বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আল ফাতাহ মামুন : বাংলাদেশ একটি দারিদ্র্যপ্রবণ দেশ। এদেশের অধিকাংশ যুবক বেকার। বেকারত্ব থেকে সৃষ্টি হয় হতাশা। আর হতাশা থেকে ব্যর্থতা। ব্যর্থতার সুযোগে এক শ্রেণীর দালাল হাজির হয় ভাগ্যাহত এসব মানুষের কাছে। স্বপ্ন দেখায় সোনার হরিণ খ্যাত অভিজাত চাকরি, কাড়ি কাড়ি টাকা আর সুন্দর ভবিষ্যতের। হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকা মানুষটি যেন বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পায়। খড়খুটোর মতোই পরম আশা নিয়ে আঁকড়ে ধরে মানুষরূপী দালালকে। সে হয়তো জানেও যে, এ লাইনে যারা কাজ করেন তাদের সবাই মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। জীবন বাঁচানোর, জীবন সাজানোর আশা দেওয়া এ লোকটির হাত ধরেই সেও হতে পারে পাচারের শিকার। তার জীবনেও নেমে আসতে পারে মরণ আঁধার। কিন্তু তারপরও অনেকটা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণেই অন্ধকারের পথেই পা বাড়ায় দালালের হাত ধরে।
গত সপ্তাহের কথা। পাশের বাড়ির করিম মÐলের ছেলে রহিম মÐল বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এখনো তার কোন খবর নেই। প্রিয়বন্ধু ফিরোজ আলমেরও খবর নেই ছয় মাস হলো। এসব ভাবলে মনে হয় বিদেশ না যাওয়াই ভালো। কিন্তু অভাবের তাড়না কি বুঝে এসব কথা? প্রিয় সন্তানদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। ভালোবাসার স্ত্রীর বদনখানি আরো ভয়াবহ মনে হয়। কয়েক জনমের চাওয়া ও না পাওয়ার বেদনা তাদের মুখে স্পষ্ট দেখা যায়। এমন পরিস্থিতি এক প্রকার স্বেচ্ছায়ই মানব পাচারকারীর হাতে নিজেদের সপে দেয় ভাগ্যাহত এসব নারী-পুরুষ। পাচার হওয়ার পর খুব কম ভাগ্যবান মানুষই আবার ফিরে আসেন স্বজনদের কাছে। যারা ফিরে এসেছিলেন তাদের মুখ থেকেই শুনছিলাম এসব কথা। ‘ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কেন পাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়েন’- এ প্রশ্নের জবাবেই একাধিক মানুষ এসব কথা বলেছেন।
মানব পাচার আমাদের দেশের অন্যতম সমস্যা। গত কয়েক বছরের জাতীয় দৈনিকগুলো ঘেঁটে দেখেছি, প্রায় প্রতিদিনই মানব পাচারের ওপর কোন না কোন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আর প্রতি সপ্তাহেই মানব পাচারের ভয়াবহতা ও পাচারকারীদের কর্মকাÐের ওপর ‘বিশেষ প্রতিবেদন’ ছাপা হয়েছে। গেল দু’সপ্তাহের জাতীয় দৈনিকগুলো পড়লেও মানব পাচারের ধারাবাহিক খবর চোখে পড়বে। এত প্রতিবেদন, এত পদক্ষেপ, এত গোলটেবিল বৈঠক, তারপরও লাগাম টানা যাচ্ছে না মানব পাচারের। এ যেন ক্রমেই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৪০ বছরের পাচার হওয়ার মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। এ সংখ্যা খুবই উদ্বেগজনক আমাদের জন্য। দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশী সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাচার হয়। ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র পথ পাড়ি দেওয়ার সময় ট্রলার ডুবে প্রাণহানি হয় অসংখ্য মানুষের। এছাড়া জলদস্যুদের হাতে বন্দি হয় ট্রলার। কখনো কখনো জলদস্যুরা তাদের খাবার ও অন্যান্য মালামাল লুট করে। আবার কখনো নারী ও শিশুদের নিয়ে যায় নিজেদের সঙ্গে করে। যেসব ট্রলার এ দুটি ঝুঁকি থেকে মুক্ত হয় তাদের তৃতীয় ভয় হলো সমুদ্রে পথ হারিয়ে ফেলা। একবার পথ হারিয়ে ফেললে বাঁচার আর কোন আশা নেই। খাবারের অভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনকাটে মানুষের। একটা সময় না খেয়েই মরতে হয় তাদের।
এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি এক ব্যক্তির জীবনালেখ্য নিয়ে গত মাসের শেষের দিকে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি আর আমার বন্ধু ট্রলারে ছিলাম। কয়েকদিনের না খাওয়ায় আমরা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ি। কোথায় যাচ্ছি, কী করব কিছুই জানা নেই আমাদের। তবে বুঝতে পারছি আমরা পাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়েছি। ইতোমধ্যে ট্রলারের অনেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর কয়েকজন না খেয়ে দুর্বল হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। আমার সামনেই মারা গেছে আমার প্রিয় বন্ধুও। খাবার নেই, পানীয় নেই। বাধ্য হয়ে নিজের পেশাব নিজে খেয়েছি। অনেকের কাছে শুনেছি, এমন পরিস্থিতিতে মৃত দেহ থেকে মাংস খেয়ে বেঁচে থাকার লোমহর্ষক গল্পও। একপর্যায়ে আমাদের ক’জনকে ড্রামে ভরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এরপরের ইতিহাস স্মরণ হলেই মূর্ষে যাই আমি।’
এত গেল পথ হারিয়ে ফেলার কথা। সঠিক পথে চলাও কিন্তু নিরাপদ নয় এ পথের যাত্রীদের জন্য। সঠিক পথে চলতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার ভয় থেকেই যায়। মোদ্দাকথা, সমুদ্রে পথে যারা বিদেশে পাড়ি জমাতে পা বাড়ায়, তারা মূলত মৃত্যুকে তুচ্ছ করেই সামনে এগোয়। জীবন সংগ্রামে পরাজিত এসব সাহসী সৈনিকদের একাংশকে প্রথমে থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে আটকে রাখা হয়। এরপর তাদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় পাচারকারীরা। থাইল্যান্ডের মৎস্য খামারে এসব ক্রীতদাসকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে বাধ্য করা হয়। বিবিসি, মার্কিন ম্যাগাজিন টাইম ও ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানে থাইল্যান্ডের দাস ব্যবসার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা স্তম্ভিত হওয়ার মতো। থাইল্যান্ডের চিংড়ি ও সামুদ্রিক খাদ্য শিল্পে কর্মরত সাড়ে ছয় লাখ শ্রমিকের মধ্যে তিন লাখই ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করছে। মূলত কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের নাগরিকরা পাচার চক্রের শিকারে পরিণত হয়ে এখানে এসে দাসের জীবনযাপন করে।
থাইল্যান্ডের মাছ ধরার নৌকাগুলোয় দাস শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হয়- এমন অভিযোগ উঠার পর থাই সরকার নড়েচড়ে বসে। তারা পুলিশি অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সময় দাস শ্রমিকদের উদ্ধার করে স্ব-স্ব দেশে পাঠিয়ে দেয়। গত কয়েক বছর ধরে এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম মারফত জানা গেছে। থাই পুলিশের তথ্য মতে, তাদের দেশে শতকরা আশি ভাগ দাস শ্রমিক বাংলাদেশের অধিবাসী। থাইল্যান্ড ছাড়াও মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বাংলাদেশের নাগরিক পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া এসব সদস্যের মানবেতর জীবন প্রায় উঠে আসে পত্রিকার পাতায়। অনেক ক্ষেত্রে পাচার হওয়াদের স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। যে পরিবারের লোকটি পাচার হয়েছে তা তো এমনিতেই দরিদ্র। তার ওপর আবার চাওয়া হচ্ছে মুক্তিপণ। এ যে কত নির্মম ও যাতনার ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।
পুরুষের পাশাপাশি পাচার হচ্ছে নারী ও শিশুরাও। বলতে গেলে নারী ও শিশু পাচার পুরুষ পাচারের চেয়ে বেশি ভয়ংকর। পাচার হওয়া নারী ও শিশুর অধিকাংশকেই যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের নারীদের পাচার করা হয়। এদের কাউকে বিক্রি করা হয় পতিতালয়ে আবার কাউকে বিক্রি করা হয় ব্যক্তি মালিকানায়। যেভাবেই হোক নারী ও শিশু পাচার কোনভাবেই কল্যাণকর নয় মানব ভাগ্যে।
মানব পাচারের শিকার হয় দুই কারণে। একটি প্রথমে উল্লেখ করেছি- দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। আরেকটি কারণ হলো অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ যথেষ্ট অজ্ঞ ও অসচেতন। পাশাপাশি দরিদ্র ও বেকারও। তাই মানব পাচার রোধে যেকোন কার্যকর পদক্ষেপ হাতে নেয়ার আগে এ সমস্যাগুলোর শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। এতে করে শুধু মানব পাচারই নয়- অন্যান্য বড় সমস্যাও দূর হবে। মানব পাচার রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো তৎপর হবে, সচেতন হবে সাধারণ মানুষদের, তৈরি করতে হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।