বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. আহমদ আবদুল কাদের : ২০১৭ সালের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বাংলা বইয়ের সিলেবাসে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কী সে পরিবর্তন? বস্তুত ২০১৩ সালের পর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বাংলা বইয়ের সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। ইসলাম ও মুসলিম ভাবাপন্ন প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা পরিবর্তন করে তদস্থলে নাস্তিক্যবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প পাঠ্যবইয়ে ঢুকানো হয়। এর বিরুদ্ধে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় প্রতিনিধি আলেম সমাজ, হেফাজতে ইসলাম, বেফাকুল মাদারিস ও ইসলামী দলগুলো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা মিছিল মিটিং ও মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা অবিলম্বে যেসব ইসলামী ভাবাপন্ন বিষয় সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে তা পুনরায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানায়। আর যেসব ইসলাম বিদ্বেষী গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা সংযোজন করা হয়েছে তা অবিলম্বে বাতিলের দাবি তোলে। এমনকি আওয়ামী লীগের ওলামা সংগঠন ওলামা লীগও পাঠ্যপুস্তকের ইসলাম বিদ্বেষী বিষয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে প্রতিবাদ জানায়। মোটকথা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার এটি প্রাণের দাবি হয়ে দাঁড়ায়। পরিশেষে সরকার এসব দাবির যৌক্তিকতা বুঝতে পারেন। ফলশ্রুতিতে ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসে এর অনেকটা প্রতিফলন ঘটে।
কিন্তু এতে ধর্মহীন তথা সেক্যুলার হিসাবে পরিচিত শ্রেণী বেজায় ক্ষেপেছে। তারা এসব পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে আরম্ভ করেছে। পাঠ্যপুস্তকের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে ৮৫ জন তথাকথিত ‘প্রগতিশীল বিশিষ্ট ব্যক্তি’ এক যৌথ বিবৃতি দিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, “মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্যপুস্তকে এই উদ্দেশ্য প্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ভয়ানক বিস্তার রয়েছে তা গত কয়েক বছর ধরেই স্পষ্ট। এ বছরের পাঠ্যপুস্তক সেই সাম্প্রদায়িক অপরাজনীতির সঙ্গে সরকারের আপসরফারই চ‚ড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ... তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি সাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্যে কাজটি করে চলেছেন।” (প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি সংখ্যা)। একজন কট্টর ধর্মবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ পরিবর্তন প্রসঙ্গে বলেছেন “হেফাজতকে রাজনৈতিকভাবে ছাড় দেয়া হয়েছে। এটা ভোটের রাজনীতির অংশ। তবে এই আপসকামিতা কারো জন্য সুখকর হবে না।” (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি সংখ্যা)। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন দৈনিকে কলামও লিখা হচ্ছে। এক ভদ্রলোক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “আমরা সবাই জানি দ্বিজাতি তত্তে¡ও ভূত মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির মনস্তত্ত¡ থেকে সম্পূর্ণ ছাড়াতে পারেনি...” (প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি “বড় হওয়ার শিক্ষা কত দূর?” শীর্ষক কলাম)। আরেক কলামে প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা হায়দার আকবর খান রনো আক্ষেপ করে বলেছেন, “পাঠ্যপুস্তক-সংক্রান্ত এই ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে সরকার হেফাজতে ইসলামের কাছে ক্রমাগত আত্মসমর্পণ করে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে আসছে” (প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি)। প্রথম আলোর ২ মার্চ এর সংখ্যায় তিনি আবারো লিখেছেন, “পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে খন্ডন করেই আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এবং বিজয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু পাকিস্তানি ভাবধারা যদি আবার ফিরে আসে; বিশেষ করে শিক্ষাক্রমের মধ্য দিয়ে, তাহলে আমাদের অর্জিত বিজয়ও যে হারিয়ে যাবে, তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়” (দৈনিক প্রথম আলো, ২ মার্চ)। তিনি একই নিবন্ধে আক্ষেপ করে বলেছেন, “এখন দেখা যাচ্ছে জামায়াত হলো মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জোটসঙ্গী। আর প্রায় একই ভাবাদর্শের হেফাজত সম্প্রতি হয়ে উঠেছে শাসকদল আওয়ামী লীগের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত দল, যাদের পাঠ্যপুস্তক-সংক্রান্ত নীতির সবটাই সরকার মেনে নিয়েছে।” (ঐ)
এরপর রনো সাহেব যেসব গল্প ও প্রবন্ধের পরিবর্তন এসেছে তার একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন। কিন্তু যেসব গল্প ও প্রবন্ধের জায়গায় এসব গল্প ও প্রবন্ধ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল এসব বিষয় এড়িয়ে গেছেন। কারণ তা হলেতো তার ধর্ম বিদ্বেষের জারিজুরি প্রকাশ হয়ে যেত।
আরেক সাংবাদিক খোলা চোখে “পাঠ্যপুস্তকেও সাম্প্রদায়িকতার ভূত” শীর্ষক কলামে আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘একদম প্রথম শ্রেণি থেকেই যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের ধর্মের বাঁধনে আটকে ফেলা যায়, তাহলে পাকিস্তানের দেখানো পথে তর তর করে এগিয়ে যেতে আমাদের খুব বেগ পেতে হবে না’ (প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি সংখ্যা, পৃ. ১০)। এসব থেকে এটি স্পষ্ট যে ঐসব বুদ্ধি বিক্রেতাদের টার্গেট হচ্ছে দেশের ৯০% জনগণের ধর্ম ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়। তারা বাংলাদেশের জনগণের মুসলিম পরিচয় সহ্য করতে পারছে না।
আমাদের ধর্মবিদ্বেষী বাম-ডান উভয়প্রকার বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের একটা সাধারণ রোগ হচ্ছে : ইসলামের নাম শুনলেই তারা সাম্প্রদায়িকতা আবিষ্কার করে বসেন। আমাদের জিজ্ঞাস্য : এদেশের শতকরা ৯০% ভাগ লোক যে ধর্মে বিশ^াস করে সে ধর্মের বিষয়কে সাম্প্রদায়িকতা বলা কতটুকু যৌক্তিক? ইসলাম বাদ দিলেই অসাম্প্রদায়িকতা, ‘হিন্দু বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদ’ করলে অসাম্প্রদায়িকতা আর ইসলাম ও মুসলিম ভাবাদর্শ হলেই সাম্প্রদায়িকতা এটা কেমন কথা?
যেসব কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ ’১৩ সালের পূর্বেও সিলেবাসে ছিল তা যদি আবার ফিরিয়ে আনা হয় তাহলে সাম্প্রদায়িকতা আবিষ্কারের কী আছে? বৃহত্তর সম্প্রদায়ের ভাবাদর্শেও অনুকূল বিষয় বাদ দিয়ে এর প্রতিক‚ল বিষয় সংযোজন কি মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িকতা নয়? যদি ৯০% ভাগ মুসলমানের দেশে মহানবী (সা.) জীবনী, খলিফা ওমরের (রা.) উপর কবিতা ইত্যাদি থাকলেই সাম্প্রদায়িকতা হয় আর রামায়ণের কাহিনী, ইসলাম বিদ্বেষী বা ব্রাহ্মণ্যাদী কবিতা বা গল্প থাকলেই অসাম্প্রদায়িকতা হয় তাহলে বিবৃতিদাতা ও কলাম লেখক মহান পন্ডিত ব্যক্তিদের মানসিক সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে! এতো মুসলিম বিরোধী নব্য সাম্প্রদায়িকতার চর্চা। আর মৌলবাদ বলতে সুশীলরা কী বুঝেন তা বোঝা দায়। যে দেশের ৯০% ভাগ লোক মুসলমান। আর মুসলমানদের ছেলেমেয়েরা ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট কবিতা, গল্প ইত্যাদি পাঠ করবে তা ঐসব জাতিদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী ব্যক্তিরা সহ্য করতে পারছে না। তাই তারা সইতে না পেরে তথাকথিত মৌলবাদ বলে চিৎকার শুরু করে দেয়। তারা চায় জাতিকে ‘শিকড়’ বা ‘মূল’ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। তারা চায় ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে গুটিকয়েক লোকের আদর্শকে কোমলমতি শিশুদের উপর চাপিয়ে দিতে। তারা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভিনদেশীয় ভিন জাতীয় আদর্শ অনুযায়ী গড়ে তুলতে চায়।
যে দেশের প্রতিটি গ্রামে, শহরের প্রতি পাড়ায় মসজিদ আছে, নিয়মিত জামাতে নামাজ হয়, নিয়মিত জুমার নামাজে উপচেপড়া মুসল্লির ভিড় হয়, রমজানে নিয়মিত খতমে তারাবি হয়; যে দেশের প্রায় সমস্ত বড় দল হযরত শাহজালালের (র.) মাজার জিয়ারত করে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে সেদেশে ছেলেমেয়েরা ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট কোনো কবিতা পড়লেই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী হয়ে যাবে এটা কোন ধরনের দাবি? বিবৃতিদাতাদের যতটুকু তালিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় এর মধ্যে কমপক্ষে দুজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ আছেন (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও সনৎ কুমার সাহা) যারা বঙ্গবন্ধুর আমলেই বঙ্গবন্ধুর নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং সব ধর্মের প্রতি সহনশীলতা” বলে ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশী ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তখন তারা তার প্রচন্ড বিরোধিতা ও সমালোচনা করে সেমিনার ও লেখালেখি করেছিলেন। (দ্রষ্টব্য : ধর্মনিরপেক্ষতা, আলী আনোয়ার (সম্পাদক), বাংলা একাডেমী, নভেম্বর, ১৯৭৩)।
এখন তারা ও তাদের সগোত্রীয়রা একই কায়দায় সিলেবাসে পরিবর্তন ও ভোটের রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে হাসিনা সরকারের সমালোচনা করছেন। গণতান্ত্রিক পন্থায় ভোটের মাধ্যমে জিতেই তো ক্ষমতায় বসতে হবে। আর ভোট পেতে হলে যে জনগণের মনোভাব ও ইসলামী-চেতনার কথা মনে রাখতে হবে এটা ঐসব জনবিচ্ছিন্ন বুদ্ধি বিক্রেতারা না বুঝলেও আওয়ামী লীগ ঠিকই বুঝে। তাইতো সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” ও “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” বহাল রাখতে হয়, “নৌকার মালিক তুই আল্লাহ” “আল্লাহ সর্বশক্তিমান” ইত্যাদি ¯েøøাগান দিতে হয়, বলতে হয় “কুরআন সুন্নাহবিরোধী আইন পাস করব না”। ধর্মহীন সেক্যুলারদের কথা শুনলেতো পতিত বামদের- রনো সাহেবদের দশা হবে আওয়ামী লীগের। শেখ হাসিনা নিশ্চয় এগুলো বুঝেন। বুঝেন বলেই তিনি আলেমদের সমর্থন পেতে চান। ওলামা লীগ গড়ে তোলেন। উপজেলা উপজেলায় ইসলামী কেন্দ্র, কমúেøপ্কেক্সেপ্কে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনন্ডের কর্মকান্ডকে আরো প্রসারিত করার ব্যবস্থা করেন। অতীতে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থাকা সত্তে¡ও বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে তিনি রেডিওতে কুরআন তেলাওয়াত চালু রেখেছিলেন। অনেকের আপত্তি সত্তে¡ও ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ধর্মবিরোধী কমিউনিস্টদের অনেক চক্রান্ত সত্তে¡ও মাদরাসা ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, সব ধর্মের প্রতি সহনশীলতা- এ সত্যটি মনে রাখলেই তারা ভালো করবেন।
কথায় কথায় তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই পাড়েন। পাকিস্তানি ভাবাদর্শ পরিত্যাগের ওয়াজ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে “পাকিস্তানি ভাবাদর্শ” বলতে তারা কী বোঝাতে চান? আমরা কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র ছিল বলে? না তারা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল বলে? মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল তা স্পষ্ট করেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বলা হয়েছে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংযোজন করা হয়েছে। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য” (দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের সংবিধান, প্রস্তাবনা) । কাজেই এটি পরিষ্কার যে পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষের অধিকার দিতে চায়নি, এদেশের মানুষের মর্যাদা দিতে চায়নি, তাদের প্রতি সুবিচার করেনি বলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। ইসলামী পরিচয়কে বাদ দেয়ার থেকে জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। আমাদের মুসলিম পরিচয় যে আমাদের জাতির অন্যতম পরিচয় এটিও বঙ্গবন্ধুর কথা থেকে জানা যায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বিমানে তার অন্যতম সফরসঙ্গী লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের তদানীন্তন ফার্স্ট সেক্রেটারি ভদ মারওয়ার সাথে আলাপচারিতায় তিনি স্পষ্ট করে তার ত্রিমাত্রিক পরিচয় তুলে ধরেছিলেন : বাঙালি, মুসলিম ও আঞ্চলিক (দ্রষ্টব্য : দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট ২০১৬ সংখ্যা; নিবন্ধ : তার মতো মানুষ আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি- ভদ মারওয়া)। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে যে ভাষণ দেন তাতেও তিনি বাংলাদেশকে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি কোনো কোনো মহলের আপত্তি সত্তে¡ও লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মতলববাজরা অসত্য তথ্য বহুদিন ধরে আলোচনায়, পত্রপত্রিকায় ফিরে করে যাচ্ছেন যার সঙ্গে ইতিহাসের কোনো যোগ নেই।
তারা কখনো দ্বি-জাতিতত্তে¡র বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। জাতির মধ্যে দ্বি-জাতিতত্তে¡র অস্তিত্ব আছে বলে আক্ষেপ করেন। আমাদের জিজ্ঞাস্য বাংলাদেশের সীমানা কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে? সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান রূপই তো বাংলাদেশ? আর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ভূগোল কিভাবে নির্ধারিত হয়েছিল? সেটি হয়েছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে। নাকি সেটাও তারা অস্বীকার করতে চান? ঐতিহাসিক ছয়দফা যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে মৌল নির্দেশনা হিসাবে কাজ করেছে সে ছয় দফার প্রথম দফাটি কী ছিল? ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারতবর্ষে একাধিক রাষ্ট্রগঠনের কথা বলা হয়েছিল। কাজেই বলা যায় যে বাংলাদেশ হচ্ছে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবেরই বাস্তবরূপ। “প্রগতিশীলরা” যদি ন্যূনতম ইতিহাস জ্ঞানটুকু হারিয়ে বসেন তাহলে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া কী-ই বা করার আছে।
পাকিস্তানের অনুসরণ বলে যারা শোরগোল করছেন তাদের এ সত্যটাও আমাদের জানা দরকার যে পৃথিবীর প্রায় মুসলিম রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্যের প্রভাব রয়েছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। বিশেষত ইরান ও সৌদি আরবে তো ইসলামী শিক্ষা দিয়েই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। তাহলে পাঠ্যপুস্তকে কিছু ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্যেও বিষয় যোগ বরং পুনঃস্থাপিত হলেই ‘পাকিস্তান আবিষ্কারের’ চেষ্টা নিছক অসততা নয়?
ধর্মীয় ভাবাদর্শের শিক্ষার মাধ্যমে তরুণরা সাম্প্রদায়িক হয় না। বরং তারা আরো মানবিক, সহনশীল ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হয়। শিশুদের সেক্যুলার হিসাবে গড়ে তুললেই তারা শেষপর্যন্ত বস্তুবাদী, মাস্তান, লোভী, দুর্নীতিবাজে পরিণত হবে। বাংলাদেশে যে কয়টি সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে সেক্যুলার রাজনীতির প্রবক্তা কিছু লোক জড়িত তাতো প্রমাণিত সত্য। রাজনীতি, ক্ষমতা ও সম্পদের লোভই এসব ঘটনার কারণ। এসবের সঙ্গে ইসলামের বা প্রকৃত মুসলমানের কোনো সম্পর্ক নেই।
এ প্রসঙ্গে এটিও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারতের বাঙালি ‘দিদি’তো তিস্তা চুক্তি করে আমাদের পানি সমস্যার সুরাহা করতে বিগত কয়েক বছর ধরেই গড়িমসি করছেন। তিনি এখন তার প্রদেশের নাম রেখেছেন বাংলা। তাহলে এটি বুঝতে হবে যে সেক্যুলার বাংলা বলতে কোনো কিছুর আদপেই অস্তিত্ব নেই- আছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় বাংলা। ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমেই এটা চূড়ান্ত হয়েছিল। এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন বলেই তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এ দেশে এসে বাংলাদেশকে ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
প্রসঙ্গত একথা স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন যে, এদেশের মুসলমানরা কখনই সাম্প্রদায়িক ছিল না, আজো নয়। তবে নিজস্ব ধর্মীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম অবশ্যই তারা লালন করবেন, পালন করবেন- এব্যাপারে আপসের কোনো সুযোগ নেই। তারা এভাবেই নিজদের শিশুদের গড়ে তুলবেন, শিক্ষা দেবেন। ইসলামের মানবিক শিক্ষা যাদের ভালো লাগে না তাদের নিজের পথে চলতেতো কেউ বাধা দিচ্ছে না। ধর্মীয় মূল্যবোধ লালনের কারণে কোটি কোটি মুসলামানদের বিরুদ্ধে তাদের এত ক্ষেপবার কী আছে? জনগণের ট্যাক্সের অর্থে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। তাদের টাকায় তাদের স্বকীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা হবে এতে ঐসব ‘গুণীজনরা’ এত বেসামাল কেন? এসবের মধ্যে যারা সাম্প্রদায়িকতা আবিষ্কার করতে চান তাদেরকে আমরা বলব প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের দিকে তাকান। সেখানে মুসলমানরা কেমন আছে, কয় শতাংশ সরকারি চাকরি তাদের কপালে জুটে আর আমাদের দেশের দিকে তাকান?
রনো সাহেব আরো লিখেছেন, “হেফাজত পাঠ্যপুস্তক থেকে যেসব কবিতা বা গদ্য বাদ দিতে বলেছে, তা মেনে নেয়া মানে ধর্মান্ধতা, হিন্দুবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতাকে মেনে নেয়া। ---কিন্তু সবটাই অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় পরিণত হবে, যদি এভাবে হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেয়া হয় পাঠ্যপুস্তকে ও কোমলমতি শিশুদের মগজে। এটি নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করার বিরাট যড়যন্ত্র বলেই আমরা মনে করব। সরকারকে বলব, এখনই পদক্ষেপ নিন, শিক্ষাকে অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন ও বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলুন। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। সেই শিক্ষা যদি কুশিক্ষা হয়, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায়?” (প্রথম আলো, ২ মার্চ)
হায় আফসোস! রনো সাহেব ও তার সগোত্রীয়রা হযরত মুহাম্মদ (সা.), হযরত আবু বকরের (রা.)-এর জীবনী ও হযরত ওমরের (রা.) উপর কবিতাকে সাম্প্রদায়িকতা ও অশিক্ষা, কুশিক্ষা বলার মতো ধৃষ্টতা দেখায়। যেদেশের ৯০% ভাগ মানুষ মহানবী ও খলিফাদের মান্য করে, শ্রদ্ধা করে সেদেশে এসব কথা বলার সাহস তারা কোথায় পান? তাদের সাহসের উৎস যে ‘সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী’ বিদেশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব জনবিরোধী, দেশ ও ধর্ম বিরোধীদের মূল উপড়ে ফেলা ছাড়া স্বাধীন সার্বভৌম শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা কঠিন। এরা জাতির জন্য ক্যানসার সদৃশ। এরা বিদেশি মদদপুষ্ট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরা ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠছে। এবং ক্ষমতাসীনদের জন্যই এ শ্রেণীটি শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াবে।
বস্তুত কোটি কোটি মুসলমানের করের পয়সায় যে শিক্ষাব্যবস্থা তাতে অবশ্যই জাতির ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদি প্রতিফলিত হতে হবে। এটি মানুষের অধিকার। গুটিকয়েক ধর্মবিদ্বেষী লোকের কারণে দেশের মানুষ তার অধিকার ত্যাগ করতে পারে না। যদি স্বজাতির ধর্মীয় চেতনাবোধ পছন্দ না হয় তাহলে আপনাদের পছন্দ অনুযায়ী অন্যত্র গিয়ে শিক্ষা দিতে পারেন কিন্তু দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের এ অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না। এসব নিয়ে চেঁচামেচি করবেন না। ‘সুশীলের’ আড়ালে ‘কুশীল’ বানানো খোয়াব ত্যাগ করুন। সৎ ধার্মিক মানুষ বানানোর পরিবর্তে অসৎ, অধার্মিক, ধর্মবিদ্বেষী, দুশ্চরিত্র মানুষ বানানোর কর্মসূচি পরিত্যাগ করুন। কারণ এটি হবার নয়। জাতির বিবেক এখনো জেগে আছে। আপনারা চাইলেই মানুষের ধর্মবোধ পাল্টিয়ে দিতে পারেন না। জাতির সঙ্গে দুশমনি ত্যাগ করুন। তাতেই সবার কল্যাণ। সেখানে ধর্মবিদ্বেষী কোনো তত্ত¡, মতবাদ পাবেন তাই আমাদের দেশে আমদানি করবেন এ অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। আপনাদের ধর্মবিদ্বেষ নিজেদের কাছে রাখুন। কিন্তু গোটা জাতির অবমাননা আপনারা করতে পারেন না। এ অধিকার আপনাদের নেই। এ জাতি মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম একসঙ্গে নিয়ে চলবে। মুক্তিযুদ্ধ ধর্মহীনতা-ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য করা হয়নি। করা হয়েছিল “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার” প্রতিষ্ঠার জন্য। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ধর্মের বিরুদ্ধে লাগবেন না। নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবেন না। জাতি ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ একই সঙ্গে লালন করে। জাতি এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে রাজি নয়। যারা পার্থক্য করতে চায় তারা জাতির বন্ধু নয়। তারা মসজিদেও যাবে আবার বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসও পালন করবে। এটাই এ জাতির পরিচয়। যারা এ পরিচয়কে মুছে ফেলতে চান দেশপ্রেমিক জাতি এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
য় লেখক : মহাসচিব, খেলাফতে মজলিস
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।