Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

দক্ষিণাঞ্চলে ছাত্র-যুবলীগের কারণে শান্তি-শৃঙ্খলা মারাত্মক হুমকিতে

প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা ঃ বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব এলাকাতেই শাসক জোটের মূল শরিক দলের নিয়ন্ত্রণহীন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনৈতিক কর্মকা-ে সমাজিক শান্তিÑশৃঙ্খলা মারাত্মক হুমকির মুখে। ইমেজ সংকটে শাসক জোটে মূল শরিক দল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাড়া-মহল্লা আর সরকারী অফিস আদালতে তাদের বেপরোয়া দৌরত্বে এখন শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সাথে টেন্ডার বাক্স দখল থেকে পর স্ত্রীকে প্রেম করতে বাধ্য করার মত ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে। পাশাপাশি বরিশাল মহানগরীতে গত কয়েকদিন ধরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একাধিক নেতার বাস ভবনে গভীর রাতে হামলা, ভাঙচুর, গুলিসহ বিকট শব্দের পটকা বিস্ফোরণের ঘটনায়ও শঙ্কিত সাধরণ মানুষ। তবে এর তেমন কোন প্রতিকারও লক্ষনীয় নয়।
অভিভাবকহীন বরিশালে আওয়ামী লীগে আছে নীরব ও স্বরব কোন্দল। আর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের বিভেদের ঢেউ এখন ছাত্রলীগ এবং যুবলীগসহ সব সহযোগী ও অঙ্গ-সংগঠনের মধ্যেও। ২০১৩-এর জুনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি শওকত হোসেন হিরন মেয়র পদে পরাজয়ের জন্য সরাসরি জেলা সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে দায়ী করে এনগরীর রাস্তায় বিক্ষোভ পর্যন্ত করেছন তার অনুসারীগণ। বিষয়টি নিয়ে তখন দলীয় শীর্ষ মহল অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বিভেদ কাটিয়ে সামনে এগুনোর কোন দিক-নির্দেশনা ছিল না।
জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সে বিভেদে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলেই আওয়ামী লীগ এখন অভিভাবকহীন। ‘আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ দুঃসময়ে দলের কান্ডারী থাকলেও সময়ের বিবর্তনে দলে নতুন আসা ভুঁইফোড় নেতারাই এখন সবকিছু পরিচালনা করছেন’, এ অভিযোগ সাধারণ নেতাকর্মীদের। এমনকি বরিশাল মহানগরীতে মূক্তিযুদ্ধবিরোধী সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী পরিবারের সদস্যরাও এখন জয় বাংলা বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর মহানগর এবং জেলার এ কোন্দলের সুবাদে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কতিপয় নেতা এখন নিয়ন্ত্রণহীন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকগণও তাদের কাছে অঘোষিতভাবে জিম্মি বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্রলীগ নেতার সাথে প্রেম করতে রাজি না হওয়ায় বরিশাল বিএম কলেজে এক বিবাহিতা ছাত্রী ও তার স্বামীকে প্রকাশ্যে মারধর করেছে নেতার সহযোগী ক্যাডাররা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী কলেজ ক্যাম্পাসে হামলার শিকার হন সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ™ি^তীয়বর্ষের ছাত্রী নুসরত আক্তার ও তার স্বামী কবির হোসেন। ঘটনার পরে নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক সদস্য এবং কলেজের কর্মচারীরা ছাত্রী ও তার স্বামীকে বাসায় পৌঁছে দেয়। কলেজের ছাত্রলীগ এক নেতা দীর্ঘদিন ধরেই নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে নুসরতের সাথে প্রেম করার চেষ্টা করছিল। এমনকি সে তার দুই সহযোগীকে প্রায়শই পাঠাতো ভয়ভীতি দেখাতে। বিবাহিতা বলার পরও রেহাই মেলেনি তার। এক পর্যায়ে নুসরত কলেজে আসা বন্ধও করে দেয়। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারী জরুরী কাজে স্বামীকে সাথে নিয়ে নুসরাত কলেজে আসলে ঐ নেতার সহযোগীরা দু’জনকেই অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে মারধর করে।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সাথে মঞ্চে বসতে না দেয়ায় বরিশাল ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি এম.এ মাসুদকে প্রকাশ্যে পিটিয়েছে এক ছাত্রলীগ নেতা। গত ১৭ ফেব্রুয়ারী সকালে নগরীর উত্তর মল্লিক রোডে মাসুদের ওপর এই হামলা চালানো হয়। হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতা সরকারী বরিশাল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আল-মামুন। গত ৩০ জানুয়ারী বরিশাল টাউন হলে বরিশাল ডিবেটিং সোসাইটির জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে মাসুদ। মন্ত্রীর গাড়ির সঙ্গে থাকা মোটর সাইকেল বহরে অনুষ্ঠানে যান আল-মামুনসহ ছাত্রলীগের আরো কয়েকজন নেতাকর্মী। তাদেরকে মঞ্চে বসতে না দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে এ হামলা চালান হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মাসুদকে অশ্লীল গালিগালাজের একপর্যায়ে চর-থাপ্পরও মারে আল-মামুন। এমনকি ভবিষ্যতে সে বরিশালে সোসাইটি’র অনুষ্ঠান করতে না দেবারও হুমকি দেয়। মারধর করে চলে যাবার সময় ছাত্রলীগ নেতা হামলাকারীর উদ্দেশে বলে, ‘তোর শিল্প মন্ত্রীকে গিয়ে বলবি আমি মারছি, সে যেন পারলে আমার কিছু করে’।
এদিকে বিএম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শংকর চন্দ্র দত্তকে মারধরের মামলায় ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মী ১৭ ফেব্রুয়ারী সকালে আদালত থেকে বেকসুর খালাস পাবার পরে বিকালেই ছাত্রলীগ নেতা মামুনের নেতেৃত্বে সরকারী বরিশাল কলেজে এক অধ্যাপককে মারধর করেছে। ঘটনার দিন সম্মান প্রথমবর্ষের পরীক্ষায় এক ছাত্রলীগ কর্মীকে বই দেখে লিখতে বাধা দেয়ায় অধ্যাপক কাজী নজরুল ইসলাম ঐ হামলার শিকার হন। সরকারী বরিশাল কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর অলিউল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সম্মান প্রথমবর্ষের পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করছিলেন উজিরপুর উপজেলার শহীদ স্মরনিকা কলেজের অধ্যাপক কাজী নজরুল ইসলাম। পরীক্ষা শেষ হবার ১৫ মিনিট আগে বিকাল পৌনে ৫টায় এক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে বই উদ্ধার করে তার উত্তরপত্র নিয়ে যান অধ্যাপক নজরুল। কিছুক্ষণ পরে তিনি আবার উত্তরপত্র ফেরত দেন।
এ খবর পেয়ে কয়েকজন সহযোগীসহ কলেজে ছুটে যান কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আল-মামুন। তিনি পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র টেনে নেবার জন্য শিক্ষক কাজী নজরুল ইসলামের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার এক পর্যায়ে তাকে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে থাকেন। সহযোগীকে উদ্ধার করতে গিয়ে অন্য শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হন। এতে সকল শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় কলেজ স্টাফ কাউন্সিলের জরুরী সভা করে আল-মামুনের ছাত্রত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
তবে ছাত্রলীগের কলেজ শাখা সভাপতি আল-মামুন শিক্ষককে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে বহিরাগতরা মারধর করেছে বলে দাবী করে। তিনি ঘটনার সময় কলেজে ছিলেন না বলেও জানিয়েছেন। তবে ঐ ঘটনার পরে মহানগর ছাত্র লীগ বরিশাল কলেজ শাখা ছাত্র লীগের সব কর্মকা- স্থগিত করে।
এদিকে গত ২১ ফেব্রুয়ারী রাতে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ানের বাসভবনে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের অপর একটি গ্রুপ। রাত পৌনে ১২টার দিকে নগরীর কাউনিয়া প্রথম গলিতে অসীম দেওয়ানের বাসায় ঐ হামলার সময় বেশ কিছু ককটেল ও হাত বোমার বিস্ফোরণসহ বাড়ীর জানালার কাঁচও ভাঙচুর করে সন্ত্রাসীরা। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। হামলাকারীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেছে বলেও দাবি অসীম দেওয়ানের। এঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা রইছ আহম্মেদ মান্না, কাজী জিয়াউদ্দিন, হ্যান্ড্রি, সুজন বিশ্বাস, অঞ্জন, ছোট সোহাগসহ ১২ জনের নামোল্লেখসহ ১৫/২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে কাউনিয়া থানায় মামলায় দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে বরিশাল মহানগর যুবলীগের আহবায়ক নিজামুল ইসলামের বাসায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হামলা হয়েছে। রাত ১২টার দিকে নগরীর ফকিরবাড়ী রোডে নিজামের বাস ভবনের গেটে কয়েকজন মোটর সাইকেল আরোহী বোমা হামলা চালায়। এসময় নিজামও তার লাইসেন্সকৃত শর্টগান থেকে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে ছুটে যায়। তবে এ ঘটনায় নিজামুল ইসলাম থানায় কোন মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেননি।
এভাবে একের পর এক ঘটনায় বরিশাল মহানগরীর শান্তিÑশৃঙ্খলা বিঘিœত হচ্ছে। আর এসব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সমাজে শান্তিÑশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতিটি ঘটনাতেই সরকারী দলের ছাত্র ও যুবলীগের এক গ্রুপ অপর গ্রুপের দিকে অংগুলি তুলছে। বিরোধী দলহীন দক্ষিণাঞ্চলের রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারী মহাজোট ছাড়া অন্য কোন দলের রাজনৈতিক চর্চার ওপর অনেক আগে থেকেই অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচীকে প- করছে। ফলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক তৎপরতার আড়ালে যা কিছু হচ্ছে সব কিছুর সাথেই সরকারী মহাজোটের কর্মকা-ই শেষ কথা। বরিশালের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সরকারী ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য গত ৭ বছর ধরে। এমনকি এসব কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হলেও সেখানে কথিত ৭ বছর ধরে অস্থায়ী ছাত্রকর্ম পরিষদ গঠন করে সরকারী দলের নেতাদের হাতে সব কিছু ছেড়ে দেয়ার পরে তারা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। সম্প্রতি একের পর এক অনৈতিক ঘটনার পরে বিএম কলেজে ঐ অস্থায়ী ছাত্র-কর্মপরিষদ বাতিল করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে কারো দাপট কমেনি।
মূলত বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে শাসক জোট ও মূল শরিক দল অনেকটা অভিভাবকহীন থাকায়ই সহযোগী ও অঙ্গ-সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন হিরন দু’বছর আগে ইন্তেকালের পরে সে পদ পূরণ হয়নি এখনো। পাশাপাশি জেলা কমিটির সাথে মহানগর নেতৃবৃন্দের দুরত্ব ও দন্ধ ইতোমধ্যে আরো বেড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দক্ষিণাঞ্চলে ছাত্র-যুবলীগের কারণে শান্তি-শৃঙ্খলা মারাত্মক হুমকিতে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ