মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
ইফতেখার আহমেদ টিপু : রাজধানী ঢাকায় যাদের বসবাস তাদের নানা উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়। ঘর থেকে বের হলেই যানজট, কালো ধোঁয়া, রয়েছে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব। শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুতের লোডশেডিং, বর্ষায় রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকা, ড্রেন উপচেপড়া থেকে শুরু করে নানা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে মশার উৎপাত। তাতে কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা বাড়লেও আখেরে ক্ষতি হচ্ছে মানুষের। বাজারে পাওয়া যায় এমন মশানিধন সরঞ্জামের কারণে দীর্ঘমেয়াদে হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। মশানিধনের জন্য যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তাতে সঠিক মাত্রায় ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে যে মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় অ্যাকটিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। এছাড়া মশা মারার যেকোনো ওষুধে শরীরের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন কয়েলের ধোঁয়ায় নাক, গলা, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি ক্যান্সার হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
এমনিতেই ধুলাবালিতে রাজধানীবাসী অতিষ্ঠ। কিছু কিছু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বড় ধরনের নির্মাণকাজ চলছে। এসব এলাকার মানুষ অনেক দিন থেকেই ধুলার অত্যাচার সহ্য করছে। বর্ষা মৌসুম আসার আগেই কোনো কোনো এলাকায় ড্রেনের পানি উপচে পড়ে রাস্তায় চলাচল অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে মশার অত্যাচার। সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। আগে থেকেই ব্যবস্থা না নিলে বর্ষার জমে থাকা পানিতে মশার বংশবিস্তার ঘটবে। বর্ষা ও বর্ষাপরবর্তী সময়ে এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। দেখা দেয় ডেঙ্গু। এখনই মশার অত্যাচারে তিষ্ঠানো দায় হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার অত্যাচার কোন পর্যায়ে পৌঁছবে তা ভেবে আমাদের আতঙ্কিত হতে হয়। রাজধানীতে এমন কোনো জায়গা বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে মশার উপদ্রব নেই।
মশার অত্যাচার নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা উঠলেও জনজীবনে তার কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। মশানিধন অভিযান জোরদার হয়নি। বেড়েছে মশার ওষুধ নিয়ে ব্যবসা করে এমন প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য। দেশে ব্যবহৃত মশার ওষুধ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে তৈরি হচ্ছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। মশানিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা বাড়ালে ক্ষতিকর ওষুধের ব্যবহার কমবে।
রাজধানী ঢাকা দীর্ঘকাল ধরেই যানজটের নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। দুঃসহ যানজটে ক্রমেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে এই মেগাসিটি। দেড় কোটিরও বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বৃহত্তর ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যার তুলনায় সড়কের সংখ্যা কম। যানবাহনের সংখ্যাও মাত্রাতিরিক্ত। এর মধ্যে অযান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যাও বিপুল। দুনিয়ার কোনো মহানগরীতে এত বেশি অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের কথা কল্পনায় আনাও কঠিন। তবে অসহনীয় যানজটের কারণ হিসেবে যে সমস্যাগুলো বিষফোঁড়ার মতো বিরাজ করছে সে সমস্যাগুলো হলো যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের প্রবণতা।
যানজট দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছে। যানজটের কারণে যে সময়ক্ষেপণ ঘটছেÑ অর্থনীতির বিচারে তার ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ। এ সমস্যা উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশের রফতানি বাণিজ্যকে অনিশ্চিত করে তুলছে। বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজধানীকে অস্বস্তির দৃষ্টিতে দেখে যানজটের কারণে। বলা যেতে পারে, যেসব কারণে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বিঘি¥ত হচ্ছে যানজট তার অন্যতম।
রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে লোকসান আর ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঠিক কতটা অর্থনৈতিক লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, কতটা কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, মানুষ কতটা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে এ নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। কিন্তু কোনো কিছুতেই সফলতা আসছে না।
ঢাকার যানজট নিয়ে এত দুশ্চিন্তার পরও এ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ এখন পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। বরং দিন দিন আরো সংকুচিত হয়ে আসছে যানচলাচলের রাস্তা। প্রতিনিয়ত ঢাকার রাস্তায় নামছে প্রতিযোগিতা দিয়ে নতুন গাড়ি। একটি শহরে গাড়ি চলাচলের জন্য যেখানে ২৫ শতাংশ জায়গা থাকা দরকার, সেখানে মাত্র ৮ শতাংশ জায়গা রয়েছে ঢাকায়।
ভয়াবহ যানজট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। যানজটে এখন নাকাল নগরবাসী। সর্বনাশা যানজট দেড় কোটিরও বেশি মানুষের এ মহানগরীকে অচল বা স্থবির নগরীতে পরিণত করেছে বা করতে যাচ্ছে বললেও ভুল হবে না।
একটি শহরে রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত ২৫ শতাংশ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ শতাংশ। পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিলে ৮ ভাগ রাস্তা থাকার পরও ঢাকার যানজট নিরসন সম্ভব। ঢাকার চেয়ে কলকাতায় এক সময় যানজট ছিল বেশি। সেই কলকাতার যানজট এখন ঢাকার তুলনায় তুচ্ছ। আয়তনের তুলনায় লন্ডন-সিঙ্গাপুরেও রাস্তা কম। অথচ এ দুই নগরীতে দুঃসহ যানজট নেই। হংকংয়ের ৯০ শতাংশ লোক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে। ঢাকায় যানজটের পেছনে প্রধান কারণ যথাযথ নগর পরিচালন ব্যবস্থা না থাকা। ঢাকায় বিভিন্ন সময় রাজউক, ডেসা, ওয়াসা, ডেসকো হয়েছে। এগুলোর কাজ আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই। এগুলোর যথাযথ সমন্বয় দরকার। সবই আলাদাভাবে গড়ে ওঠায় এবং সমন্বয়হীনভাবে কাজ করায় কোনো লাভ হয়নি।
যানজট সমস্যার রাতারাতি কোনো সমাধান হবে না। সমাধান না হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার ঘনত্ব। ঢাকায় প্রতি একরে প্রায় ৫০০ জন লোক বাস করে। নিউইয়র্কে যেখানে ২৫-৩০ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকায় আরো বাড়ছে।
যানজটের জন্য মাত্রাতিরিক্ত অভিবাসনও দায়ী। দেশের প্রতিটি এলাকা থেকে রাজধানীতে প্রতিদিন মানুষ আসে কাজের খোঁজে। ঢাকা পুরোপুরি অর্থনীতিনির্ভর শহর হয়ে গেছে। সরকারের যেসব পরিকল্পনা, তাতে এ অভিবাসন ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর আইনের কথা যতই বলা হোক না কেন, সবকিছুরই সীমাবদ্ধতা আছে। যে কোনো পর্যায়েই যাওয়া হোক যানজট হবেই, যদি মানুষের সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে রাখা না যায়। এর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যে শহরে লোকসংখ্যা বেশি, সেখানে তিন ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। সারফেস, এলিভেটর ও আন্ডারগ্রাউন্ড। আমাদের এখানে শুধু সারফেসটাই আছে। এটা কোনো বড় শহরের চরিত্র নয়। যানজট নিরসনে পাতাল রেলের কথাও ভাবতে হবে। তবে সবকিছু করতে হবে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সরকারের আশু করণীয় হচ্ছেÑ ছোট ছোট মিনিবাস তুলে দিয়ে ৫২ সিটের বাস ও দোতলা বাস চালু করা। মূল সড়ক থেকে রিকশা সম্পূর্ণরূপে তুলে দেয়া। ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি কেবল রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলাচলের অনুমতি দেয়া। বর্ধিত ঢাকার সঙ্গে মূল ঢাকায় চলাচলের জন্য অধিকসংখ্যক বাইপাস সড়ক নির্মাণ। রাস্তাগুলো দখলমুক্ত করা। ঢাকায় রাজপথ অপদখল পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজধানীর রাজপথ দখলমুক্ত হলে যানজট সহনীয় মাত্রায় আসবে। ঢাকা আমাদের রাজধানী। যানজটে ৪০০ বছরের পুরনো আমাদের এই রাজধানী অচল হয়ে পড়–ক তা কাম্য হতে পারে না। নিজেদের স্বার্থেই এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।