুমনের পরিবারের উত্থান অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমে। ২০০৭ সালে সুমনের ভাই সোহেল অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জামসহ র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে। ঢাকার জজ আদালতে জালজালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ধরা পড়ে সুমনের আপন ফুপাতো ভাই পেশকার মোসলেহ উদ্দিন। বর্তমানে তিনি কারাগারে। সুমনের স্ত্রী মিষ্টির বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা মামলা। সাত মাস কারাগারে থাকার পর সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। রাজধানীর কাফরুলে বাচ্চু নামে এক ব্যবসায়ীকে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নিহত বাচ্চুর ল্যাপটপ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। বাচ্চুর সাথে অবৈধ সম্পর্কের সূত্রধরে পুলিশ সুমনের স্ত্রী মিষ্টিকে গ্রেফতার করে। সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল পরকীয়া প্রেমের জের ধরে সুমনের স্ত্রী মিষ্টি বাচ্চুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। জামিনে মুক্ত মিষ্টি এখন থাকে সুমনের খিলগাঁওয়ের বাড়িতে। সুমনের আরেক ফুফাতো ভাই সাইফুল ওরফে বেঙ্গু সাইফুল চোরাই ক্যাবলের ব্যবসা করে। নকল ক্যাবলের কারখানাও আছে তার। সুমনের সেকেন্ড ইন কমান্ড টুন্ডা আলতাফের স্ত্রী ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েকদিন জেল খেটেছে। ভাতিজা সাদ্দাম সুমনের গাড়ি চালক। মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত সব ধরণের গোপন কাজে এই সাদ্দামকে ব্যবহার করতো সুমন।
মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাদ্রাসা রোডের ১৫৩নম্বর বাড়িটি সুমনদের পৈতৃক বাড়ি। এক তলা হলেও বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত এ বাড়িকেই রঙ্গমঞ্চ ও অবৈধ ব্যবসার মূলকেন্দ্র বানিয়েছিল সুমন।
এলাকাবাসী জানায়, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পরই এ বাড়িতে বহিরাগতদের আনাগোনা শুরু হতো। রাত যতো বাড়তো মানুষও ততো বাড়তো। বাড়ির ভিতরে আলো-আঁধারি পরিবেশে জমে উঠতো নাচ, গান ও উন্মাদনা। বিদেশি নামীদামী যতো রকমের মদ আছে সবই পাওয়া যেতো এখানে। ফুর্তি করার জন্য মিরতো সুন্দরী নারীও। এছাড়া ইয়াবা, ফেনসিডিলতো আছেই। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব বিভিন্ন রকমের বিদেশি মদ উদ্ধার করে। এর মধ্যে জনি ওয়াকার, গোল্ড লেবেল, লন্ডনের স্কচ হুইস্কি, চিভাস রিজেল এজড, প্রিমিয়াম স্কচ হুইস্কি, স্কটল্যান্ডের স্কচ হুইস্কি, স্মিরিনঅফ গ্রিন এ্যপল ট্রিপল ডিসটিলড ভোতকা, পে লোপেজ হেকহোয়েন মেক্সিকো হুইস্কিসহ বিভিন্ন নামীদামী মদের বোতল ছিল। সবমিলে বিদেশি মদের পরিমাণ ২০ লিটার বলে র‌্যাব কদমতলী থানায় দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করেছে। একই সাথে মদ বিক্রিসহ মাদক ব্যবসার নগদ ৫৫ লাখ টাকাও জব্দ করে র‌্যাব। এর বাইরে ৬ হাজার এক শ’ ৪৬ ইউএস ডলার, ১৭৫ ইউরো, পাকিস্তনি ১ হাজার রুপিসহ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ইন্দোনেশিয়ান রুপি, ফিলিপাইনের পিসোসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করে র‌্যাব।
জানা গেছে, মুরাদপুরের ওই বাড়িতে অবৈধ ব্যবসার জন্য সুমন নিজের কর্মস্থল গুলশানের ইতালিয়ান বারকে উৎস হিসাবে ব্যবহার করতো। ওই বারে যারা আসতো তাদেরকে ফুর্তি করার জন্য সে মুরাদপুরের নির্জন বাড়িতে আসার প্রস্তাব দিতো। ঢাকার অভিজাত এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অপরাধী ও চোরাচালানীরা জুরাইনের নির্জন ওই বাড়িকে নিরাপদ মনে করতো। এভাবেই মাত্র কয়েক বছরে সুমন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। এ কাজে সুমনকে সহযোগী হিসাবে ছিল তার মামাতো, ফুপাতো বাইসহ ঘনিষ্ঠ কয়েক বন্ধু। এর মধ্যে বাঘা কামরুল ও সুজনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আশুলিয়া থানায়। সুমনের আরেক বন্ধু ডিপিডিসির প্রকৌশলী সাব্রী সাবেরিন জাহান সোহেল (৩৬) ও তার আত্মীয় শাকিল আহমেদ (২৫) গ্রেফতার হয়েছে সুমনের বাসা থেকে। এ দু’জনের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার দৌলতখান উপজেলায়। ডিপিডিসিতে চাকরি করার সুবাদে সোহেলকে ভিওআইপি ও নকল ব্যবসার কাজেও লাগাতো সুমন। এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুমনের বাড়িতে প্রতি রাতেও মদ ও ফুর্তির আসর বসলেও সুমন আসতো রাত ৯টার পর। সাথে গুলশান এলাকা থেকে দু’চারজন ভিআইপি গেস্টও থাকতো। রাতভর চলতো আমোদ-ফুর্তি। স্থানীয়রা সব কিছু জানলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতো না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, সুমনের কাছে অবৈধ অস্ত্র আছে একথা সবাই জানে। বাঘা কামরুল নামে এক পেশাদার সন্ত্রাসী সুমনের বাসায় থাকতো সব সময়। সে কারণে ভয়ে কেউ মুখ খুলতো না।
সুমনের বাড়ি থেকে চারজন গ্রেফতার,নগদ ৫৫ লাখ টাকাসহ বিদেশি মদ, মুদ্রা উদ্ধারের ঘটনায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কদমতলী থানায় মামলা (নং ৫০) হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত ওই মামলায় সুমনকে পলাতক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। জানতে চাইলে কদমতলী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, এ মামলার আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে। পলাতক আসামী সুমনকে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা চলছে। ওসি বলেন, শিগগিরি তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। স্থানীয়দের দাবি, সুমনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার অপরাধ সাম্রাজ্য সম্পর্কে আরও অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।



 

Show all comments
  • Nasim ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৫:০৭ এএম says : 0
    khujle arokom golpo aro pawa jabe
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধ সাম্রাজ্যের আলোচিত এক পরিবারের গল্প
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ