দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
ফির’আউনের যাদুকরদের প্রার্থনা : হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তৎকালীন ফিরআউন দ্বিতীয় রেমসীর-এর পুত্র মিনফাতাহ যার রাজত্ব খ্রিস্টপূর্ব ১২১৫ থেকে ১২৩০-এর নিকট দ্বীনের দাওয়াত পেশ করলে, সে হযরত মূসা (আ.)-এর নিকট তার দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ দেখাতে বলল। হযরত মূসা (আ.) আপন লাঠি মাটিতে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে তা এক অজগরে পরিণত হল। ফিরআউনের পরিষদবর্গ বলল, এ তো এক সুদক্ষ যাদুকর। একে প্রতিহত করার জন্য সারা দেশ থেকে বড় বড় যাদুকরদের একত্র করা হোক।
মিশরীয় কিবতীদের বিশেষ এক উৎসবের দিন আলোকদীপ্ত পূর্বাহ্নে প্রায় পনের হাজার বিখ্যাত যাদুকর একত্র করা হল। যাদুকরেরা তাদের রজ্জু ও লাঠি নিক্ষেপ করে এক বিশাল ময়দান ভরে ফেলল। যাদুকরগণ দর্শকদের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটিয়ে দেয়ায় সকলের মনে হতে লাগল। এগুলো ঘন ঘন কাঁপছে। এ অবস্থা দেখে সকলেই আতংকিত হয়ে গেল। হযরত মূসা (আ.) আল্লাহ তা’আলার হুকুমে তাঁর লাটি নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা যাদুকরদের লাঠি ও রজ্জুগুলি গ্রাস করে ফেলল। এদৃশ্য দেখে যাদুকরদের নিশ্চত বিশ্বাস হল যে, হযরত মূসা (আ.) কোনো যাদুকর নন; তিনি আল্লাহপাকের প্রেরিত রাসূল। তারা তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং বলল আমরা মূসা ও হারুনের প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান আনলাম। ফিরআউন বলল, এতো এক চক্রান্ত; আমি তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করব এবং তোমাদের সকলকে শূলীতে চড়াব। তারা বললেন, আমাদের নিকট আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শন আসার পর আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। ফিরআউন তাদের সকলকে শূলীতে চড়িয়ে শহীদ করে দিল। পূর্বাহ্নে যারা যাদুকর ছিলেন অপরাহ্নে তারা শাহাদাত লাভ করেলেন। তারা শাহাদতের অমিয় সুধা পান করার পূর্বে আল্লাহ পাকের মহান দরবারে বিনয়াবনত হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন, “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে পরিপূর্ণ ধৈর্য দান করুন এবং আপনার নিকট আত্মসমর্পণকারীরূপে আমাদের মৃত্যু দিন।”-আরাফ : ১২৬
হযরত মূসা (আ.)-এর কওমের দুআ : হযরত মূসা (আ.)-এর যুগের ফিরআউন ছিল একজন উদ্ধত ও স্বৈরাচারী বাদশাহ। তার ও তার পরিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে অনেকেই হযরত মূসা (আ.)-এর প্রতি ঈমান আনেনি। বনী ঈসরাইলের যারা হযরত মূসা (আ.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তিনি তাদের সকলকে বললেন, হে আমার কওম, তোমরা যদি মুসলিম হয়ে থাক তবে তোমরা শুধু আল্লাহরই ওপর নির্ভর কর। তখন তারা আল্লাহপাকের নিকট প্রার্থনা করলেন। “আমরা সকলে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করলাম। হে আমাদের প্রাতিপালক, আমাদেরকে অপরাধী সম্প্রদায়ের উৎপীড়নের পাত্র করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার অনুগ্রহে কাফির সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন।”-ইউনুস ৮৫-৮৬। আল্লাহপাক তাদের দুআ কবুল করেছিলেন এবং তাদেরকে ফিরআউনের নির্যাতন থেকে রক্ষা করেছিলেন। তারা সদলবল মিসর থেকে লোহিত সাগর অতিক্রম করে পূর্ব পার্শ্বস্থ গিণাই উপত্যকায় চলে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ফিরআউনের গোষ্ঠীর একজন মুমিনের সর্বশেষ দুআ : ফিরআউনের এক চাচাতো ভাই হযরত মূসা (আ.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। তিনি তাঁর ঈমান গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখেন। ফিরআউন একদিন দম্ভভরে বলল, আমি মূসাকে হত্যা করব। কারণ সে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। ফিরআউনের এই জ্ঞাতি ভাই তাকে বললেন, তোমরা কি একজন ব্যক্তিকে শুধু এজন্য হত্যা করবে যে, সে বলে, আমার প্রতি পালক একমাত্র আল্লাহ। সে তো প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের কাছে এসেছে। আজ কর্তৃত্ব তোমাদের; দেশে তোমরাই প্রবল কিন্তু আমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়লে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে? হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদের জন্য কওমে নূহ, কওমে আদ, সামূদ ও তাদের পরবর্তীদের শাস্তির অনুরূপ দুর্দিনের আশা করছি।
মুমিন ব্যক্তিটি আরও বললেন, হে আমার সম্প্রদায়, এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং পরকালই চিরস্থায়ী আবাস। অবশেষে এ মুমিন কিবতী তাঁর ঈমান গ্রহণের কথা প্রকাশ করে বললেন, তোমরা আমাকে বলছ, আল্লাহকে অস্বীকার করতে এবং তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে। পক্ষান্তরে আমি তোমাদের আহŸান করছি ক্ষমাশীল, পরাক্রমাশালী আল্লাহর দিকে। বস্তুত আমাদের প্রত্যাবর্তন তো আল্লাহরই নিকট এবং সীমালঙ্গনকারীরাই জাহান্নামের আধিবাসী। আর আমি তোমাদেরকে যা বলছি, তোমরা তা অচিরেই স্মরণ করবে। তিনি সর্বশেষ দুআ করেন, ‘আমি আমার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর নিকট অর্পণ করছি। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন।’
তালুত ও তাঁর সঙ্গীদের প্রার্থনা : হযরত মূসা (আ.)-এর প্রায় সহস্রাধিক বৎসর পর জালূত নামক জনৈক অত্যাচারী শাসক বনী ইসরাঈলের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তাদেরকে আপন আবাসভূমি থেকে বহিস্কার করেছিল। সে সময় বনী ইসরাঈল তৎকালীন নবী হযরত শামবীল (আ.)-এর নিকট আবেদন করেছিল যে, তাদের জন্য যেন একজন রাজা নিযুক্ত করা হয়, যার নেতৃত্বে তারা জালূতের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। আল্লাহপাকের হুকুমে তাদের জন্য তালূত নামক একজন শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাবান মহান ব্যক্তিকে রাজা নিযুক্ত করা হল। নির্ধারিত সময়ে তালূত গৈণ্যবাহিনী নিয়ে বের হলেন। বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। তোমরা এ নদী থেকে পানি পান করবে না। একান্তভাবে কারও করতে হলে স্বল্প পরিমাণে করবে। মাত্র তিনশ তের জন ছাড়া সকলেই অধিক পরিমাণে পান করল। যারা অধিক পরিমাণে পান করল, তারা আর সম্মুখে অগ্রসর হতে পারল না। কিন্তু খাঁটি ঈমানদারগণ এতে সাহস হারালেন না। তারা বললেন, আল্লাহর হুকুমে অনেক ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে। সুতরাং আমরা আল্লাহপাকের ওপর নির্ভর করে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবই। তাঁরা প্রবল প্রতাপশালী জালূত ত তার বিশাল গৈণ্য বাহিনীর সম্মুখীন হয়ে আল্লাহপাকের নিকট দুআ করলেন, “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে ধৈর্য দান করুন, আমাদের পা অবিচলিত রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।”- বাকারা ২৫০ আল্লাহপাকের সাহায্যে তারা শক্তিধর জালূত বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী হন।
পূর্বযুগের একজন মুমিনের দুআ : পূর্ববর্তী কোনো যুগে এক ব্যক্তির দুটি আঙুর বাগান ছিল। এ বাগান দুটি প্রচুর পরিমাণ ফল প্রদান করত। উদ্যানের চতুর্দিকে খেজুর গাছ, দুই বাগানের মধ্যখানে শস্যক্ষেত এবং ফাঁকে ফাঁকে নহর প্রবাহিত ছিল। সে একদিন তার এক দরিদ্র বন্ধুর সঙ্গে অহঙ্কার করে বলল, আমি তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ। সে তার উদ্যানে প্রবেশ করে আরও বলল, আমি মনে করি না যে, কখনও কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং এ উদ্যান কোনো দিন ধ্বংস হবে। তার দরিদ্র বন্ধু ছিলেন মুমিন। তিনি বললেন, তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন? কিন্তু আমি বলি, আল্লাহই আমার প্রতিপালক। আমি কাহাকেও আমার প্রতিপালকের সঙ্গে শরীক করি না। তুমি যখন তোমার উদ্যানে প্রবেশ করলে তখন কেন এ দুআ পড়লে না- এইসব আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোনো শক্তি নেই।’ সূরা কাহ্ফ ৩৯। অবশেষে তার ফল সম্পদ বিপর্যয়ে বেষ্টিত হল। তার দ্রাক্ষা উদ্যান মাচানসহ ভূমিসাৎ হয়ে গেল। সে তাতে যা ব্যয় করেছিল তার জন্য আক্ষেপ করতে লাগল। তাকে সাহায্য করবার কেউ ছিল না এবং সে নিজেও প্রতিকারে সমর্থ হল না।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহপাক কোনো বান্দার সম্পদে, সন্তানে বা পরিবার পরিজনের মধ্যে কোনো নেয়ামত দান করার পর সে যদি পাঠ করে তবে আল্লাহ পাক এ নেয়ামত থেকে সর্বপ্রকার বিপদ-আপদ সরিয়ে দেন। ৮. হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন, আবু হুরায়রা, আমি কি তোমাকে জান্নাতের এক ধন-ভাÐারের দিকে পথ প্রদর্শন করবো না? তা হল, তুমি পাঠ করবেÑ হযরত ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রহ,) তাঁর ঘরের দরজার উপর লিখে রেখেছিলেন। কেউ তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি সূরায়ে কাহাফের বর্ণিত আয়াতখানি পাঠ করেন। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।