Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মার্কিন সাহায্য ও প্রভাব সঙ্কুচিত হচ্ছে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকছে পাকিস্তান

| প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

টাইমস অব ইন্ডিয়া : পাকিস্তানি নেতারা সব সময়ের বন্ধু চীনের সাথে তাদের মধুর চেয়েও মিষ্টি সম্পর্ক বিষয়ে কিছু বলতে গেলে গানের সুরে কথা বলেন। আমেরিকা সম্পর্কে তারা যখন কথা বলেন তার মধ্যে কোনো রোমান্স থাকে না।
ট্রাম্প প্রশাসন তাদের এক প্রধান অংশীদারের ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করছে। তারা ২০৩০ সালের মধ্যে পাকিস্তানে জ¦ালানি, অবকাঠামো ও শিল্প খাতে  ৪৬ বিলিয়ন ডলার চীনা বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দেশটিকে বেইজিংয়ের আরো কোলের ভেতরে টেনে নিতে দেখবে। এ বিনিয়োগ পাকিস্তানের অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটাতে পারে।
বিপরীত দিকে ওয়াশিংটন বুঝতে পারছে না যে, তার কতটা উদারতা পাকিস্তানকে প্রভাবিত করতে পারে। বহু মার্কিন হতাশ নীতিনির্ধারক পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের একটি স্বর্গরাজ্য হিসেবে দেখেন যে দেশটিতে ৯/১১-র পর নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সাহায্য খাতে ৩০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে। এখন আমেরিকা যদি পাকিস্তান থেকে সরে আসে তাহলে উগ্রপন্থা, দুর্বল শাসন সংবলিত ও বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য সংঘাতের এ আঞ্চলিক বারুদাগারটির স্থিতিশীলতা রক্ষার সামর্থ্যরে ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।
পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফরকালে বলেন, আমি আভাস পেয়েছি যে, আমরা আবারো অপ্রয়োজনীয় মিত্রে পরিণত হয়েছি।
২০১১ সালে আমেরিকান কমান্ডোরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার পর থেকে ইসলামাবাদের সাথে মার্কিন সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং মার্কিন সাহায্য কমতে থাকে। সেই সাথে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে পাকিস্তানের প্রতি অগ্রাধিকার প্রদান হ্রাস পায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কূটনৈতিক ও বিদেশী সাহায্য বাজেট কঠোরভাবে হ্রাসের প্রস্তাব করার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য আরো হ্রাস পেতে পারে।
আমেরিকাকে সহিংস উগ্রপন্থা থেকে রক্ষার ট্রাম্পের শপথের কারণে পাকিস্তানের দিক থেকে পিঠ ফিরিয়ে নেয়া এখনো কঠিন হতে পারে। আলকায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি এ দেশে পালিয়ে আছেন বলে সন্দেহ করা হয়। অন্যদিকে আফগান শান্তি আলোচনায় পাকিস্তানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ওয়াশিংটনের বৃহত্তর আঞ্চলিক উদ্দেশ্য যা-ই হোক, আফগানিস্তানে এখনো সাড়ে ৮ হাজার মার্কিন সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। তালিবান জঙ্গিদের আন্তঃসীমান্ত হামলা রোধে পাকিস্তানের ভূমিকার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক গুরুত্বারোপ করে।
পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের ব্যাপারে চীনও উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে উইঘুরদের ব্যাপারে যারা পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে আশ্রয় নিতে চাইছে এবং আলকায়েদা ও তালেবানের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলছে। তবে সব কিছুর ওপরে চীন পাকিস্তানে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুবিধা দেখে।   
এই অপছন্দনীয় জোট এশিয়া ও ইউরোপের বাজারকে সংযুক্ত করতে চীনের উচ্চাকাক্সক্ষী ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীনকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশে পাকিস্তানের সুযোগ দান মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানির জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালাক্কা প্রণালীর চেকপয়েন্টের ওপর তার নির্ভরতা হ্রাস করতে এবং চীনের স্থলবেষ্টিত দূর পশ্চিমের উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করতে পারে।
পাকিস্তানের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মন্ত্রী আহসান ইকবাল চীনা বিনিয়োগকে আশীর্বাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ২০ কোটি লোকের দেশ পাকিস্তান বিদ্যুৎ ঘাটতি ও অন্যান্য ব্যর্থতার শিকার এবং বিদ্যমান সন্ত্রাসবাদী সহিংসতার জন্য বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে লড়াই করছে।
তিনি বলেন, চীনের বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা জ¦ালানি উৎপাদন ও সঞ্চালন প্রকল্পে ৩৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। ২০১৮ সাল নাগাদ ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা। এর ফলে দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ২২ হাজার মেগাওয়াট, যা সুইজারল্যান্ডের উৎপাদনের চেয়ে সামান্য বেশি। সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যা পাকিস্তানের এক-পঁচিশাংশ।
চীনা অর্থের ১০ বিলিয়নেরও বেশি সড়ক, রেল ও গভীর সমুদ্র বন্দরের স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় হবে।
ইকবাল গত মাসে ওয়াশিংটনের একটি থিংক ট্যাংককে বলেন, পাকিস্তানের কাহিনী পাল্টে যাচ্ছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেনÑ ‘আমরা প্রস্তুত, আপনারা প্রস্তুত তো’?
সরকারের পাক খাওয়া ছাড়াও পরিবর্তনশীল, অভ্যুত্থানপ্রবণ পাকিস্তান কয়েক বছর ধরে তুলনামূলকভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীল থাকায় দেশের অর্থনীতি সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। করাচি শেয়ার মার্কেট ২০১৬ সালে ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর জিডিপি প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তেলের নি¤œমূল্য এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।
তবে সহিংসতা ব্যাপকই রয়ে গেছে। সামরিক বাহিনী পাকিস্তানি তালেবানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। তা সত্তে¡ও সাম্প্রতিক আত্মঘাতী বোমায় ১২৫ জন নিহত হয়েছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর দায়িত্ব স্বীকার করেছে।
ট্রাম্প পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার রূপরেখা না দিলেও কংগ্রেস এ বিষয়ে অগ্রসর হয়েছে।
গত বছর মার্কিন আইন প্রণেতারা পাকিস্তানে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান বিক্রয়ের অর্থায়ন বন্ধ করে দেন। এ বছর ৪০ কোটি ডলার জোট সহায়তা তহবিল স্থগিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে পাকিস্তান দেশের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনী দ¦ারা দীর্ঘদিন ধরে সমর্থিত একটি তালেবান উপদলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্টিফিকেট না দেয়া পর্যন্ত এ তহবিল প্রদান স্থগিত থাকবে।
পাকিস্তানের শীর্ষ শত্রæ ভারতের সাথে মার্কিন অংশীদারিত্ব ক্রমবর্ধমান। ভারত পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাছাইকৃত লড়াইয়ের জন্য অভিযুক্ত করেছে এবং কূটনৈতিকভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করছে। এ ধরনের চেষ্টার পরিণতি পাকিস্তানকে চীনের কাছে ঠেলে দিচ্ছে।
ওয়াশিংটনে উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলমান বলেন, যদি সবকিছু পরিকল্পনামতো চলে পাকিস্তান তার অবকাঠামোর জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয় জ¦ালানি সঙ্কট থেকে রেহাই পাবে। তবে তিনি সতর্ক করে দেন যে, চীন চূড়ান্তভাবে কতটা তার অঙ্গীকার রক্ষা করবে সে ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রত্যাশা অতিরিক্ত হতে পারে। চীন সব সময় তার স্বার্থকে সর্বোচ্চে রাখে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হওয়ার পর স্থানীয় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হলে পাকিস্তান সরকার চীনা উৎপাদনকারীদের অর্থ পরিশোধে নিশ্চয়তা প্রদানের ব্যাপারে পুনরাশ^াস দিয়েছে।  নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসনে পাকিস্তান চীনা প্রকল্পগুলোতে কর্মীদের সুরক্ষায় ১৫ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে।
সমালোচকরা বলছেন, চীনা চুক্তিগুলো অস্বচ্ছ। এ থেকে স্থানীয় সম্প্রদায় কিভাবে লাভবান হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ভারতের আশঙ্কা যে, ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছুক চীন পাকিস্তানের গভীর সমুদ্রবন্দর গোয়াদরকে ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।
চীনের সাথে পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। র‌্যান্ড কর্পোরেশনে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ জোনাহ বøাংক বলেন, তাদের যৌথ প্রয়াসে থান্ডার এফ-১৭ জঙ্গি বিমান উৎপাদন থেকে বোঝা যায় যে, চীন পাকিস্তানের অস্ত্রের প্রধান যোগানদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান পূরণ করতে পারে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ইশরাত হোসেন বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মার্কিন সাহায্য চীনের মতো পদচিহ্ন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, চীনা বিনিয়োগের সুফল উপলব্ধি হতে দু’বছর লেগে যাবে। তবে তা  বিদ্যুৎ ঘাটতির অবসান করতে পারে, যা শিল্পকে পঙ্গু করে ফেলেছে। অন্যদিকে দেশের অবহেলিত পশ্চিমাঞ্চলে সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি পাকিস্তানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহŸান জানান।  



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাকিস্তান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ