বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মহিউদ্দিন খান মোহন : ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের আগে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল না। বলা যায়, আলাপ পরিচয়ও ছিল না। তবে আমি তাকে চিনতাম। এই চেনা ছিল একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে একজন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী যতটুকু চেনে ততটুকু। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৭৭ সালে। তিনি তখন ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা। আমার বড় ভাই গিয়াস উদ্দিন খান বাদল (বর্তমান মরহুম) তখন ভাসানী ন্যাপের বৃহত্তর ঢাকা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। একদিন রিকশায় আরমানিটোলা এলাকা দিয়ে আসার সময় একটি নেমপ্লেট দেখিয়ে বললেন, উনি একজন বড় নেতা। দেখলাম টিনের একটা ছোট সাইন বোর্ডে লেখা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
আমার বড়ভাই খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে বড় নেতা বলেছিলেন। কিন্তু তখন আমি ধারণা করতে পারিনি তিনি কত বড় নেতা। তাকে ভালোভাবে জানার সুযোগ হলো ২০০৭ সালে। এক দুর্যোগময় সময়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বিএনপি চেয়ারপারর্সন বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে তাকে মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়ে যাবার পর আমি তার সঙ্গে দেখা করি। তাকে বলি যে, ম্যাডামের মিডিয়া সংক্রান্ত কাজগুলো আমি এতদিন করেছি। এখন আপনার সঙ্গে থেকে এই কাজগুলো করতে চাই। এ বিষয়ে ম্যাডামের নির্দেশও রয়েছে আমার ওপর। আমি তাকে এটাও বললাম যে, আমি ম্যাডামের সহকারী প্রেস সচিব ছিলাম। তিনি বললেন, তোমাকে দেখেছি পার্লামেন্টে ম্যাডামের অফিসে। ঠিক আছে কাজ করো। তারপর দু’টি বছর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মতো একজন প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী এবং সাহসী নেতার সঙ্গে আমি কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তার সঙ্গে কাজ করার বছর দু’টি আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় বলে আমি মনে করি। কেননা, তার সান্নিধ্য, তার ¯েœহ, শাসন, দিক নির্দেশনা আমার রাজনৈতিক চলার পথে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছে। যা জানা ছিল না, তা জেনেছি। যা শেখার বাকি ছিল তার অনকেটাই শিখে নিয়েছি। তার কাছ থেকে শেখেছি কীভাবে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। তার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে অর্পিত দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সাথে পালন করতে হয়। তার কাছ থেকে শিখেছি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কীভাবে দলকে রক্ষা করতে হয়। এসব শিক্ষা আমার জীবনের বড় সম্পদ হয়ে আছে।
আজ দেলোয়ার ভাই নেই। কত কথা মনে পড়ে তাকে নিয়ে। মৃত্যুর পর তিনি যে সম্মান পেয়েছেন তা অনেকের ভাগ্যেই হয় না। তার প্রতিটি নামাজের জানাজায় হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ সাধারণ নেতাকর্মী আর জনগণের মধ্যে তার বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতারই প্রমাণ। আমি আরমানিটোলার নামাজে জানাজায় অংশ নিয়েছি। সেখানে দেখেছি সাধারণ মানুষের অশ্রæসিক্ত নয়ন। এই নিভৃতচারী জননেতা যে এলাকাবাসীর কতটা আপনজন ছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আরমানিটোলা থেকে মানিকগঞ্জের পাঁচুরিয়া পর্যন্ত শোকার্ত মানুষের বিশাল বিশাল সমাবেশে।
আমার দৃৃষ্টিতে একজন অসীম সাহসী লোক ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তার এই সাহসের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ২০০৭ সালের ২৯ অক্টোবর রাতে। জরুরি সরকারের হুমকি-ধমকিকে থোড়াই কেয়ার করে তিনি তার সংকল্পে অটল ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় বারডেম হাসপাতাল থেকে দলের কর্মী জাহাঙ্গীর আলম মিন্টুর শ্বশুরের বাসা খিলগাঁওয়ে আত্মগোপন করেছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ফলে ওই রাতে এম সাইফুর রহমানের বাসায় ষড়যন্ত্র বৈঠকে ‘কমপলসারি’ উপস্থিত থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ব্যক্তিদের ‘ইউ উইল বি কিল্ড অ্যান্ড ইউর ফ্যামিলি ইউল বি ডেস্ট্রয়েড’ (আপনাকে হত্যা করা হবে এবং আপনার পরিবারকে ধ্বংস করা হবে) এমন হুমকি পাওয়ার পরও যিনি দল ও নেত্রীর প্রতি আস্থাশীল থেকে দায়িত্ব পালনে অটল থাকেন, তাকে অসীম সাহসী না বলে উপায় কী? বলতে দ্বিধা নেই, সেই সময়ে জরুরি সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের অমন হুমকি উপেক্ষা করার সাহস বাংলাদেশে অনেকেরই ছিল না।
সব তো চাখের সামনেই ঘটতে দেখেছি। কে, কী করেছেন, বলেছেন সব কিছুর সাক্ষী তো এদেশের মানুষ। একজন অসুস্থ মানুষও যে শিরদাড়া সোজা করে, মাথা উঁচিয়ে প্রতিরোধ লড়াইয়ে সিপাহ্সালারের ভূমিকা পালন করতে পারে, ২০০৭ সালের ২৯ অক্টোবরের খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে না দেখলে তা বিশ্বাস করার উপায় নেই। তার ওই ভূমিকার চমৎকার মূল্যায়ন করেছিলেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের একজন নেতা। চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া জরুরি সরকারের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হওয়ার পর শ্রমিক দল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ওই শ্রমিক নেতা বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম আপনি জেলে থাকা অবস্থায় ঢাকার একটি ব্যাংকে লকার ভেঙে ডাকাতি হয়েছে। কিন্তু আপনি বিএনপিকে এমন এক লকারে রেখে গিয়েছিলেন, যে লকার ভাঙা তো দূরের কথা, কেউ তা স্পর্শও করতে পারেনি। সেই লকার মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন’। উল্লেখ্য, ওই অনুষ্ঠানে দেলোয়ার ভাই উপস্থিত ছিলেন না। জরুরি সরকারের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত থেকে বিএনপি ও জিয়া পরিবারকে রক্ষায় খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ভূমিকার এটাই সবচেয়ে সঠিক মূল্যায়ন আমার বিবেচনায়। কিন্তু সেদিন এতোটা সাহস ও শক্তি তিনি পেয়েছিলেন কীভাবে? কথাটি আমি ভেবেছি অনেক। জবাবও পেয়েছি। দল ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা, অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিশ্বস্ততা আর বিবেকের কাছে জবাবদিহিতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে সেদিন ওই রকম দুঃসাহসী করে তুলেছিল। পরে বিভিন্ন সময় আলাপচারিতায় তিনি আমাকে বলেছেন, ‘ম্যাডাম আমাকে বিশ্বাস করে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, জীবনের বিনিময়ে হলেও তা পালন করা আমার কর্তব্য। এ কথা তিনি ৩০ অক্টোবর বারডেম হাসপাতলের বেডে শুয়ে গণমাধ্যমকেও বলেছিলেন। আজ তার অবর্তমানে তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তার মৃত্যুর পর দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তার সততা, দৃঢ়তা এবং গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থার প্রশংসা করেছেন। ১৮ মার্চ ২০১১ শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় নামাজের জানাজা শেষে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘প্রবীণ রাজনীতিবিদ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে’। হ্যাঁ, অনেক কিছু শেখার আছে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জীবন থেকে। গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা, দলীয় আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি আগাধ শ্রদ্ধা ও সঙ্কটময় মুহূর্তে দলকে বাঁচাতে সাহসী সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, অল্পে তুষ্ট থাকা এবং ব্যক্তিগত জীবনে সৎ থাকা ও সাধারণ জীবন-যাপনের যে উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়েই থাকবে।
অল্পতেই তুষ্ট ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। দল যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে সন্তুষ্ট চিত্তে সে দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। তিনবার জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ এবং একবার বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ ছিলেন তিনি। দলের কাছে আরো বড় কোনো কিছুর জন্য বায়না ধরেননি, গোস্বা করেননি। কতজনকে দেখেছি কেউ কিছু না পাবার যন্ত্রণায়, কেউ পেয়ে হারানোর বেদনায়, কেউ আবার আরও বড় কিছু পাবার আশায় দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পেছন থেকে ছুরি মেরে দলকে রক্তাক্ত করে সেই রক্ত পিচ্ছিল পথে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের যড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন কখনও সে পথে যাননি। সব সময় দলের ও দলীয় নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন।
আজীবন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের রাজনৈতিক জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল সময় আমার বিবেচনায় জরুরি সরকারের আমলটি। ওই সময়ে দৃঢ় ভূমিকার জন্য তিনি জাতীয় পরিচিতি পেয়েছিলেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন সাধারণ মানুষও জেনে গেছে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের নামটি। ওই সময় সাহসী ভূমিকা পালন করে তিনি শুধু বিএনপি ও জিয়া পরিবারকেই রক্ষা করেননি, এদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও গণতন্ত্রকে সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। জরুরি সরকারের যড়যন্ত্র যদি সফল হতো, তাহলে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো। সেদিন ওই সরকারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চীনের মহাপ্রাচীরের ন্যায় শক্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার এই ভূমিকার জন্য দেশের একজন প্রবীণ সাংবাদিক, তাকে ‘প্রবীণ সাহসী যুবক’ অভিধায় অভিহিত করেছিলেন। এই অভিধা শতভাগ স্বার্থক।
বিএনপির সবচেয়ে দুর্যোগময় সময়ের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের কর্মময় জীবনের কথা এই স্বল্প পরিসরে স্ববিস্তারে বলা সম্ভব নয়। ২০১১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে প্রকাশিত আমার ‘জরুরি অবস্থা, বিএনপি ও কিছু না বলা কথা’ বইতে তার সর্ম্পকে কিছুটা আলোকপাত করেছি। উল্লেখ্য, ওই বইটি উৎসর্গ করেছি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে। যেদিন বইটি তার হাতে দিলাম, কী যে খুশি হলেন তিনি! ভাবীকে (তার স্ত্রী) ডেকে বললেন, ‘দেখো, মোহন ওর এই বইটা আমাকে উৎসর্গ করেছে!’ আমি সেদিন তার চোখের কোণে আনন্দাশ্রæ দেখেছি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘খুব বড় একটা কাজ তুমি করেছো।’ আমি তোমার জন্য দোয়া করি। তারপর বললেন, ‘আমার শরীর খুব খারাপ, সময় পাব কিনা জানি না! তবে আমার সারাজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা বই লেখার ইচ্ছে আছে। তুমি আমাকে সহযোগিতা করবা।’ আমি দেলোয়ার ভাইকে কথা দিয়েছিলাম, আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর আমি আপনার কাজটি করে দেবো। আপনি বলবেন, আমি লিখবো। দেলোয়ার ভাইকে দেয়া সে কথা আমি রাখতে পারিনি। তার আগেই ২০১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
তার কথা ভাবলে কষ্ট হয়। আর কোনো দিন তার সঙ্গে দেখা হবে না। ড্রয়িং রুমে বসে ভেতরে খবর পাঠালে সেই ¯েœহার্দ্র কণ্ঠ আর ভেসে আসবে না- ‘মোহন ভিতরে চইলা আসো’। আন্তরিক সেই হাসি দিয়ে ¯েœহমাখা কণ্ঠে আর বলবেন না-‘চা খাবানি এক কাপ?’
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।