দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্্শী
হজের আদবসমূহ :
হজের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি যে, ইহরাম বাঁধা হতে শুরু করে ইহরাম খোলা পর্যন্ত প্রত্যেক হাজী সততা, পবিত্রতা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে থাকা। তারা লড়াই-ঝগড়া এবং দাঙ্গা, ফাসাদ করবে না। কাউকে কষ্ট দেবে না। এমনকি একটি ক্ষুদ্র পীপিলিকা পর্যন্ত মারবে না। শিকার করা তাদের জন্য জায়েজ নয়। কেননা তারা তখন সার্বিকভাবে শান্তি, আপস মীমাংসা, বন্ধুত্ব এবং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে থাকবে। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “নির্দিষ্ট দিনগুলোর মাঝে যে হজ করবে, তবে সে যেন স্ত্রীসম্ভোগ, গোনাহের কাজ এবং ঝগড়া-ফাসাদ না করে এবং তোমরা যে সকল উত্তম কাজ করবে, সে সম্পর্কে আল্লাহপাক অবশ্যই পরিজ্ঞাত।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৫) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে : “তোমরা ইহরামের অবস্থায় শিকার করাকে হালাল মনে করো না। :
(সূরা মায়িদাহ : রুকু-১)
অনুরূপভাবে যারা হজের নিয়তে ঘর হতে বের হবে, তাদেরকে রাস্তায় কষ্ট দেয়া, তাদের মাল-সামান লুট করা, অথবা চুরি করা নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহর গৃহের সন্নিকটে এ সকল কর্মকান্ড অবশ্যই আদবের খেলাপ। যেন আরবের মতো নিরাপত্তাহীন দেশে এ সকল ডাকাত, লুটেরা ও বদমায়েশদের কারণে হাজীদের কাফেলাগুলোর আসা-যাওয়ার মাঝে কোন প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি না হয়। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং তোমরা এই মর্যাদাপূর্ণ গৃহের জিয়ারত প্রত্যাশাকারীদের যারা আল্লাহর রেজামন্দি ও খোশনুদী কামনা করে, তাদেরকে তোমরা হালাল মনে করো না।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১)
যদি কোনও হাজীর নিকট হতে কোনও পশু হত্যাকর্ম স্বেচ্ছাকৃতভাবে ঘটে যায়, তাহলে এর জন্য তাকে রক্ত বদলা কোরবানি করতে হবে। এর নাম হচ্ছে কাফ্ফারাহ। অর্থাৎ তাকে নিহত পশুর সমপরিমাণ কোনও হালাল জানোয়ার কোরবানি করতে হবে, কিংবা কয়েকজন দরিদ্রকে আহার করাবে, কিংবা সমপরিমাণ রোজা রাখবে। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকবে, তখন শিকার করো না, তোমাদের মাঝে যে স্বেচ্ছায় হত্যা করবে, তাহলে তাকে এর বদলে হালাল গৃহপালিত পশু কোরবানি করতে হবে। এর ফায়সালা তোমাদের মাঝে দুজন ন্যায়বান লোক সম্পন্ন করবে, যেন এই পশু কাবা পর্যন্ত পৌঁছায়ে কোরবানি করা হয়; কিংবা এই গোনাহের বদলাস্বরূপ মিসকিনকে আহার দান করবে; কিংবা সমপরিমাণ রোজা রাখবে, যেন সেই অপরাধী স্বীয় অপরাধে শাস্তি ভোগ করতে পারে। (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১২) এই আয়াতের দ্বারা বোঝা যায় যে, হজ হচ্ছে সার্বিকভাবে সোলেহ, সালামতি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক। এই উদ্দেশ্যের বিপরীত হাজীদের নিকট হতে যা কিছু কর্মকান্ডই প্রকাশ পাবে, এর কাফফারা আদায় করা তার ওপর অপরিহার্য।
হজের মুসলিহাত ও হেকমত :
রাসূলুল্লাহ (সা.) শরীয়তের যে পরিপূর্ণতা নিয়ে আগমন করেছেন, এর সবচেয়ে বৃহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, “এতে দীন ও দুনিয়ায় সমষ্টিগত কল্যাণ” নিহিত আছে। এই শরীয়তের সর্বত্র হেকমত এবং মুসলিহাতের প্র¯্রবণ প্রবাহিত। এই শরিয়ত স্বীয় আহকাম ও ইবাদতের উপকারিতা লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নির্ণয়ে বাইরে কোনো বস্তু বা মাধ্যমের প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। বরং এই শরীয়ত এ সকল বিষয়াদির গোপন রহস্যসমূহের মুখমন্ডল হতে যাবতীয় অবগুণ্ঠন অপসারিত করেছে। নামাজ, যাকাত, রোজার মতো হজের উদ্দেশ্যাবলী এবং উপকারিতাও স্বয়ং ইসলামী বিধানে সম্পৃক্ত হয়েছে।
কোরআনুল কারীমে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জবানিতে খানায়ে কাবার নির্মাণ ইসমাঈল (আ.)-এর মানত এবং মক্কায় তাঁর অবস্থান সংক্রান্ত যে সকল দোয়া ও মোনাজাত সন্নিবেশিত আছে, সেগুলোর মাঝে সার্বিকভাবে হজের উপকারিতা ও উদ্দেশ্যাবলী বিধৃত আছে। এ সকল আয়াতের প্রতি একবার নজর দেয়া দরকার। ইরশাদ হচ্ছে (ক) “এবং যখন আমি এই গৃহকে (কা’বা) মানুষের কেন্দ্রস্থল, প্রত্যাবর্তনস্থল ও শান্তির নিবাস করলাম এবং বললাম যে, মাকায়ে ইব্রাহীমকে (আ.) নামাজের স্থান বানাও এবং আমি ইব্রাহীম (আ.) ও ইসমাঈলকে (আ.) এই জিম্মাদারি প্রদান করলাম যে, তোমরা উভয়ে আমার গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, ইতিকাফকারীদের জন্য, রুকুকারীদের জন্য এবং সিজদাহকারীদের জন্য পাক-সাফ রাখবে। এবং যখন ইব্রাহীম (আ.) প্রার্থনা করলেন, “হে আমাদের প্রতিপালক! এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার স্থল করে দিন এবং এখানকার বাসিন্দাদেরকে ফল ও ফসল দ্বারা জীবিকা দান করুন।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫) (খ) “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করে দিন, এবং আমাদের সন্তান-সন্ততিদের থেকে আপনার একদল অনুগত বান্দাহ তৈরি করুন, আমাদেরকে আমাদের হজের তরিকা বলে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, অবশ্যই আপনি তওবাহ কবুলকারী ও মেহেরবান। হে আল্লাহ! তাদের মাঝে তাদের মধ্য হতেই একজন রাসূল প্রেরণ করুন?” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫) (গ) “এবং যখন আমি ইব্রাহীম (আ.)-কে গৃহের স্থানকে ঠিকানা বানিয়ে দিলাম (এবং বলে দিলাম) যে, আমার সাথে কোন কিছুর শরিক স্থাপন কর না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্য, ইতিকাফকারীদের জন্য, রুকু ও সেজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখ এবং মানুষের সামনে হজের ঘোষণা জারি কর। তারা তোমার কাছে পদব্রজে এবং দুর্বল উটের ওপর আরোহণ করে দূর-দূরান্ত হতে আগমন করবে, যেন তারা উপকৃত হওয়ার স্থানে এসে হাজির হয় এবং নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করে, কেননা আমিই তাদেরকে পশু সম্পদ হতে রিজিক দান করেছি। (সূরা হজ : রুকু-৪) (ঘ) “এবং যখন ইব্রাহীম (আ.) দোয়া করলেন, হে আমার প্রতিপালক! এই শহরকে নিরাপত্তার স্থান বানিয়ে দিন এবং আমাকে এবং আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজার অভিশাপ হতে বাঁচান। হে আমার পরওয়ারদিগার! এই মূর্তিগুলো বহু লোককে গোমরাহ করে দিয়েছে। সুতরাং যে আমার কথা মান্য করেছে, সে আমার দলভুক্ত এবং যে আমার নাফরমানি করেছে তার প্রতি অনুকম্পা ও ক্ষমা প্রদর্শনকারী একমাত্র আপনিই; হে আমার প্রতিপালক! অবশ্যই আমি আমার সন্তান-সন্ততিকে এমন একটি ময়দানে, আপনার গৃহের পাশে বসতি স্থাপন করিয়েছি যেখানে ফল ও ফসল উৎপাদিত হয় না; হে আমাদের প্রতিপালক! যেন তারা সালাত কায়েম করতে পারে; সুতরাং আপনি মানুষের একটি শ্রেণীকে তাদের প্রতি সদয় করে দিন এবং তাদেরকে ফল ও ফসল দ্বারা রিজিক দান করুন, যেন তারা শোকরগুজার করতে পারে।”
(সূরা ইব্রাহীম : রুকু-৬)
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের সারমর্ম নিম্নলিখিত পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা যায়।
১। খানায়ে কাবা তাওহীদপন্থীদের প্রাণকেন্দ্র, প্রত্যাবর্তন স্থল এবং মিল্লাতে ইব্রাহীমীর বাসস্থান ও নিবাস।
২। হযরত ইব্রাহীম (আ.) সর্বপ্রথম স্বীয় সন্তান-সন্ততিদের এখানে এ জন্য বসতি স্থাপন করিয়েছিলেন যেন এই পবিত্র গৃহের খেদমতগুজারী ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত তারা সূচারুরূপে করতে পারে এবং মূর্তিপূজারী সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে জীবনযাপন করতে পারে। যাতে করে অতীত যুগের মতো এই গৃহটি অনাবাদি ও নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়। এমনকি তাদের মধ্যে হতে যেন কাক্সিক্ষত রাসূল আগমন করতে পারেন।
৩। এই লোকজন জনমানবহীন বিরান স্থানে এ জন্য বসতি স্থাপন করে, যাতে করে এই গৃহটি আবাদ করতে পারে এবং ফল ও ফসলহীন এই ভূমির অধিবাসীদের আহার সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে এবং মানুষের মনকে এর প্রতি আকর্ষিত করতে পারে। যাতে করে তারা এই স্থানকে ভালোবাসতে সক্ষম হয়।
৪। তাদের প্রতি এই হুকুম করা হয়েছিল যে, মানুষের মাঝে হজের সাধারণ ঘোষণা প্রচার কর। নিকট ও দূরের অধিবাসীরা অবশ্যই এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাব। যেন তারা এখানে এসে দীন ও দুনিয়ার ফায়দা হাসিল করতে পারে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর জিকির বুলন্দ করতে পারে।
৫। যে সকল লোক এখানে হজের নিয়তে আগমন করবে, তারা এই ফরিয়াদ করবে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করুন। কেননা আপনিই ক্ষমাশীল মেহেরবান।
৬। হে আল্লাহ! আমার আওলাদ-ফরজন্দের মাঝে যারা যারা আমার আদর্শ, মাজহাব এবং আমার পথ অনুসরণ করবে, তারাই মিল্লাতে ইব্রাহীমীর পাবন্দ। তারাই আলে ইব্রাহীম নামে পরিচিত এবং তারাই ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়া ও বরকতের প্রকৃত হকদার।
মোট কথা, হজের এ সকল উপকারিতা ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এর প্রত্যেকটির অভ্যন্তরেই রয়েছে অসংখ্য উদ্দেশ্য ও উপকারিতার ফল্গুধারা।
হজের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য :
এই পৃথিবীতে খানায়ে কা’বা হচ্ছে আরশের ছায়া এবং এর রহমত ও বরকতের প্রত্যক্ষ রূপরেখা। এটা হচ্ছে স্বচ্ছ একটি আয়না। যার মাঝে এর রহমত ও অনুকম্পার গুণাবলী নিজের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত করে গোটা বিশ্বের প্রতিটি অনু-পরমাণুকে সমুজ্জ্বল করে তোলে। এটা এমনই এক ঝরনা বা উৎস, যেখান থেকে সত্যের প্র¯্রবণ উৎসারিত হয়েছে এবং তা সারা পৃথিবীকে প্লাবিত করেছে। এটা হচ্ছে রূহানী জ্ঞান ও মা’রিফাতের এমন উদয়স্থল, যার কিরণসমূহ পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণাকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছে। এটা এমন একটি ভৌগোলিক সেতুবন্ধন, যার মাঝে মিল্লাতের এমন সব ব্যক্তিত্ব সম্পৃক্ত রয়েছে, যারা বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন ভূখন্ডে বসবাস করে। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে। বিভিন্ন সভ্যতার মাঝে জীবন অতিবাহিত করে কিন্তু তারা সকলেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলী এবং সহজাত পৃথক স্বভাবের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও একই খানায়ে কা’বার চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে এবং একই কিবলাকে নিজেদের কেন্দ্র হিসেবে মনে করে এবং একই স্থানকে ‘উম্মুল করা’ মনে করে এবং আঞ্চলিকতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপ এবং অন্যান্য বিভেদ সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যাবলীকে মিটিয়ে দিয়ে এইক দেশ, একই জাতি, একই সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একই ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এটা এমনই এক ভ্রাতৃত্ব যার মাঝে দুনিয়ার সকল জাতি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী ব্যক্তি, পৃথক পরিবেশে প্রতিপালিত সত্তা ও একই মুহূর্তে এবং একই সময়ে প্রবেশ করে। যার ফলে মানুষের বানানো যাবতীয় প্রতিবন্ধক, শৃঙ্খল টুটে যায় এবং অল্প দিনের জন্য হজের সময়ে সকল জাতি একই দেশে, একই পোশাকে, একই ইহরামের ধারক ও বাহক হয়ে সম্মিলিতভাবে একই গৃহের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং একই ভাষায় আল্লাহর সাথে কথা বলে।
এটাই হলো একতার ওই রং, যা এ সকল বস্তুভিত্তিক বিভেদকে মিটিয়ে দেয়, যা মানুষের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ফেতনা-ফাসাদের মূল কারণ। এ জন্য এই হেরেমে রাব্বানী শুধু কেবল শান্তি ও নিরাপত্তার ঘরই নয়, বরং এখানে সকল প্রকার রক্তপাত, জুলুম, নির্যাতন, সর্বোতভাবে নিষিদ্ধ। আর একদিকে তা নিরাপত্তার ঘর। কেননা তা দুনিয়ার সকল মুসলিম মিল্লাতকে একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে, বাহ্যিক বিভেদের যাবতীয় মাজহাবী উপাদানকে মিটিয়ে দেয়।
মানুষ আজ এই স্বপ্ন দেখছে যে, জাতীয়তা ও আঞ্চলিকতার বেষ্টনী হতে বের হয়ে, তারা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বিস্তৃত পরিমন্ডলে প্রবেশ করুক। কিন্তু মিল্লাতে ইব্রাহীমির প্রাথমিক দাওয়াত এবং মিল্লাতে মুহাম্মদী (সা.)-এর সংস্কারমূলক নতুন দিকনির্দেশনা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এই স্বরূপ কয়েক হাজার বছর পূর্বে এই স্বপ্নকে দেখেছিলেন এবং দুনিয়ার সামনে এর বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন।
মানুষ আজ সারা বিশ্বের জন্য একটি মাত্র ভাষা আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্যাপৃত। কিন্তু খানায়ে কা’বার কেন্দ্রীয় ফায়সালা আলে ইব্রাহীমের জন্য দীর্ঘকাল যাবৎ এই সমস্যার সমাধান দিয়ে আসছে।
মানুষ আজ দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মাঝে একতা ও ঐক্য পয়দা করার জন্য একটি বিশ্ব মজলিস আহ্বান করার কথা আছে। কিন্তু যতদূর পর্যন্ত মুসলমানদের সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে, আজ প্রায় পনেরশ বছর যাবৎ মজলিসটি কায়েম আছে। এবং ইসলামের জ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতি, মাজহাব এবং নৈতিক একতা বিশ্বের বুকে একতার পতাকা সমুন্নত রয়েছে। আজ দুনিয়ার জাতিগুলো ‘হেগ’ভিত্তিক (হল্যান্ড) বিশ্ব আদালতের বুনিয়াদ রেখেছে। কিন্তু এই আদালতের রায় কোনও শক্তির দ্বারা প্রয়োগ করতে পারছে না। কিন্তু মুসলমানদের মাঝে একটি বিশ্বজনীন আদালত সব সময়ই কায়েম রয়েছে। যে আদালতের কুরসিতে উপবেশন করে আছেন স্বয়ং সকল বিজ্ঞানীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আহকামুল হাকেমিন। যার ফায়সালাকে অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই।
মুসলমানগণ দেড়শত বছর পর্যন্ত যতদিন এক সা¤্রাজ্যের নিয়ম-শৃঙ্খলা অথবা খেলাফতের অধীনে ছিল, এই হজের মৌসুমটি তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা, মাজহাবী নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং নীতিনির্ধারণের বড় উপকরণ ছিল। এ সময়টি ছিল এমনই যে, এর মাঝে খেলাফত সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এ সময়ে ফায়সালা করা হতো। সুদূর স্পেন হতে ভারতবর্ষের সিন্ধু-প্রদেশ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের প্রশাসকগণ ও গভর্নরগণ এ সময়ে একত্রে সমবেত হতেন। এবং খলিফার সামনে বিভিন্ন বিষয়ে শলাপরামর্শ করতেন। এখানেই কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করা হতো। বিভিন্ন দেশের প্রজা সাধারণ এ সময়ে উপস্থিত হয়ে কোনও প্রশাসকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা তুলে ধরতেন এবং খলিফা উদ্ভ‚ত সমস্যার ইনসাফ করতেন। সম্ভবত এ কারণেই হজের মাসায়েল বিবৃত করার সাথে সাথে আল্লাহপাক এ কথাও বলে দিয়েছেন যে, দেশে ফাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি করা খুবই জঘন্যতম অপরাধ। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “কোনো কোনো লোক এমন হয় যে, তাদের কথাবার্তা দুনিয়ার জীবনে ভালো মনে হয় এবং তাদের অন্তরে যা আছে এ বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী বানায়; অথচ তারা খুবই ঝগড়াটে; যখনই তারা মুখ ফিরায়, তখন দেশে দৌড়াতে থাকে, যেন দেশে অশান্তি ছড়াতে পারে, ক্ষেত-ফসল ও বংশধরদের ধ্বংস করতে পারে; অবশ্যই আল্লাহপাক ফেতনা-ফাসাদকে ভালোবাসেন না।”
(সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
এই আয়াতের দুটি আয়াত পড়েই মহান আল্লাহপাক ঘোষণা করছেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই পরিপূর্ণরূপে শান্তি ও আরামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না, কেননা অবশ্যই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫) ইসলামের আহকাম, মাসায়েল তড়িৎগতিতে একই বছরে দূর-দূরান্তের দেশগুলোতে, শহর ও নগরগুলোতে এবং মহাদেশসমূহে এমন এক সময়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল, যখন সফর, আসা-যাওয়া ও সংবাদ পৌঁছানো সহজসাধ্য ছিল না। এর বিস্তৃতি ও প্রসারের মূল চালিকাশক্তি ছিল এই হজ অনুষ্ঠান। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের জীবনের সর্বশেষ হজ যাকে বিদায় হজ বলা হয়, এই নিয়মনীতির ওপরই সম্পন্ন করেছিলেন। যে মুসলমানরা দীর্ঘ তের বছর যাবৎ মক্কা মুয়াজ্জমাতে একাকী ও কোণঠাসা ছিলেন, ঠিক তেইশ বছর পরেই সেই সুযোগ এসে গেল, যখন এক লাখ জনসমষ্টিকে খেতাব করে কথা বলার অবসর মিলল। তাদের সবাই একান্তভাবে তাঁর বাণীকে গ্রহণ করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পর খোলাফায়ে রাশেদীন, অন্যান্য খলিফাগণ, সাহাবায়ে কেরাম, সুবিজ্ঞ ইমামগণ একইভাবে প্রতি বছর একত্র হয়ে আহকামে ইসলাম শিক্ষা দিতেন এবং তাবলীগের খেদমত আদায় করতেন। এরই ফলশ্রুতিতে নিত্য নতুন ঘটনাবলী ও সমস্যা সম্পর্কে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের ফতুয়াসমূহ ও সমাধানের বিষয়াবলির খবর পৌঁছতে থাকে। এমনকি এখানো তা সমভাবে প্রযোজ্য রয়েছে।
এই কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রভাবেই বড় বড় সাহাবি, আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ফকিহগণ ইসলামী বিজয়ের সাথে সাথে দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়েন। তারা বছরের বিভিন্ন সময় পরিভ্রমণ করে হজের মৌসুমে মক্কায় এসে সমবেত হতেন। তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে ছুটে এসে হেরেমে ইব্রাহীমিতে জড়ো হতেন এবং একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে এই জ্ঞানকে এখনো পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোতে পৌঁছে দিতেন। এখানে এসেই সবাই দীক্ষা গ্রহণ করতেন। সুদূর বুখারার অধিবাসীরা, স্পেনের অধিবাসীরা, মরক্কো, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, হিজাজ, বসরা, কুফা, নিশাপুর, জর্ডান, তুরস্ক, হিন্দুস্তান, ইরান, ইয়েমেন এবং অন্যান্য দেশের অধিবাসীরা পরস্পর মিলিত হয়ে জ্ঞান চর্চা করতেন এবং জ্ঞান বিতরণ করতেন। আর এভাবে তড়িৎগতিতে সিন্ধু দেশের জ্ঞান স্পেন দেশে এবং স্পেন দেশের অভিজ্ঞান ভারতে পৌঁছে যেত। এতে করেই মিসরে লিখিত গ্রন্থাবলী ও রেওয়ায়েতসমূহ তুর্কিস্তানে এবং তুর্কিস্তানের সিদ্ধান্ত মিসরে ও সিরিয়ায় পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ত।
এভাবেই হযরত ইবনে মাসউ; (রা.)-এর শাগরিদগণ হযরত ইবনে ওমর এবং হযরত আয়েশা (রা.)-এর শিষ্যদের নিকট হতে জ্ঞানলাভ করতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর শিষ্যগণ হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর শিষ্যদের নিকট জ্ঞান চর্চা করতেন। এমনিভাবে হযরত আনাস (রা.)-এর দরবারের শিক্ষার্থীরা হযরত আলী (রা.)-এর শাগরিদগণের নিকট বিদ্যা শিক্ষা করতেন।
এটাই ছিল এমন এক মহাসম্মেলন, যেখানে ‘আইম্মায়ে মুজতাহিদীন’ পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলিত হতেন এবং একে অন্যের জ্ঞানবত্তার দ্বারা উপকৃত হতেন। এই বংশ পরম্পরা নিঃসৃত পরিচয়ের সেতুবন্ধনই ছিল মূল অবলম্বন, যার বদৌলতে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের শিষ্যগণ, দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থা ও ঘটনাবলী, যুদ্ধবিগ্রহ, আহকাম ও ফরমানসমূহ এবং অসিয়তের যাবতীয় বিবরণ বিন্যস্তরূপে এক হয়ে গেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন-চরিত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ,, আহাদীস ও তালিমসমূহ পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত হয়ে মুসলমানদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে এবং মুয়াত্তা, সহিহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিজী এবং আহাদীসের একাধিক গ্রন্থ, আত্মপ্রকাশ করেছে। আর এতে করেই আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন মাসয়ালা সম্পর্কে অন্যান্য ইমামদের খেয়ালাত ও অভিজ্ঞান সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সামগ্রিক মাসয়ালাগুলোকে পৃথক করা। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল গ্রন্থাদি প্রণয়ন করা এবং এগুলোকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা। যাতে করে এক দেশের আলেম সম্প্রদায় অন্যান্য দেশের আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনীষা সম্বন্ধে অবহিত হতে সক্ষম হয়। যুগ ও কালের চাহিদা মোতাবেক অদ্যাবধি এই সিলসিলা জারি রয়েছে।
এটা হচ্ছে সেই কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতিফল যে, সাধারণ মুসলমান যারা নিজেদের দেশে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে, তারা দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে এবং সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে, দরিয়া, পাহাড়, জঙ্গল, আবাদি এবং ময়দানসমূহ পার হয়ে এখানে একত্রিত হতেন। একে অন্যের সাথে মিলিত হতেন, একে অপরের বেদনা, দুশ্চিন্তা ও অবস্থা সম্বন্ধে অবহিত হতেন এবং এভাবেই তাদের মাঝে পরস্পর একতা, পরিচয় ও সহানুভূতির আকর্ষণ পয়দা হতো। এখানে এসেই মরক্কো, তিউনিসিয়া, হিন্দুস্তানি, তাতারী, হাবশী, ফিরিঙ্গী, আরবি, আজমী, ইয়েমেনি নজদী, তুর্কি, আফগানি, মিসরি, তুর্কিস্তানি, আলজেরিয়া, রোমান, আফ্রিকা, ইউরোপিয়ান ও বুলগেরিয়ার অধিবাসীগণ একত্রে মিলিত হতেন এবং সবাই একত্রে মিলেমিশে এক জাতি, এক বংশ, এক গোত্র ও একই খান্দানের মতো একাকার হয়ে যায়। সুতরাং এরই ফলশ্রুতিতে সাধারণ হতে সাধারণতর মুসলমান ও নিজের দেশের বাইরের জগৎকে পরিভ্রমণ করে আসতে পারেন এবং বহির্বিশ্বের সাথে পরিচিত হতে সক্ষম হয়। যুগের চাহিদা ও রং রূপ চিনতে পারেন, রাজনৈতিক জটিল চিন্তাধারা অনুধাবন করতে পারেন, আন্তর্জাতিক বিষয়াদি ও ঘটনাবলির সাথে পরিচিত হতে পারেন এবং দুনিয়ার ওই প্রান্তের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন, যেখানে প্রতিটি মীনারায় আল্লাহু আকবর ধ্বনি উত্থিত হয়। এতে করে সে আরও উদ্বেল ও উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
আর এই ফলশ্রুতিতে প্রত্যেক মুসলমান ইসলামী দুনিয়া ও ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা ও ঘটনাবলী শিশুকাল হতেই দেখতে পারে। এরই বদৌলতে সামান্য হতে সামান্যতম পদমর্যাদার অধিকারী মুসলমানগণের মাঝে এমন একটি বৃহৎ দল পাওয়া যাবে, পৃথিবী পরিভ্রমণ সম্বন্ধে সুষ্ঠু অভিজ্ঞতা আছে। স্থলপথ ও পানিপথ সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে। দুনিয়ার ভৌগোলিক অভিজ্ঞানের পরিসীমা পরিবর্ধনের ক্ষেত্রে হজ ভ্রমণ এক সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মুসলমানদের মাঝে এমন সব নাবিক, পরিব্রাজক ও ভৌগোলিক অতিবাহিত হয়েছেন, যারা মূলত হজের নিয়তেই বের হয়েছিলেন। পরিশেষে এই ভ্রমণ বিশ্ব পর্যটকের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ইয়াকুত রূসী তার ভূগোলগ্রন্থ ‘তাকবীমুল বুলদানের’ ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মুসলমানদের ভৌগোলিক জ্ঞানের উন্নতির মূলে রয়েছে হজ সফরের অভিজ্ঞতা।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।