Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নারী ও পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক

| প্রকাশের সময় : ৯ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মীর আব্দুল আলীম : দিবস আসে দিবস যায়, পরিবর্তন আসে না নারী জীবনের। নারী কেন এখনও নির্যাতনের শিকার? এখনও ভোগ্যপণ্য হতে হয় কেন নারীকে? আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের ১০৭ বছর পূর্তিতেও কেন নারীর প্রতি নিপীড়ন নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না? ১৯১১ সাল থেকে প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ক্যালেন্ডারে জায়গা করে নিয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয় কিন্তু নির্যাতন বন্ধ হয় না। প্রশ্ন হলো নারী অধিকার কি কেবল দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? আমরা হরহামেশা এও বলি, বাংলাদেশে নারীরা অধিকার বঞ্চিত। এদেশে নারীরা লাঞ্ছনা-বঞ্ছনার শিকার হচ্ছে বেশি। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। সারা বিশ্বের নারী সমাজই আজ অধিকার বঞ্চিত। তারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। নারীদের মর্যাদা আগের চেয়ে বাড়লেও গোটা দুনিয়ার নারীরা এখনও গড়পরতায় পুরুষের চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে কম। প্রকৃত পক্ষে আজও নারীরা চরম বৈষম্যের শিকার। দেশভেদে এদের সংখ্যার হেরফের হয় মাত্র।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত প্রায় সমান। অথচ, দুনিয়ার মোট সম্পদের একশত ভাগের মাত্র এক অংশের (১ শতাংশ) মালিক নারী। নারীর গৃহস্থালী কাজের আর্থিক স্বীকৃতি এখনো দেয়া হয়নি। অর্থাৎ তা অর্থনৈতিক মূল্যে অদৃশ্যই থাকে। এখনও পৃথিবীর ৬৬ শতাংশ কাজই করেন নারীরা। সারা বিশ্বের ১০ শতাংশ বৈশ্বিক আয় আসে এই নারীদের হাত দিয়েই। অথচ সারা বিশ্বে নারী প্রতিনিধিত্ব কম। বিশ্বে মাত্র ১৯ শতাংশ নারী সংসদ সদস্য রয়েছে। নারীরা ৬০-৮০ শতাংশ কৃষিকাজ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই নারীদের নিজেদের ভূমি সম্পত্তি রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। পৃথিবীতে গড়ে প্রতি ১ মিনিটে মারা যান ১ জন নারী। যা পুরুষের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে গোটা পৃথিবীতে প্রতি বছর ৫ লাখ নারী মারা যান গর্ভধারণ এবং শিশু জন্মদানের সময়, যার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। শিক্ষার দিক থেকেও নারীরা পিছিয়ে রয়েছে। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৭৭৪ মিলিয়ন অশিক্ষিত পূর্ণবয়স্ক মানুষই নারী। পাঠক নিশ্চই এ পরিসংখ্যান থেকে আপনিও বলবেন, কেবল বাংলাদেশে নয় সারা দুনিয়ায়ই নারীরা মর্যাদা বঞ্চিত।
নারী দিবসের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। মানুষ হিসেবে একজন নারী পরিপূর্ণ অধিকারের দাবিতে সুদীর্ঘকাল আন্দোলন চালিয়ে আসছে। সামাজিক কর্মকাÐের বিভিন্ন ধারায় দেখা যায়, নারী কোন অংশেই পুরুষের পেছনে ছিল না। ফ্রান্সের প্যারি কমিউন, ফরাসি বিপ্লব, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনসহ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে পুরুষের সাথে নারীকে দেখা যায়। কিন্তু নারীর কাক্সিক্ষত দাবি নারী সমাজ অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র নারীরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। বিশ্বে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নির্যাতনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার পরিসংখ্যান ভয়াবহ। এখানে প্রতি দুইজনের মধ্যে একজন পুরুষ কর্তৃক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। শতকরা ৬০ জন অসহায় নারী এর বিরুদ্ধে নীরব থাকে। অধিকার আদায়ের জন্য বিশ্বজুড়ে নারীদের কণ্ঠস্বর হাল আমলে ব্যাপকতা পেয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যাও রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ আন্দোলনের অভিন্ন কোন নেটওয়ার্ক অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু নানা মত-পার্থক্যের কারণে নারী আন্দোলন বিভিন্ন অংশে বিভক্ত।
৮ মার্চ কীভাবে হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস? ১৯ শতকের কথা, তখন টানা বারো ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রমের পর নারীদের জুটত সামান্য কিছু খাবার। একটু ভুল করলে শুরু হতো অত্যাচার। তার ওপর আবার পুরুষ সহকর্মী যা মজুরি পেত তার অর্ধেকও পেত না নারীরা। তাই এই বৈষম্য আর সহ্য করতে না পেরে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা রাস্তায় নামেন। এ আন্দোলন পরিণতি না পেলেও নিপীড়িত মেয়েদের জাগিয়ে তোলে বিশ্বব্যাপী। এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে ব্যর্থ হয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন পুরুষের পাশাপাশি নারীর সম-অধিকারের দাবিটি আরও জোরালো করেন। তার নেতৃত্বেই ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে এ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯১১ সাল থেকে ৮ মার্চ দিনটিকে ‘নারীর সম-অধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। সে হিসেবে এ বছরই আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের ১০৩ বছর পূর্তি হচ্ছে। নারী অধিকারের যৌক্তিক দাবিগুলো বিবেচনায় রেখে ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ স্বাক্ষর করে ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি’ চুক্তিতে। বাংলাদেশের মহিলা পরিষদ ১৯৭৩ সাল থেকে নারীর সম-অধিকার দিবস পালন করে আসছে। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের জন্য উত্থাপিত বিল অনুমোদন পায়। ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করে। সেই থেকে আজও এ দিবসটি পালিত হচ্ছে বেশ গুরুত্বের সাথে।
যাহোক এদেশের নারীর মর্যাদা নিয়ে কিছু বলা দরকার। নারী নির্যাতন প্রথা আমাদের সমাজে এমনভাবে মিশে আছে যে ভদ্র পোশাকের আড়ালেই এমন ঘটনা হরদম ঘটে যাচ্ছে। ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনৈতিক, মানবাধিকার কর্মী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক, শিক্ষক, সাংবাদিক কেউই আর নারী নির্যাতনের বাইরে নেই। এদের অনেকেই ঘরের বাইরে জ্ঞানের কথা বলেন, সাধারণ মানুষকে ভালো হয়ে চলার উপদেশ দেন আর তারাই কিনা ঘরে এসে বউ পেটায়। অবাক লাগে নারী অধিকারের কথা বলে মাঠ গরম করা রাজনীতিবিদরাও বউ পেটায়। মানবতার গান গাওয়া শিল্পীটাও বাসায় ফিরে বউ পেটায়। মানবাধিকার কর্মী হিউমেন রাইটসের কথা বলে মিছিল-মিটিং করে কিন্তু পান থেকে চুন খসলে সেও বউ পেটায়। কারণ, আকারণেই পুরুষ সমাজ নারীর প্রতি চড়াও হচ্ছে।
নারী নির্যাতনের সময় বাধা দিতে গেলে অনেকে রাগান্বিত হয়ে বলেন ‘আমার বউ আমি পেটাচ্ছি, তুমি কে হে বাপু এতে নাক গলাও।’ আমাদের এই মানসিকতার গায়ে আঁচড় পড়ে ১৯৯৫ সালে যখন সংসদ কর্তৃক নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনটি পাস করা হয়। কিন্তু এই আইনটিও ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন সমস্যার মুখে লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায়, সংসদ ২০০০ সালে এই আইনটি পরিমার্জন করে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার অপরাধগুলোকে বিশেষভাবে তদন্ত ও বিচারের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাস করে। এই আইনে যৌতুকের জন্য সাধারণ বা গুরুতর আহত করণসহ ধর্ষণ, ধর্ষণের প্রচেষ্টা, যৌন হয়রানি, হত্যা, অপহরণ, দহনকারী পদার্থ দিয়ে আহত করা ইত্যাদি প্রায় ১২ প্রকার অপরাধের দ্রæত তদন্ত ও বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন, ভিকটিমের জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধকরণ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই আইনের অপরাধকে জামিনের অযোগ্যও ঘোষণা করা হয়। তবু নারী নির্যাতন থেমে নেই। জেলায় উপজেলায় গ্রামেগঞ্জে নারী নির্যাতন চলছে তো চলছেই। বউ পেটানো, নারী নির্যাতন আগে ছিল অশিক্ষিতের কাজ এখন তা ভদ্র সমাজে ঢুকে গেছে।
নারী দিবসকে ঘিরে আমাদের পুরুষ সমাজের কাছে একটাই মিনতি, নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করুন। নারীরা মায়ের, স্ত্রীর মর্যাদা ফিরে পাক। পরিশেষে- আমি কাউকে অনুরোধ করবো না যে ভেবে দেখুন। কাউকে বলবো না যে সচেতন হোন। কাউকে অনুনয়-বিনয় করে বলবো না- নারী নির্যাতন করবেন না, বউ পেটাবেন না। কিছুই বলবো না। মানুষ যে সে বুঝে নেবে। আর যে নয়- তাকে বুঝালেও কোন কাজ হবে না মনে হয়। তবে যারা মানুষ নয়- সেই ঘৃণ্য প্রজাতিদের সমাজ থেকে বের করার ব্যবস্থা নিতে হবে- এমনকি আমি নিজেও যদি সেই রোগে আক্রান্ত হই। ক্ষমা যেন আমারও না হয়। নারীরাও দোষ করেন। তাই বলে তাদের পেটাতে হবে কেন? একজন স্বামী হিসেবে আপনিও তো স্ত্রীর কাছে দোষ করতে পারেন, তাই বলে কি সে আপনাকে পেটাতে আসছে? নারী এবং পুরুষ উভয়েই মানুষ, শুধু তাই নয় তারা পরস্পরের পরিপূরকও বটে- এই ভাবনাটা যতদিন না আমাদের মধ্যে পোক্ত হচ্ছে ততদিন নারীর অধিকার দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ