Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশের মানুষ ‘প্রকৃতি রাজ্যের’ কথাই স্মরণ করছে

প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাচেতনা, বোধ-বিশ্বাসে নতুন মাত্রা যোগ হয়। সভ্যতাকে অধিকতর সুশৃঙ্খল করতেই মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তা দানা বেঁধে ওঠে। যুক্ত হয় এক নতুন মাত্রা। রাষ্ট্রচিন্তা বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি; এমনকি সাহিত্য ও ঐতিহ্য সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। আর এভাবেই আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার শুভ সূচনা হয়। অধ্যাপক গ্যাটেলের মতে, Political thought represents a high type of intellectual achievement.) অর্থাৎ রাষ্ট্রচিন্তা কোন যুগের উন্নত বুদ্ধিমত্তা ও দার্শনিক চিন্তাসূত্রের প্রতিফলন ঘটায়।
সময়ের প্রয়োজনে রাষ্ট্রচিন্তায়ও গতিশীলতা এসেছে। গ্রিক রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধাবস্থাসহ নানাবিধ প্রতিকুলতা এবং বৈরী পরিস্থিতি অবসানের জন্য প্লেটো তার বিখ্যাত ‘The Republic’ গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে তারই শিক্ষক সক্রেটিসের মূলনীতি ‘Virtue of Knowledge’ এবং ‘যা আদর্শ তাই বাস্তব’ প্রভৃতি নীতি দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছেন। মূলত প্লেটো তার ‘The Republic’ ’ গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রে বর্ণনা দিয়েছেন তার মূল উদ্দেশ্য হলো সুন্দর বা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন। আসলে গণমানুষের কল্যাণসাধন ও মানুষের অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করতেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি। আর নাগরিকরা রাষ্ট্রের সেই কল্যাণ প্রাপ্তির শর্তেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রকে কর প্রদান করে।
রাষ্ট্র একটি তত্ত্বগত ধারণা মাত্র। রাষ্ট্রকে কল্পনা করতে হয়। কারণ, তা একটি তত্ত্বগত ধারণা (Abstract)। সরকার কিন্তু রাষ্ট্রের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (concrete) রূপ। রাষ্ট্রের ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমেই প্রকাশিত এবং কার্যকর হয়। তাই সরকার ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, The word Ôgovernment’, judged by its philological derivation, apparently has a close affinity to the rudder or steering of a ship.ঢ়. মূলত ‘হাল’ ব্যতীত যেমন কর্ণধারের জাহাজ চালানো সম্ভব হয় না, ঠিক তেমনিভাবে সরকার না থাকলে জনতা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং সুষ্ঠুভাবে কোন কাজই তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না। তাই রাষ্ট্র ও সরকার একে অপরের পরিপূরক। মূলত জনগণের কল্যাণকামিতায় আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার সৃষ্টি করে। সে কল্যাণ রাষ্ট্রের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জাপান সরকার। সম্প্রতি প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা গেছে, শুধুমাত্র একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ দেয়ার জন্য সেদেশের সরকার একটি রেলস্টেশন চালু রেখেছিল। জানা যায়, বছর তিনেক আগে জাপানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি ট্রেন স্টেশন চালু করা হয়। কিন্তু দিনে দিনে রেল স্টেশনে যাত্রীদের সংখ্যা কমতে থাকে। সে কারণে ‘কামি শিরটাকি’ রেলস্টেশনটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে দেশটির অন্য একটি বিরল নীতিও রয়েছে। ট্রেন ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা যদি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করে এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা যদি শুধুমাত্র একজনও হয় তাহলে ওই শিক্ষার্থীর পড়াশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন সেবা অব্যাহত থাকবে। আর গণমানুষের এই কল্যাণকামিতার সূত্র ধরেই জাপানের প্রত্যন্ত চঞ্চলের ‘কামি শিরটাকি’ রেলস্টেশনটি দীর্ঘদিন চালু রাখা হয়েছে। আগামী মার্চে গ্রাজুয়েশন শেষ হচ্ছে ওই মেয়ে শিক্ষার্থীর। তাই ওই স্টেশনটিও বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মূলত এটিই হচ্ছে কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এসব সূত্র ধরেই মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে এবং সভ্যতার সেই জয়যাত্রা এখনও অব্যাহত আছে এবং থাকবে। কিন্তু জাতি হিসেবে কেন জানি আমরা পশ্চাদমুখী হয়ে পড়েছি। বিশ্বের সকল জাতিই যখন উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর হচ্ছে তখন আমাদের পদচারণাটা রীতিমত ভূতের মতই বলতে হবে। আমরা বোধহয় একেবারে দিব্যি দিয়ে বসেছি যে, কোনভাবেই সামনে চলা যাবে না বরং আমাদের পশ্চাদমুখিতার নিগড়েই আবদ্ধ থাকতে হবে। আর এ পশ্চাদমুখিতা আমাদের জাতীয় জীবনের জীবনী শক্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দিচ্ছে।
রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জানমালের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা। আর রাষ্ট্রের করণীয় বাস্তবায়নের দায়িত্বটা পুরোপুরি সরকারের। কিন্তু দেশের মানুষ রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত সরকারের সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও লোভ-লালসার বিষয়টি একেবারে গৌন নয়। মূলত ক্ষমতাসীনদের আত্মস্বার্থ, দলীয়স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের কারণেই দেশের যে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আগামী দিনে আমাদের গন্তব্য কোথায় তা ঠাহর করা রীতিমত কষ্টসাধ্য। আমাদের জন্য ভাল কিছু অপেক্ষা করছে বলে আশা করার মত সুযোগ আপাতত নেই।
দেশে যখন আইনের শাসন থাকে না, তখন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষেরই ভোগান্তি সৃষ্টি হয়। এক সময় তা সর্বব্যাপী নৈরাজ্যের রূপ নেয়। আমাদের দেশে আইনের শাসনের পরিবর্তে সকল ক্ষেত্রেই শ্রেণী বিশেষের স্বেচ্ছাচারিতা দৃশ্যমান। এ থেকে পরিত্রাণের আপাতত কোন পথ দেখছে না দেশের মানুষ। কেউ ক্ষমতার দম্ভে, আবার কেউ ক্ষমতাসীনদের নাম ভাঙ্গিয়ে সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত।
সেদিন একটি ঘটনা দেখলাম যা রীতিমত বিচলিত হওয়ার মত। বয়সের দিক থেকে ষাটের কোটা ছুঁই ছুঁই এক যাত্রী কোনক্রমেই বাসে ভাড়া দিতে রাজি হলেন না বরং ক্ষমতাসীনদের নাম করে বাস কর্মচারীর সাথে রীতিমত বচসায় লিপ্ত হলেন। বাস কর্মচারী অনেক অনুরোধ ও বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে তার কাছ থেকে ভাড়া আদায় করতে পারলেন না। যাত্রীর সাফ কথা, তিনি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত তাই তিনি কোনভাবেই ভাড়া দেবেন না। গোবেচারা বাস কর্মচারীর পক্ষে অসহায়ের মত আর্তনাদ করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকলো না। যাত্রীটি মাত্র ৫ টাকার জন্য যত কথা বললেন তা কোন ভদ্রলোক তো দূরের কথা কোন মানুষের পক্ষেও তা বলা সম্ভব নয়। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারের বিষয়ে অভিনবত্ব আছে বলে মনে হয় না। এসব অতীতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে এবং আগামীদিনেও হবে। কিন্তু তা সীমিত পরিসর ও নিয়ন্ত্রণে রাখতেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আইনের শাসন প্রয়োজন। আর এ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয়তাও আবশ্যক। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র বোধহয় দুর্বলের প্রতি সবলের অচ্যাচার বন্ধ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অথবা যাদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পিত তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না বা নিজেরাই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন।
মূলত গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার মূল উদ্দেশ্য। প্রাগৈতিহাসিককালে তা ‘প্রকৃতি রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত ছিল। অতীতের অনেক চিন্তাবিদের ন্যায় রুশোও শুরু করেন ‘প্রকৃতির রাজ্য’ থেকে। হব্স এবং লকের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার পূর্বে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় বসবাস করতো। তবে সেই প্রকৃতি হব্সের প্রকৃতির রাজ্যের অনুরূপ ছিল না। তা ছিল অনেকটা লকের অঙ্কিত প্রাকৃতিক অবস্থার ন্যায়। রুশোর মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল পৃথিবীতে স্বর্গের ন্যায়। মানুষ ছিল সুখী, আনন্দবিহ্বল এবং পরিপূর্ণ। মানুষের জীবন ছিল সৎ, স্বাভাবিক এবং সুন্দর। প্রাকৃতিক অবস্থায় কোন কৃত্রিমতা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ছাপ ছিল না; ছিল শুধু সুখ ও সম্প্রীতি। মানুষ সুখী, সহজ, সরল এবং সততার জীবনে অভ্যস্ত ছিল। রুশোর প্রকৃতির রাজ্যের বর্ণনা দিয়ে অধ্যাপক ডানিং (Dunning) বলেন, ‘In the natural men are to be found the elements of perfect happiness. He is independent, contented and self-sufficing.’ অর্থাৎ প্রাকৃতিক মানুষের মধ্যেই ছিল পরিপূর্ণ সুখের উপাদানগুলো। সে ছিল স্বাধীন, পরিতুষ্ট এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাবে মানুষ বোধহয় সেই রুশোর প্রকৃতি রাজ্যের কথায় বারবার স্মরণ করছে। যে সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করতে পারছে না, সে সরকারকে অসার ও অপ্রয়োজনীয় মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগই অস্বীকার করা হচ্ছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না বা প্রয়োজনও বোধ করছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দেশের মানুষ ‘প্রকৃতি রাজ্যের’ কথাই স্মরণ করছে
আরও পড়ুন