Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

| প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ডা. মাওলানা লোকমান হেকিম : ইসলামে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিয়েই একমাত্র বৈধ উপায়, একমাত্র বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা। বিয়ে ছাড়া অন্য কোনভাবে নারী-পুরুষের মিলন ও সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিয়ে হচ্ছে পুরুষ ও নারীর মাঝে সামাজিক পরিবেশে ও সমর্থনে শরীয়ত মোতাবেক অনুষ্ঠিত এমন এক সম্পর্ক স্থাপন, ফলে দু’জনে একত্রে বসবাস ও পরস্পরে দাম্পত্য ও সন্তান উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বৈধ হয়ে যায়। যার ফলে পরস্পরের ওপর অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য অবশ্য পালনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাল্যবিয়ে দেশ ও সমাজের জন্য অভিশাপ হিসেবে বিরাজ করছে যুগের পর যুগ ধরে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ১৯২৯ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। ৮৮ বছর আগে প্রণীত আইনটি যেমন যুগোপযোগী নয় তেমনি এর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। আইনের ফাঁক গলিয়ে প্রতিদিনই দেশে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। আমাদের দেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে বাল্যবিবাহের কারণে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয় তা বহুল আলোচিত।
এ পটভূমিতে নারীদের মতো পুরুষরাও ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ ১৮ বছরের আগেই বিয়ে করার সুযোগ পাবেন-এ বিধান রেখে গত ২৮ ফেব্রæয়ারি, সোমবার জাতীয় সংসদে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ পাস হয়েছে। নতুন আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনের অন্যান্য বিধানে যাই থাকুক না কেন, বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশে এবং বাবা-মায়ের সম্মতি অনুযায়ী বিধিসম্মতভাবে বিবাহ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলে তা এ আইনের অধীনে অপরাধ বলে গণ্য হবে না। আমাদের বিশ্বাস, এই ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ কথাটির সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে এ আইনের অপব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
দেশে বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও শিক্ষার অভাব। এছাড়া সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও বাল্যবিবাহ কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমছে না। অল্পবয়সে মা হলে মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধিসহ নারীদের নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তাদের প্রসবকালীন জটিলতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকাও বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুরা স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া এমন শিশুদের যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ ধরনের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।
দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও শিক্ষিত নারীরা কাক্সিক্ষত মাত্রায় মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকাÐে যুক্ত হতে পারছে না। ফলে দরিদ্র পরিবারের বাবা-মা অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। শিক্ষিত নারীরা ব্যাপক হারে মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকাÐের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারলে এ প্রবণতা সহজে দূর হবে না। এ ধরনের সমস্যা দূর না হলে বাল্যবিবাহ রোধে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। বাল্যবিবাহ রোধে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমাদের করণীয় হল, নারীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, যাতে তারা ব্যাপক হারে মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকাÐের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এটি নিশ্চিত করা না গেলে দেশে বাল্যবিবাহ রোধে কাক্সিক্ষত সুফল প্রাপ্তিতে বিদ্যমান বাধাগুলো সহজে দূর হবে না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে পছন্দমতো চাকরি পেতে যে কোনো তরুণ বা তরুণীকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কাজেই বিশেষ কারণে যেসব তরুণ বা তরুণীর পছন্দমতো চাকরি পাওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়, স্বাভাবিকভাবেই তারা চাকরির সন্ধানে উম্মুখ থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা না থাকলে তাদের পক্ষে পছন্দমতো চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এসব সমস্যার সমাধানে দেশে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। তাই বাল্যবিয়ে দিলে বর-কনের অভিভাবক, আত্মীয়, ইমাম, কাজী সবারই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। এ জন্য অভিযুক্তদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা দুই বছরের বিনাশ্রমে কারাদÐের সম্মুখীন হতে হবে। তবে এক্ষেত্রে শুধু আইন প্রণয়ন নয়, সকলের সহযোগিতা ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে এবং যথাযথ বাস্তবায়নেও গুরুত্ব দিতে হবে।
ষ লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন