বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আহমেদ জামিল : বাংলাদেশের মূলধারার প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি অনেক দিন ধরে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে নীরব থাকার পর হঠাৎ করে সক্রিয় হতে শুরু করেছে। দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি দেশ-জাতির মৌলিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথেও নামতে চাইছে। মূলত আসন্ন সাধারণ নির্বাচন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বিএনপি দলকে নতুন করে গোছাতে শুরু করেছে। গত ২৬ ফেব্রæয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে ‘দল গোছাচ্ছে বিএনপি’ শিরোনামে এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, “আন্দোলন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে দ্রæত দল গোছাচ্ছে বিএনপি। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সারা দেশে জেলা পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠন চলছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় নেতৃবৃন্দকে ঢাকায় ডেকে এনে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া কমিটি তৈরি করছেন। পরে দলের চেয়ারপারসন এই খসড়া পর্যালোচনা করে চ‚ড়ান্ত করছেন।”
গণতন্ত্রের লেবাসধারী এবং কার্যত এক নায়কতন্ত্রী সরকার বিএনপিকে সামান্য গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদানেও নানা কার্পণ্য দেখাচ্ছে। বিএনপিকে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং এ বছরের ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি সরকার। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের নিশ্চিত বিজয় ছিনতাই করে অবৈধ পন্থায় ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হত্যা, গুম, অপহরণ, মামলা, জেল-জুলুম অব্যাহত রেখেছে। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং অন্যান্য বিএনপি নেতাকে নানা মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়ে তাদের নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার অযোগ্য ঘোষণা করতে চাইছে সরকার।
অর্থাৎ নেতৃত্বশূন্য করে কোমরভাঙা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়াতে চাইছে শেখ হাসিনার সরকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ মোকাবিলা এবং নির্বাচনকে বৈধতা দানের জন্য সরকার ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়াতে চাইছে। চাইছে ৫০টিরও কম আসনে বিএনপি প্রার্থীদের জয়ী করে জাতীয় সংসদে নামকাওয়াস্তে বিএনপিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে রাখতে। এভাবে দেশে-বিদেশে নির্বাচন এবং তথাকথিত নির্বাচিত সরকার দুইয়েরই বৈধতা অর্জন করা যাবে। এ প্রক্রিয়ায় আরো কয়েক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার নীলনকশা তৈরি করেছে সরকার। মনে হয়, বর্তমান সরকারের এ নীলনকশার বিষয়ে বিএনপি জ্ঞাত। যে কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোট শরিকদের ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ দিতে চাইছে না বিএনপি হাইকমান্ড।
সরকারের তরফ থেকে সৃষ্টি করা নানা প্রতিক‚ল পরিস্থিতির মাঝেও বাস্তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দলকে সুসংগঠিত করা ও পুনর্গঠনের পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ শক্তভাবে মোকাবিলার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে গত ৪ ফেব্রæয়ারি দৈনিক যুগান্তরে ‘চাপের মুখে দল গোছাচ্ছে বিএনপি’ শিরোনামে আরেক রিপোর্টে বলা হয়, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘরোয়াভাবে প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে একটি কর্ম পরিকল্পনাও তৈরি করেছে বিএনপি হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে পুরোদমে চলছে দল পুনর্গঠনের কাজ। নির্বাচনে ইতিবাচক ফল আনতে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সব উইং। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধেক সাংগঠনিক জেলায় নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ... এ ছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই হাইকমান্ডের সবুজ সংকেত পেয়ে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত যাওয়া-আসা শুরু করেছেন।”
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আরো একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হলো সংস্কারপন্থিদের দলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। সংস্কারপন্থি নেতাদের সবাই যে বিশ্বাসঘাতক নন এ সত্য দেরিতে হলেও বেগম জিয়া উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সংস্কারপন্থিদের উল্লেখযোগ্য অংশ নেতা হিসেবে সৎ, দক্ষ সংগঠক এবং তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় এদের অনেকেই দলের বাইরে থাকলেও অন্য কোনো দলে যোগ দেননি। শহীদ জিয়ার আদর্শকে তারা বুকের ভিতর লালন করে গেছেন। বিএনপি একটি জনপ্রিয় দল। এক দশকের বেশি সময় কাল ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিএনপির জনপ্রিয়তায় সামান্য ছেদ পড়েনি।
অন্যদিকে দু-একজন নেতা ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউই দল ত্যাগও করেননি। ক্ষমতাসীনদের নানা চাপ ও প্রলোভন উপেক্ষা করেছেন তারা। জনপ্রিয়তা ধরে রাখার পাশাপাশি দলের ঐক্য অটুট রাখা ও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির একটি বড় ধরনের সাফল্য। নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে ধাক্কা খেয়ে বিএনপি নেতৃত্বের সচেতন অংশ বুঝতে পেরেছেন কোনো বিদেশি শক্তির আশীর্বাদ নিয়ে নয়, জনগণের শক্তির ওপর ভর করেই রাজনৈতিক সাফল্য হাসিল করা সম্ভব। ভারতের পানি আগ্রাসন, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান, শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে সুন্দরবন ধ্বংসের পাঁয়তারা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ন্ত্রণ ও কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং সেই সাথে দফায় দফায় গণস্বার্থ বিরোধী তেল বা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে দুর্বল রাজনৈতিক শক্তির বাম দলগুলো রাজপথে সোচ্চার হলেও ব্যাপক জনপ্রিয় বিএনপি এসব বিষয়ে যথাযথ প্রতিবাদ না করায় সমালোচিত হয়েছে।
ধারণা করা যায়, বিএনপি নেতৃত্বের বড় অংশ এখন এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যে কারণে জনস্বার্থ সম্পৃক্ত ইস্যুতে বিএনপি মাঠে নামছে। সরকারের অযৌক্তিক গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ করে সামনে এগোনোর বিষয়ে যদি এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয় তাহলে একে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। আবার বিএনপিকে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, শুধু জনপ্রিয়তাই যথেষ্ট নয়, একটি দলকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে হলে সাংগঠনিক শক্তিরও প্রয়োজন। কয়েক দশকের প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির মূল ধারার দ্বিদলীয় রাজনীতিতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও সাংগঠনিকভাবে এখনও দুর্বল। যে কারণে রাজপথে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়তে সক্ষম হয়নি বিএনপি।
তাই দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। জনগণের মৌলিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবি-দাওয়ার সাথে বিদেশি শক্তির কাছে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবিসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটের অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে বিএনপি যদি রাজপথের আন্দোলন শুরু করে এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখে একপর্যায়ে তার প্রতি জনগণ শুধু সাড়াই দেবে না, ব্যাপকহারে সম্পৃক্তও হবে। একমাত্র নিয়মতান্ত্রিক তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের টনক নড়ানো সম্ভব হবে। কারণ এতে করে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী মহলের চাপ বৃদ্ধি পাবে।
নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারসহ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে সরকার বিএনপি ও তার জোট সঙ্গীদের সাথে সংলাপ শুরু করতে বাধ্য হবে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলের সাথে সংলাপ শুরু করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের তরফ হতে আহŸান জানানো হয়েছে। একক পরাশক্তির এ ধরনের আহŸানকে চাপ বলতে হবে। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে বলা হচ্ছে, আসন্ন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন শুধু নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাই নয়, শেখ হাসিনা সরকারের জন্যও অগ্নিপরীক্ষা। আর বিএনপির জন্যও তা ইস্যু সৃষ্টি করতে পারে। এই নির্বাচনে জয়ী হলে বিএনপির মধ্যে আত্মবিশ্বাস আরো বাড়বে। ইতোমধ্যে ঢাকা বারের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের বিশাল বিজয় দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে।
অন্যদিকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হেরে গেলে বিএনপি তখন বলতে পারবে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিব উদ্দিনের মতো বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও সরকারের ক্রীড়নক। স্থানীয় সরকারের মতো সরকারের তল্পিবাহক এই নির্বাচন কমিশনের দ্বারা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। ফলে বিএনপি হাতে পেয়ে যাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করার ইস্যু। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও এ দাবির গ্রহণযোগ্যতা পাবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বাংলাদেশের মানবাধিকার রিপোর্টে বিব্রত শেখ হাসিনার সরকার। এদিকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে ইইউসহ মার্কিন ক‚টনীতিকরা। বিএনপিকে এই সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করতে হবে।
য় লেখক : কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।