Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

একাত্তরে আলিম সমাজের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান

| প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ : একাত্তরে ‘মুসলিম-ইসলাম’ নামযুক্ত কতিপয়ের দলগত অবস্থান বিপক্ষে থাকলেও ‘স্বাধীনতা’ হলো ‘রক্তঋণে কেনা’ ত্রিশ লাখ ‘বনী আদমে’র হাসির ঝিলিক। ‘টুপি-দাঁড়ি’ মানেই স্বাধীনতাবিরোধী এমন নয়, বরং স্বাধীনতা অর্জনে আলিম-উলামাদের অবস্থান অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। অথচ অজ্ঞতাবশত, অনেকে ধর্মপ্রাণ-নিরীহ মানুষকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করেন।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের সাহসী প্রতিরোধ। তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ্, দুদু মিয়া, ফকির মজনুশাহ্র সংগ্রামী আদর্শে উজ্জীবিত আমাদের আলিম সমাজ স্বাধীনতা সংগ্রামে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন এবং নিজ যোগ্যতায় নেতৃত্বও দিয়েছিলেন।
‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো; বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এমন দীক্ষায় জাতিকে উজ্জীবিত করেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ‘মুজিবনগর সরকারে’র সর্বদলীয় উপদেষ্টামÐলীর তিনি সভাপতি মনোনীত হন। ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক ‘কাগমারী সম্মেলনে’ মওলানা পাকিস্তানি নির্যাতনের প্রতিবাদ করে ‘আস্আলামু আলাইকুম্’ উচ্চারণের মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৯৭০-এ মওলানার জনসভা নিয়ে কবি শাম্সুর রাহমান লিখলেন ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতাটি। আবুজাফর উবায়দুল্লাহ্ লিখলেন ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’। আর আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর নিবেদন :
‘..... মুখের ভাষায় শুনি, বুকের সাড়ায় শুনি,
চোখের তারায় দেখি নামÑ মওলানা ভাসানীর নাম।
পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণের কালামÑ
.....মওলানা ভাসানীর নাম।’
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের আদর্শ সৈনিক, আওয়ামী লীগের অন্যতম কর্ণধার মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৪৩ দিন আত্মগোপনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং বহু সাধারণ মানুষ মওলানার প্রেরণায় ট্রেনিং ক্যাম্পে চলে যান। দেশকে শত্রæমুক্ত করে বিজয় নিশান উড়িয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। হানাদার বাহিনীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক, মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের সংগ্রহে থাকা অসংখ্য মূল্যবান ধর্মীয়গ্রন্থ ও তাঁর বাড়ি হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুজুর্গ হাফিজ্জি হুজুরকে আলিমগণ জিজ্ঞেস করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? তিনি বলেছিলেন, ‘এটা হচ্ছে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা জালিম আর আমরা বাঙালিরা মজলুম’। একথায় অসংখ্য আলিম-উলামা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গীতিকার আব্দুল লতিফের নিবেদন :
‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা...
আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি, জানা আছে জগৎময়...’।
২৬ মার্চ ভোরে হানাদারদের গুলিতে শহিদ হন ঢাকার হাতিরপুল মসজিদের ইমাম, এপ্রিলে বোমা হামলায় শহিদ হন চট্টগ্রামের আল্লামা দানেশ। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেন হাতিয়ার সশস্ত্রযোদ্ধা মাও. মোস্তাফিজ, চট্টলার কমান্ডার মাও. সৈয়দ, দুঃসাহসী সেনানী ছাগলনাইয়ার মাও. মাকসুদ ভূইয়া প্রমুখ। এছাড়াও চরমোনাইয়ের মাও. ইউসুফ, বায়তুল মোর্কারমের মুয়াজ্জিন আহমদুল্লাহ্ আশরাফ, মাও. আড়াইহাজারিসহ অনেকেই একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। একাত্তরের ১৩ নভেম্বর শনিবার নির্মমভাবে শহিদ হন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ভবানীপুর ফাজিল মাদরাসার শিক্ষক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেন মাস্টার। তার প্রচেষ্টায় ভবানীপুর মাদরাসার আটজন শিক্ষক, ছয়জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংগ্রহণ করেন, এতে মাদরাসা ছাত্র আ. বারী, আ. কাদির শহিদ হন।
১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার গঠিত হলে মওলানা উবায়দুল্লাহ্ বিন সাইদ জালালাবাদী, মওলানা আব্দুল্লাহ্ বিন সাইদ জালালাবাদী, খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় পেরিয়ে চলে যান ভারতে, যোগাযোগ করেন স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহ্মেদের সঙ্গে। তাঁরই নির্দেশনায় মওলানা জালালাবাদীভ্রাতৃদ্বয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ কুরআন তেলাওয়াৎ-তাফ্সীর পরিচালনার মাধ্যমে ‘শব্দ সৈনিকে’র ভূমিকা পালন করেন।
১৪ ডিসেম্বর হানদার বাহিনীর বুলেটে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শাহাদাতবরণ করেন পেশায় হোমিও ডাক্তার মওলানা অলিউর রহমান। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে আছেÑ ছয় দফা ইসলামবিরোধী নহে, শরীয়তের দৃষ্টিতে ছয় দফা, জয় বাংলা ও কয়েকটি ¯েøাগান ইত্যাদি। শহিদ বুদ্ধিজীবী সৃতিসৌধের ফলকে নাম থাকা এ বীর সেনানীর লাশ খুঁজে পাওয়া না গেলেও তিনি ‘এপিটাফ’ রচনা করে রেখে গেছেন :
‘আমায় তোরা দিসগো ফেলে হেলায় ভরে পথের ধারে
হয়তো পথিক করবে দোয়া দেখবে যখন কবরটারে’।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহ্মেদের ‘জোসনা ও জননীর গল্প’ সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। বৃহত্তর ময়মনসিংহের স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম মওলানা র্ইতাজ আলী কাসিমপুরী, যিনি কাহিনী সূত্রে পূর্বাপর আলোচিত। তিনি পাক আর্মির অন্যায় ‘ধর্মান্তর’ প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ করে পরাধীনদেশে জুমা’র নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের ফলশ্রæতিতে নির্মমভাবে শহিদ হন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে হুমায়ূন আহ্মেদ এ তথ্য লাভ করেন। তাই কবির ভাষায় নিবেদন
‘এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি
যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা
মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা...’।।
(মোহিনী চৌধুরী)
অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে আমাদের পতাকা হয়েছে লাল-সবুজে গাঢ় রঙিন। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল. (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীকের প্রাসঙ্গিক বিবরণ :
‘ময়মনসিংহের ভালুকার প্রায় দু’কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ৭ নম্বর মল্লিক বাড়ি ইউনিয়নের রূপী নদীর তীরের ভাÐাব (বয়টাপাড়া) গ্রামের মসজিদের পেশ ইমাম ও স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন ছফির উদ্দিন মুন্সী। তিনি মিষ্টভাষী, নম্র-ভদ্র স্বভাবের সৎ-সাহসী ও সরল প্রকৃতির মানুষ। ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই মঙ্গলবার মুয়াজ্জিন ছুতি মÐলের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘আশ্হা আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ...’ ছফির উদ্দিন মুন্সী নিচ্ছিলেন নামাজের প্রস্তুতি। হানাদার বাহিনী আর ওদের উচ্ছিষ্টভোগী চেলা-চামুÐারা ছুতি মÐলকে গুরুতর আহত-অচেতন করলে তার আর ফজরের আযান শেষ করা হলো না! ওরা ইমাম ছফির উদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে হামালা চালায়। ওরা একে একে চার সন্তানের জনক ছফির উদ্দিন মুন্সী ও তার স্ত্রী নসিমন্নেসা, ভাই ডাক্তার সামাদ (পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে অস্বীকৃতি জানান), তার স্ত্রী খাদিজা বেগম ও সামাদের পুত্র আ. করিমকে গুলি করে হত্যা করে। ওরা রক্তাক্ত লাশসহ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ঘরের পাঁচটি কুরআন শরীফ ও ধর্মীয় কিতাবাদি জ্বলে যায়। অথচ তাদের অপরাধ একটাই, ছফির উদ্দিন মুন্সী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংবাদ সরবরাহসহ সাধ্য মতো সাহায্য করতেন। ভাÐব মসজিদের পাশেই রয়েছে পাঁচ শহিদের সমাধি। নির্মম এ গণহত্যার সাক্ষী শুধু দেয়ালে খোদাই করা নাম ও পাশে বয়ে চলা রূপী নদী’। সূত্র : বাংলাদেশ বেতার ‘দর্পণ ম্যাগাজিন’ ১২ মার্চ ’১৭, দৈনিক ভোরের কাগজ ৭ মার্চ ’১৭ ও অন্যান্য। কাজেই, আমাদের শপথ হোক :
‘ব্যাঘ্রের মতো বিপুল শৌর্যে বাঁচিব একটি দিন
মেষ হয়ে তবু বাঁচিতে চাহি না প্রিয় স্বাধীনতাহীন’
(টিপু সুলতান)।
পরিশেষে, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিনের দরবারে আলীশানে মুনাজাত, সবুজে-শ্যামলে সমুজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আত্মত্যাগ করেছেন মহান আল্লাহ্ যেন তাঁদেরকে ‘শাহাদাতে’র উচ্চমর্যাদা নসিব করেন। যারা স্বজন হারিয়ে, পঙ্গুত্ববরণ করে কষ্টে আছেন আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন যেন তাঁদেরকে স্বস্তি দেন এবং যেসব বীর সন্তানেরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলেন প্রিয় স্বদেশ ও স্বাধীনতা তাঁরা যেন সুস্থ থাকেন এবং দীর্ঘায়ু হন। আমিন।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর



 

Show all comments
  • মোস্তাফিজুর রহমান ২২ মার্চ, ২০১৭, ৭:০০ পিএম says : 0
    যদিয় এই বাংলার তিরিশ লক্ষ মানুষের প্রানের বিনিময় এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, এবং তাদের অধিকাংশই মানুষ ছিল মুসলমান । এখানে কিছু ইসলাম বিদ্বেসি জাতীয় ও আন্তরজাতিক ঘরানার লোক এই স্বাধীনতা যুদ্ধকে ইসলামের পরাজয় হিসাবে দেখাতে চায় । অথচ সামান্য কিছু ইসলামি লেবাস ধারী কুলাঙ্গার ছাড়া এ স্বাধীনতার বিরোধিতা কেহ করেছিল না । ঐ কুলাঙ্গারদের পরাজয়ে দেখিয়ে তারা সমস্ত বাংলার মুসলমানদের এই পরাজয়ের মধ্যে ঢুকাতে চায় । কিন্তূ আস্তে আস্তে বালার মানূষ ওদের চক্রান্তকে নস্বাত করে দিতেছে । এবং কখনও ওদের মনো আশা এই বাংলাতে ফলপশু হবে না, ইনশা আল্লাহ ।
    Total Reply(0) Reply
  • এস, আনোয়ার ২৫ মার্চ, ২০১৭, ৭:৩৭ এএম says : 0
    যে সব প্রবীন ওলামা কিংবা টুপি-দাড়ি-পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যাক্তিরা এখনো বেঁচে আছেন তাঁরা ১৯৭১ সালে কোন্ পক্ষ সমর্থন করেছেন সেটা বড় কথা নয়, এমন কি ১৯৭১ এর পরবর্তী যে কোন সময়ে জন্মগ্রহনকারী ব্যক্তিগনও যাঁরা নিয়মিত টুপি-দাঁড়ি-পাঞ্জাবি ব্যবহার করেন, তাঁদের সবার জন্য এখনকার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো - তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন কিনা। যদি করেন তবে সবাই মুক্তিযোদ্ধা। অন্যথায় সবাই রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধী।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন