বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এপ্রিলে ভারত সফর করবেন। এই সময়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কিছু চুক্তি সম্পাদনের কথা নিয়ে জনমনে কানাঘুষা চলছে। বাংলাদেশের জনগণ সঙ্গত কারণে প্রত্যাশা করেছিল যে, বাংলাদেশের জন্য ভারতের করা দ্বিতীয় বৃহত্তম মরণ ফাঁদ গজলডোবায় আটকে পড়া তিস্তার পানি ছাড় পাবে। কিন্তু হায়। প্রধানমন্ত্রী নাকি ভারতের সাথে চুক্তি করবেন তিস্তা নিয়ে নয়, সম্ভবত সামরিক বিষয় নিয়ে। তবে সামরিক চুক্তি আদৌ হবে কিনা বা হলেও কী ধরনের চুক্তি হবে সেটা পরিষ্কার নয়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। তবে কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের সাথে ছোট রাষ্ট্রের মধ্যে যে সামরিক চুক্তি হয় তা হয় সাধারণত তৃতীয় কোনো বৃহৎ শক্তির হাত থেকে ছোট রাষ্ট্রটির সুরক্ষার জন্য কিংবা বৃহৎ রাষ্ট্রটির কল্যাণ সাধনে ছোট রাষ্ট্রটিকে ছলেবলে কৌশলে ব্যবহার করার জন্য। প্রথম ধরনের সামরিক চুক্তির আলোকে দক্ষিণ কোরিয়া কমিউনিস্ট শক্তির আগ্রাসন থেকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রক্ষা পাচ্ছে। ন্যাটো সামরিক জোট গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে সোভিয়েত আক্রমণ বা আগ্রাসন থেকে সুরক্ষা দান করা।
১৯৭১ সালে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে এমন একটি চুক্তি করেছিল যার দ্বারা ভারত চীনের আক্রমণের আশঙ্কা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিল এবং একই কারণে দেশটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ধরনের সামরিক চুক্তির দ্বারা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি বৃহৎ রাষ্ট্রটির মূলত উপগ্রহে পরিণত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে বৃহৎ রাষ্ট্রটি তার সা¤্রাজ্য বিস্তারে বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের দমনের কাজে ব্যবহার করতে পারে। বিনিময়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জনগণ কিছুই পায় না। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা সরকার নিরুপদ্রপে দেশ শাসন করে যেতে পারে। ওয়ারস জোটের পূর্ব ইউরোপীয় ছোট ছোট দেশগুলো এই দ্বিতীয় ধরনের সামরিক চুক্তির দ্বারা বৃহৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হয়ে পড়ে। দেশীয় রাজ্যগুলো ব্রিটিশ শক্তির সাথে এ ধরনের সামরিক চুক্তি করে, ইতিহাসে যাকে বলা হয় অধীনতামূলক মিত্রতার চুক্তি। হায়দরাবাদের নিজাম চুক্তি অনুসারে তার রাজ্যে নিজ খরচে একদল ব্রিটিশ সৈন্য রাখতে বাধ্য হয়। অতঃপর ব্রিটিশ সৈন্য প্রতিপালনের বিশাল ব্যয় বহনের মূল্য স্বরূপ বেরার প্রদেশটি ব্রিটিশকে প্রদান করে। দেশীয় রাজ্যগুলো অধীনতামূলক মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশের চাপের কারণে।
ভারতের সাথে যদি বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি হয় তবে তা উপরে উল্লিখিত দুই ধরনের চুক্তির মধ্যে কোনটির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তা আলোচনা সাপেক্ষ। বাংলাদেশ ভারত দ্বারা প্রায় পরিবেষ্টিত। ভারত ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো বৃহৎ প্রতিবেশী না থাকায় ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে তার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় নেই। সুতরাং বাংলাদেশকে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের আক্রমণ ঠেকাতে ভারতের সাথে সামরিক চুক্তি করার প্রয়োজনও নেই। তবে বাংলাদেশের সাথে সামরিক চুক্তি করার প্রয়োজন ভারতের আছে তার নিজের স্বার্থে। সামরিক চুক্তি হলে ভারত বাংলাদেশে অস্ত্র বেচতে পারবে, চীনের মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূখÐ ব্যবহার করতে পারবে, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশের সহায়তা লাভ করতে পারবে এবং অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে কোনো যুদ্ধ বাঁধলে সে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ এবং কোনো গ্রæপকে ক্ষমতায় বসানোর বা ক্ষমতায় রাখার অঙ্গীকার দিয়ে হলেও সে একটি সামরিক চুক্তি করতে আগ্রহী থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভারতের সাথে সামরিক চুক্তি করাটা গোলামির চুক্তি বলে বিবেচিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশকে যদি কখনো সামরিক চুক্তি করতেই হয় তবে সেটি হবে এমন কোন দেশের সাথে যে দেশ বাংলাদেশকে তার প্রতিবেশীদের যে কোনো আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারবে এবং বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে উজানে বাঁধ নির্মাণের বিভীষিকা থেকে বাঁচাতে পারবে।
এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এপ্রিলের ভারত সফরের সময়ে ভারতের সাথে কোনো সামরিক চুক্তির মানে হলো জনগণকে এপ্রিল ফুল দেখানো। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণ চাইলে ভারতের সাথে সম্পর্ক রাখা এবং জনগণ না চাইলে কোনো সুসম্পর্ক না রাখা। তাই নিরপেক্ষভাবে জনমত যাচাই করে সে আলোক ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন করা প্রয়োজন। এতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়বে। সামরিক শাসক এরশাদ জোর করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু জনমতকে একেবারে না হারানোর কৌশল হিসেবে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করেছিলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিলেন, উপজেলা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন প্রভৃতি। কিন্তু তাতেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাই কোনো সরকারেরই উচিত নয় ধরাকে সরা জ্ঞান করে একের পর গণবিরোধী আইন প্রণয়ন করা বা রাষ্ট্রবিরোধী চুক্তি করা। কারণ সবাইকে একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চীন থেকে ২টি সাবমেরিন কিনেছে বলে ভারত নাখোশ। বাংলাদেশ নিজের স্বার্থে অবশ্যই আরও সাবমেরিন কিনবে। প্রয়োজনে তার প্রতিবেশীদের ন্যায় সর্বোচ্চ শক্তিরও অধিকারী হবে। এতে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। তাছাড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাবেন বাংলাদেশের এবং শুধু বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের জন্য, দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। তাই এই সফরে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার এজেন্ডা হওয়া উচিত তিস্তার পানি বণ্টন এবং অন্যান্য নদনদীর পানি বণ্টন নিয়ে। পদ্মা নদীতে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে এবং ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বন্ধ করা নিয়ে।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।