বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হোসেন মাহমুদ : বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অতি সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি খবরের কথা সম্মানিত পাঠকদের মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ২ মার্চ। খবরটি হলো ‘২০১৬ সালে বাংলাদেশ সীমান্তে ৪ হাজার গুলি চালিয়েছে বিএসএফ।’ দ্বিতীয় খবরটি প্রকাশিত হয় ১১ মার্চ। তা হলো ‘সীমান্তে যুবক নিহত, নেপালে বিক্ষোভ, ভারতের দুঃখপ্রকাশ।’ এ দুটি খবর যে এক নয় তা যে কেউই বুঝতে পারবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ দুটি খবরের মধ্যে একটি দূরতম যোগসূত্র আছে যা প্রথম দৃষ্টিতে কারো কারো কাছে স্পষ্ট নাও হতে পারে। এ যোগসূত্রটি হচ্ছে হত্যা। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে অনেক দিন ধরে বাংলাদেশিদের ওপর গুলি চালিয়ে আসছে; যাতে নিহত হয়েছেন বহু বাংলাদেশি। আর ভারত-নেপালের আধুনিককালের ইতিহাসে এই প্রথম আরেক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সশস্ত্র সীমা বল বা এসএসবি নেপাল সীমান্তে এক বিরোধের ঘটনায় গুলি চালিয়ে এক নেপালিকে হত্যা করেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সে দেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া। এ হত্যার ঘটনায় প্রায় সমগ্র নেপাল প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে, যার প্রচÐতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এ হত্যার জন্য নেপালের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বা করতে বাধ্য হয়। আর বাংলাদেশ সীমান্তে গত প্রায় দুই দশক ধরে ফি দিন গুলি চালিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করেও ভারত দুঃখ প্রকাশ করে না বা করার প্রয়োজনও বোধ করে না। একে তুলনা করা যায় পাখি ও মানুষ মারার সাথে। পাখি এখন সহজলভ্য নয়, তারপরও পাখি গুলি করে মারলে তার জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ করা, জবাবদিহি করা বা বিচারের সম্মুখীন হতে হয় না। কিন্তু একজন মানুষ মারলে তার সবকটিই করতে হতে পারে বা ঘটতে পারে। নেপালে হতভাগ্য গোবিন্দ গৌতমকে হত্যার ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে যে নেপালিরা মানুষ আর বাংলাদেশিরা পাখি। ভারত একজন নেপালিকে হত্যা করলে তাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়, কারণ সে মানুষ। মানুষের জীবনের মূল্য আছে। তাই মানুষকে হত্যা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। আর একজন বাংলাদেশিকে মারলে ভারতকে কিছুই করতে হয় না, কারণ সে পাখি। পাখির জীবনের মূল্য নেই। তাকে হত্যা করলে জবাবদিহিতারও প্রয়োজন হয় না।
গত ১ মার্চ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বিএসএফের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক নাগরিক কর্মসূচিতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর ৪ হাজার রাউন্ড গুলি চালিয়েছে বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ ফ্রন্টিয়ার। এ হিসেবে ফ্রন্টিয়ারের অধীনে থাকা ১১৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত সীমান্ত বরাবর বিএসএফ প্রতিদিন গড়ে ১০টিরও বেশি গুলি চালিয়েছে। তথ্যে বলা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টার্গেটে থাকা বাংলাদেশিরা আহত হয়েছে। আর নিহতের সংখ্যা ২০ এর বেশি। তথ্যে আরো বলা হয়, ২০১৭ সালের প্রথম দুই মাসে বিএসএফ গুলি করেছে ৭৩৮ রাউন্ড। অর্থাৎ গত ১৪ মাসে বাংলাদেশিদের ওপর বিএসএফ গুলি ছুড়েছে প্রায় ৫ হাজার রাউন্ড।
জানা যায়, চলতি বছরে সর্বশেষ বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি সোমবার। এদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অহেদপুর সীমান্তে বিএসএফ মাসুদ আলী (২২) নামের এক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় আহত হয় আরো ৫ জন। তারা সবাই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানার চাঁদপুরে গরু আনতে গিয়েছিল। গরু নিয়ে ফিরে আসার সময় চাঁদনিচক ক্যাম্পের বিএসএফ তাদের গতিরোধ করে ও গুলি চালায়। ফলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ভারতের বিএসএফ বহুদিন থেকেই বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করে আসছে। এ নিয়ে প্রথম থেকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মৃদু প্রতিবাদ করা হয়েছে অথবা বাংলাদেশ সরকারিভাবে নিশ্চুপ থেকেছে। উভয়পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে বারংবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বিএসএফ বরাবরই আর হত্যা হবে না, কমিয়ে আনা হবে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না ইত্যাদি বলেছে, তবে তাদের কোনো প্রতিশ্রæতিই কখনো রক্ষিত হয়নি। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার যে, বাংলাদেশের কোনো সরকারই এ পর্যন্ত বিএসএফের নির্বিচার বাংলদেশি হত্যার ব্যাপারে কখনো জোরালো কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। বিএসএফ যে শুধু গরু ব্যবসায়ীদেরই হত্যা করে তা নয়। তারা ক্ষেতে কর্মরত কৃষক, সীমান্ত এলাকায় চলাচলরত মানুষকেও হত্যা করেছে। আর এসব হত্যার বেশির ভাগই ঘটেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। আবার তারা শুধু গুলি করেই মারেনি, অনেক বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে পিটিয়েও মেরেছে। এমনকি নিহতদের সাথে অভব্য আচরণও করেছে। তারা কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় তার লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিল। পঞ্চগড় সীমান্তে এক বাংলাদেশিকে হত্যার পর তার লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির লাশ ফেরত দিতে গড়িমসি করেছে বা কয়েক দিন পর ফেরত দিয়েছে। বিএসএফের এই বাংলাদেশি হত্যাকাÐ গোটা বিশে^ সর্বকালের বর্বরতার ঘৃণ্য নজির হয়ে আছে। সে জন্য তাদেরকে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বাহিনী বলেও আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা অধিকার বিএসএফের বাংলাদেশি হত্যা বিষয়ে যে সালভিত্তিক তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে তাদের বাংলাদেশি হত্যার একটি পরিসংখ্যান রয়েছে। তাতে দেখা যায় : বিএসএফ ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ৩৮ জন, ২০১৩ সালে ২৯ জন, ২০১৪ সালে ৩৩ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জনকে হত্যা করে। ২০১৬ সালে তাদের হাতে নিহতদের সংখ্যার পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে আগস্ট মাস পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। এর আগে বিএসএফের হাতে ২০০০ সালে ৩৯ জন, ২০০১ সালে ৯৪ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৯ সালে ৯৬ জন ও ২০১০ সালে ৭৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়। অর্থাৎ এ তথ্য মোতাবেক ২০০০ সাল থেকে ২০১৬-র জুন পর্যন্ত বিএসএফের হাতে নিহতের সংখ্যা ১০৮২ (এ হিসাবের মধ্যে ২০০৪ সালে নিহতের সংখ্যা নেই)।
অধিকার বলছে, দুই দেশের মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেফতার ও হস্তান্তরে সমঝোতা এবং চুক্তি থাকলেও বিএসএফ সেটি লঙ্ঘন করে সীমান্তে বাংলাদেশিদের দেখামাত্রই গুলি করছে। জানা যায়, বিজিবি এসব হত্যার প্রতিবাদ জানাতে মাঝেমধ্যে পতাকা বৈঠক ডাকে। সব সময়ই নিয়মমাফিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু হত্যা বন্ধ হয় না। এমনকি হত্যার পর সব সময় লাশও ফেরত দেয় না বিএসএফ। নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা ও অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা সীমান্ত এলাকার মানুষের কাছে।
আশ্চর্য যে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই গরু ব্যবসায়ী। ভারত থেকে গরু এনে বাংলাদেশে বিক্রি করা অধিক লাভজনক। সেই লোভের টানে তারা গরু আনতে ভারতে যায়। একটি অংশ যায় বৈধভাবে। তাদের পাশাপাশি কিছু অবৈধ গরু ব্যবসায়ী বা রাখালও হয়তো ভারতে ঢুকে। তারা যখন ঢুকে তখন বিএসএফ কখনো তাদের বাধা দেয় না বা হত্যা করে না। হত্যা করে তখন যখন তারা গরু নিয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। শোনা যায় যে, উৎকোচের টাকার পরিমাণ নিয়ে বিরোধ থেকেই তারা বিএসএফের ক্রোধের শিকার হয়ে প্রাণ হারায়। এসব গরু ব্যবসায়ী কোনো সন্ত্রাসী বা নাশকতামূলক কাজে জড়িত বলে কখনো কেউ বলেনি। শুধু অবৈধভাবে কোনো দেশে ঢোকার জন্য আরেক দেশের মানুষকে নিয়মিতভাবে গুলি করে বা পিটিয়ে হত্যার দৃষ্টান্ত শুধু বিএসএফেরই আছে। তাদের পক্ষেই নির্লজ্জের মতো এ তথ্য প্রচার করা সম্ভব যে বাংলাদেশ সীমান্তে তারা এক বছরে ৪ হাজার, দিনে গড়ে ১০ রাউন্ডের মতো গুলি ছুড়েছে। তারা যদিও কাদের প্রতি এ গুলি ছুড়েছে তা বলেনি, কিন্তু যতটুকু জানা যায় তা হচ্ছে তাদের এসব গুলিরই লক্ষ্য ছিল নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ আর অবৈধ গরু ব্যবসায়ী বা রাখালরা, যারা জীবিকার্জনের জন্যই শুধু এ কাজ করে, কোনো অপরাধ বা নাশকতা সংঘটনের জন্য নয়। এসব হত্যার ঘটনায় ভারতের নিরাপত্তা পরিস্থিতির যেমন কোনো উন্নতি হয়নি তেমনি অর্থনৈতিক কোনো কল্যাণও সাধিত হয়নি, বরং সীমান্তবাসীসহ বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগণের অপরিমেয় ঘৃণা ও ধিক্কারের শিকার হয়েছে তারা। যেমন ফেলানী হত্যার ঘটনা ভারতের ভাবমূর্তিকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
ভারত-নেপাল সীমান্ত অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। এ সীমান্ত কার্যত উন্মুক্ত। নেপালে অবাধে ভারতীয় রুপি চলে, সে দেশে যেতে ভারতীয়দের পাসপোর্ট লাগে না। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী এসএসবির গুলিতে গোবিন্দ গৌতম নামে (৩২) এক যুবক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে গত ৯ মার্চ। এর ফলে নেপালে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। জানা যায় যে, ভারত নেপাল সীমান্তে নেপালের কাঞ্চনপুর জেলার কারগিলডান্ডায় ভারতীয়দের উদ্যোগে একটি কালভার্ট নির্মাণ নিয়ে দুই দেশের লোকজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। নেপালিরা প্রতিবাদ জানানোর সময় এসএসবি নেপালের ৮০০ মিটার ভিতরে ঢুকে পড়ে। নেপালি সংবাদ মাধ্যম জানায়, এসএসবি গুলি চালালে গোবিন্দ গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নেয়ার সময় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নেপালের বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে মানুষ। রাজধানী কাঠমান্ডুতে ভারতীয় দূতাবাসে বিক্ষোভ প্রদর্শনের চেষ্টা চলে। ভারতের পক্ষ থেকে গুলির কথা অস্বীকার করা হয়। এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। সহায়তা করতে অনুরোধ করা হয়েছে নেপালকে। ভারত নিহতের ফরেনসিক ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট চেয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় নেপালের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়া ও উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ডর কাছে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং নিহতের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ কথা বলেন নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী বিমলেন্দ্র নিধির সাথে।
জানা যায়, জনতাকে শান্ত করতে নেপাল সরকার ইতোমধ্যে গৌতমকে ‘শহীদ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১১ বার তোপধ্বনির মধ্যদিয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। পার্লামেন্টে এ নিয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী বিমলেন্দু নিধিকে বিবৃতি দিতে হয়েছে। গৌতমের পরিবারকে ইতোমধ্যে ১০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং তার সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্র।
এসএসবির গুলিতে এক নেপালির মৃত্যুর প্রতিবাদে সারা নেপাল যখন উত্তাল তখন বাংলাদেশে গত ১৬ বছরে বিএসএফের গুলিতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেলেও বাংলাদেশে সরকার ও সরকারের পদাধিকারী ব্যক্তিগণ, রাজনীতিক ও জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দেশের অভ্যন্তরে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার যেমন কারো কাম্য নয় তেমনি বাংলাদেশ বাইরের কোনো দেশের কাছ থেকে কোনো ধরনের চাপ বা ভীতির শিকার হবে তাও কাম্য নয়। বরং তা সর্বতোরূপে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। আশ্চর্য যে অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বলে নিজেদের দাবি করেন তারা বিএসএফের নির্বিচারে বাংলাদেশি হত্যার বিরুদ্ধে কখনই একটি কথাও উচ্চারণ করেন না। এক্ষেত্রে তাদের নীরবতার কারণ কী তা তারাই ভালো বলতে পারবেন।
নেপালি নাগরিক হত্যার ঘটনা, নেপালিদের প্রতিবাদ এবং একই ঘটনায় বাংলাদেশের আশ্চর্য নীরবতা প্রসঙ্গে আমাদের সকল সংবাদ মাধ্যমও যখন নীরব তখন ফেসবুকে জনমতের কিছু অংশের মনোভাবের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। এর গুরুত্ব একবারে কম নয়। এখানে ফেসবুকে এ সংক্রান্ত মন্তব্যের কিছু তুলে ধরা যেতে পারে। ১২ মার্চ রাশেদ খান লিখেছেন : ‘এক গোবিন্দের হত্যার প্রতিবাদে নেপালের মতো একটি ছোট দেশ তোলপাড় করে ফেলছে, আর প্রতি সপ্তাহে ভারতের সীমান্তে গড়ে একজন বাংলাদেশির লাশ পড়ছে, কিন্তু আমাদের কোনো হুঁশ হয় না। পাঁচ ফুট নেপালিদের শিরদাঁড়া আছে। কিন্তু হায়! সাড়ে পাঁচ ফুট বাংলাদেশিদের শিরদাঁড়া নাই।’ ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, লেখক কলামিস্ট আসিফ নজরুল লিখেছেন : “হাসি খুশী ‘বীর’ বাংগালী। সীমান্তে মাত্র একটা হত্যাকাÐ হওয়াতেই এভাবে প্রতিবাদ করতে পেরেছে নেপাল। আর আমরা? আমাদের মন্ত্রী আর বিজিবি কর্তারা খুশি একশ না মরে পঞ্চাশ মরেছে বলে! দালাল আর ক্লাউনরা খুশি ভারত আমাদের বন্ধু শুধু এটা জপতে পেরে। আমরা বাকি প্রায় সকলে খুশি এসব প্রসঙ্গ জাস্ট এড়িয়ে যেতে পারলে! কি যে নির্লজ্জ আর মেরুদÐহীন হয়ে গেছি আমরা! এ জন্য দুই পয়সা দামও দেয় না ভারত বাংলাদেশকে। এক মমতার গুরুত্ব তাই পুরো বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ভারতের কাছে। লাথি খেয়েও হাসিখুশী! এমন মানুষ এদেশের মতো কোন দেশে আছে আর!” একই দিনে মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম আকাশ লিখেছেন : ‘আমরা মুখের কথার বীর, কিন্তু নেপালিরা কাজে বীর... বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশই ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কমবেশি সোচ্চার ও সতর্ক। নেপালি জনগণ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আগেও লড়াই করে দেখিয়েছে, আবারও করে দেখাল। ওদের সাধুবাদ প্রাপ্য।... নেপালিদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এখনই সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।’ ১৪ মার্চ পিনাকী ভট্টাচার্য লিখেছেন : ‘সীমান্তে একজন নেপালিকে খুন করে নেপালের কাছে ক্ষমা চায় ভারত। বাংলাদেশের সীমান্তে প্রত্যেক মাসে ভারত বাংলাদেশি খুন করে, অপহরণ করে, বীভৎস নির্যাতন করে। ইহজনমে ভারত ক্ষমা চায়নি। তবে চাইতে হবে। কড়ায় গÐায় সীমান্তে ঝরা প্রত্যেক ফোঁটা রক্তের হিসাব নেব। ভারত তৈরি থেকো।’ একই দিনে মিজান রহমান লিখেছেন : ‘ধন্যবাদ নেপাল সরকারকে। তাদের কিছু নেই। তবু মাওবাদীরা দেখিয়ে দিল দেশপ্রেম কাকে বলে। আরো দেখিয়ে দিল ওসব ইন্ডিয়া-ফিন্ডিয়া কিছু নয়, আসল হলো মনোবল। ধন্যবাদ নেপালি জনগণকে।’ এ দিনই সাব্বির হোসেন লিখেছেন : ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য যদি চীনে যেতে হয়, দেশপ্রেম অর্জনের জন্য নেপালে যেতে হবে।’
উল্লিখিত সব মন্তব্যের সঙ্গে সকলেই একমত নাও হতে পারেন, তবে নেপালের ঘটনা হয়তো কারো কারো মধ্যে বা অনেকের মধ্যেই দেশপ্রেম সম্পর্কে নতুন করে ভাবনা জাগাতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।