বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘আবার রমরমা এমএলএম ব্যবসা, দুই ডজন হায় হায় কোম্পানির বিপুল অর্থ পাচার, সব হারিয়ে পথে অনেকে’। এই সংবাদটি পড়ে গত এক দশক আগের কথা মনে পড়ছে। সউদি প্রবাসী এক ভাই দেশে অবস্থানরত তার এক ভাইয়ের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠাত। প্রবাসী ভাইয়ের প্রেরিত টাকাগুলো সে ‘কর্ম কর্মসংস্থান সোসাইটি’ (যুবক) এর কাছে আমানত রেখে অধিক মুনাফা ভোগ করেন। এর কিছু দিন পরেই জানা গেল যুবক নামের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ওই এলাকার সবাই পলাতক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তাদের সকলের টাকাই দেউলিয়া হয়ে গেছে। অধিক লাভ ও মুখরোচক গল্প শুনে এভাবে গোটা দেশের কয়েক লাখ মানুষ প্রতারণার শিকার হয়। প্রবাসী ব্যক্তি আট বছর পর দেশে এলো প্রায় শূন্য হাতে। এই ধরনের সমস্যা নিয়ে অসংখ্য পরিবার আর্থিক সমস্যায় পড়ে মানসিক যন্ত্রণায় পথে পথে ঘুরছেন।
এসব প্রতারণার খবর জেনে-শুনেও বাস্তবতা থেকে শিক্ষা না নেয়ায় ডেসটিনি নামের প্রতিষ্ঠানটি লক্ষ লক্ষ গ্রাহককে সর্বস্বাস্ত করে দিল। এই ধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের সাথে তারা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখিয়ে মনোযোগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। এমএলএম বিষয়ে যারা লেকচার দেন তাদের লেকচারগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে খুব সহজেই একজন মানুষ আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অধিক মুনাফর লোভ দেখিয়ে শিক্ষার্থী, সহজ-সরল তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করা হয়। ধর্মীয় কারণে মাদরাসা শিক্ষিত লোকদের প্রতি মানুষের ইতিবাচক ধারণা থাকার কারণে গ্রামাঞ্চলে কথিত হুজুরদেরই এমএলএম এর সাথে যুক্ত করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের বলা হয় এমএ পাস করার পর সামান্য বেতনে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। তাই এমএলএমের সাথে যুক্ত হয়ে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে পারলে আপনি যে কমিশন পাবেন সেটাই আপনার জন্য যথেষ্ট হবে।
আবার অনেকের অভ্যাস হলো অতিরিক্ত কথা বলা, ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকা। হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করা। এমএলএমে সফল হওয়ার জন্য তারা নগদ টাকা, বাইসাইকেল, হুন্ডা কিংবা প্রাইভেট গাড়ি অথবা এর চেয়েও বড় কোনো কাল্পনিক চিত্র সামনে রেখে মানুষদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেন। কারো কারো ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি করার কথাও শোনা যায়। আমি একজন ব্যক্তি সম্পর্কে জানি, যে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের জোর করে এমএলএম কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করতে না পেরে একপর্যায় বলেই ফেললো ‘আমার চাচা ও ভাইয়েরা যদি ডেসটিনির সদস্য না হয় তাহলে তাদের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকবে না’। ডিসটিনি যে না করবে তার সাথে যোগাযোগ রাখা হবে না- এ যেন এক আজব কারবার। মানুষ কতটা অজ্ঞ হলে এমন বিবেকবর্জিত কথা বলতে পারে!
কিন্তু ‘ডিসি সম্মেলন-২০১৬’-এর দ্বিতীয় দিনে বাণিজ্যমন্ত্রী নতুন করে আর কোনো এমএলএম কোম্পানিকে অনুমোদন না দিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়ার পরও প্রায়সময়ই অর্থ আত্মসাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ‘ঢাকার আশপাশে এমএলএম ব্যবসার ফাঁদ’ শিরোনামে তুলে ধরা হয়েছে গাজীপুর জেলার নিউ সাকসেস বিডি প্রা. লি., এম টাস বিডি লি. এবং লাইফওয়ে বাংলাদেশ লি. নামের এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বিভিন্ন ব্যাংকে ডিসটিনি গ্রæপের ৫৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকায় ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীর টাকা না পাওয়ার কথাই শোনা যাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্যের আকাশচুম্বি দাম হাঁকিয়ে ফায়দা লুটে নিয়েছে। জয়েন্ট স্টকের অনুমোদন ও নামের ছাড়পত্র নিয়ে আমদানি-রপ্তানি, হারবাল পণ্য উৎপাদন, বিক্রি, আইটি, বৃক্ষে বিনিয়োগ, অদৃশ্য স্বর্ণ ব্যবসা, ব্রেসলেট ইত্যাদি পণ্যকে ঘিরে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। যার মুখের জোর যত বেশি সে তত সফল। নতুন কোনো এলাকায় গিয়ে কিছু লোকজন নিয়ে একটি সেমিনার করে সাফল্য লাভের কিছু গল্প শুনিয়ে আশা জাগায়। আলোচনার জন্য কতিপয় নামধারী মাওলানা, ইমাম, শিক্ষকদের হায়ার করে মানুষের মাঝে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করা হয়। এভাবেই অল্প সময়ে তারা মানুষদের ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হয়।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কথার সাথে প্রতারণা, হায় হায় কোম্পানি শব্দগুলো খুবই সম্পর্কযুক্ত। এমএলএম বা বহুজাত বিশিষ্ট পণ্য বাজারজাত পদ্ধতি কথাটি শুনলেই আঁতকে উঠতে হয়। এলএমএল কোম্পানিগুলির কর্মকাÐ শুরু থেকেই বিতর্কিত হয়ে আসছে। হুন্ডা কিংবা গাড়ি পাওয়ার লোভনীয় অফার লুফে নিতে এক শ্রেণীর প্রতারক সর্বদাই সবখানে ছুটে বেড়াচ্ছেন। শুধু ডেসটিনি কর্মী নয় এমএলএম কর্মীদের সদস্য সংগ্রহের একটি চিত্র হলো: পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, কাছে ও দূরের আত্মীয়, পিতৃকুল, মাতৃকুল অথবা সেসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছে সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ক্লাসমেট, জুনিয়র ও সিনিয়র ভাই কিংবা যাদের সাথে জীবনের কোনো না কোনো সময়ে পরিচয় হয়েছে এমন সবার কাছেই এমএলএম পদ্ধতির কথা তুলে ধরে ভুলভাল বুঝিয়ে তাদের সদস্য করতে মরণপণ চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া যে এলাকায় যিনি সবচেয়ে সম্মানীত ব্যক্তি তাকে তারা আগেই ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। তার কারণ, সেই ব্যক্তিটিকে বুঝিয়ে সদস্য করতে পারলেই অন্যদের কাছে তার নাম প্রচার করে সাধারণ মানুষদের যুক্ত করা সহজ হয়। আর সেই ব্যক্তিটি যদি আলেম বা কোনো মসজিদের ইমাম হন তাহলে তো বলেই বেড়ান এমএলএম পদ্ধতি যদি বৈধ না হতো তাহলে অমুক ব্যক্তি এর সাথে যুক্ত হলো কীভাবে? এ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় এটি ভালো ও বৈধ। এভাবেই নামে-বেনামে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানি। প্রতিনিয়ত এই ধরনের কোম্পানির আত্মপ্রকাশ যেমন ঘটছে তেমনি কিছু দিন পর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান উধাও হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও নগদ লেনদেনের মাধ্যমে আসল ঘটনা চাপা পড়ে যায়। ‘২০০২ সালে দেশে এমএলএম কোম্পানি ছিল ১৬টি, ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪টিতে। বর্তমানে সরকারি হিসাবে ৬৯টি এমএলএম কোম্পানির অনুমোদন থাকার কথা বলা হলেও দেশে দুই শতাধিক এমএলএম কোম্পনি কাজ করছে’ (আমাদের সময় ডটকম, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬)। ইতোমধ্যে যারা প্রতারিত হয়েছেন তারা কেউই তাদের টাকা বুঝে পাননি। এমএলএম প্রতিষ্ঠনগুলোর পদক্ষেপগুলো জানলে প্রাথমিকভাবে মনে হবে এটাই সবচেয়ে উত্তম বিনিয়োগ। যেমন: সার্ভিস চার্জ ও শপিংমল, গাছের বাগান, প্লট বিক্রি বা ফ্লাট বিক্রি, প্রশিক্ষণ, হারবাল পণ্য, চড়া দামে পণ্য বিক্রয়, নামে প্রতারণা, দশ মাসে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রæতিসহ অনলাইনে আউট সোর্সিংয়ের নামে প্রতারণা করার কথা বার বার গণমাধ্যমে উঠে আসছে।
এমএলএম নামের প্রতারণার অবসান হোক এটা সবাই চায়। কিন্তু কেউ মাঠপর্যায়ে ভূমিকা রাখছে না। স্বল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফাÑ এটাই প্রতারণার বড় কৌশল। কারো লাইসেন্স নেই আবার কারো লাইসেন্স থাকলেও স্বচ্ছতা নেই। যাদের মধ্যে সামান্যতম চেতনাবোধ জাগ্রত আছে তাদের পক্ষে এমএলএম পদ্ধতির সাথে যুক্ত হওয়া মানে বিবেকবিরোধী কাজ করা। মানুষের মাঝে আশা থাকবে এটা স্বাভাবিক। তাই বলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হবেÑ এমনটি হওয়া ঠিক নয়। সর্বোপরি, নিজের আত্মমর্যাদাবোধ না থাকলে তাদের পক্ষেই হয়তো এ ধরনের প্রতারণামূলক কাজের সাথে জড়িত হওয়া মানানসই।
য় লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।