Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যাংকিং সেক্টরে বিদেশী চাপ বনাম ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা

| প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এম. আবদুল্লাহ : সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী ব্যাংকটিকে আগামী দু’বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এ আহ্বান শুধু সোনালী নয় বরং সরকারি মালিকানাধীন সব কয়টি ব্যাংকের বেলাই প্রযোজ্য হওয়ার মতো। সার্বিক বিবেচনায় আমাদের ব্যাংকিং খাত একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বলা যায়। খেলাপি ঋণ আর সীমাহীন লুটপাটের পাশাপাশি, একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপচে পড়া রিজার্ভ অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় আমাদের অর্থনীতির এক অবাঞ্চিত বাস্তবতা। এটি সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ না হলেও উন্নত স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলেই জোর প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। সুতরাং রোগ নিরাময়ের বিষয়টি দূরাশা মাত্র। তারপরও গেল বছর সার্বিক বিবেচনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ফলাফল সন্তোষজনক। অবশ্য অনেকে এর পেছনে ঋণের ওপর সুদের হারের তুলনায় আমানতের ওপর ‘নগণ্য মুনাফা’ নীতিকেই মূল কারণ মনে করলেও এটাই একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সরকারি ব্যাংকগুলোর কথাই বলা যায়। ভর্তুকিসহ নানা সুবিধা পাওয়ার পরও সরকারি খাতের কোন একটি ব্যাংকও উল্লেখযোগ্য পারফরমেন্স দেখাতে পারেনি। দীর্ঘদিন থেকে ‘কোরামিননির্ভর’ এই ব্যাংকগুলো বেসরকারি হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতো? ওদিকে ‘হাজার টাকার বাণিজ্যে লক্ষ টাকা লোকসান’-এর বাস্তব নমুনা ব্যাসিক ব্যাংক; শেষ রক্ষার জন্য সরকারের কাছে আরো আড়াই হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর আবেদন জানিয়েছে বলে প্রকাশ। সাথে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, এই অর্থ ব্যাংকটি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারকেই তা বহন করতে হবে। অর্থাৎ ব্যাংক ডাকাতদের লুটে নেয়া অর্থের দায় শেষ পর্যন্ত জনগণকেই বহন করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো নজিরবিহীন ঘটনাটি ব্যাংকিং সেক্টরে অরাজকতা ও অব্যবস্থাপনার মূর্ত প্রতীক রূপেই বিবেচনা করা যেতে পারে, এর চেয়েও লজ্জা ও দুর্ভাগ্যের বিষয় হল রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে অন্ধকারে রেখে গভর্নর আতিউর রহমান ছুটে গেলেন দিল্লিতে। ফিলিপাইনের মিডিয়ার সুবাদে ঘটনাটি সরকারের গোচরে আসে দীর্ঘ এক মাস পর। অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব গভর্নরের এহেন আচরণে ক্ষুব্ধ হলেন সম্ভবত ঘটনার গভীরতা না বোঝেই। তদন্ত কমিটি গঠন করলেন এবং রিপোর্ট জনগণের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করার নিশ্চয়তাও দিলেন আপনা থেকেই। অতঃপর রিপোর্ট হাতে পেয়ে তা প্রকাশে অসম্মতি জানালেন সেই শেয়ার ডাকাতির রিপোর্টের মতোই। শেয়ার ডাকাতদের বিচার না হলেও ‘রিজার্ভ চোর’দের নাকি বিচার হবেই! ‘আইনের চোখে যখন সবাই সমান’ হলেও হতে পারে!
নতুন বছরের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি.-এর নেতৃত্বে পরিবর্তন ব্যাংকিং সেক্টরে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।  কোম্পানী আইন অনুযায়ী এ ধরনের পরিবর্তন ‘ডাল-ভাতের’ মতো সাধারণ বিষয় হলেও এ বেলা ভিন্নতা দেখা গেল। কোন কোন মিডিয়াকে অর্ধ পৃষ্ঠাজুড়ে ‘লিড নিউজ’ করতেও দেখা গেল। সরকারের ভাষ্য, ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তনে সরকারের কোন ভূমিকা নেই। পরিবর্তনটা আইন মেনে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই হয়েছে। তবে এই আইনানুগ পরিবর্তনেও ‘বিদেশী চাপ’ থাকার তথ্যটা জানালেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। ‘ঘর পোড়া গরু’র মতো জনগণের মনে সংশয় ও সন্দেহ এখানেই। এমন একটি নগণ্য ইস্যুতেও ‘বিদেশী চাপ’ তাহলে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে স্বাধীন-স্বকীয়তা বলতে কিছু থাকতে পারে কী? তারপরও কথা থাকে, এ চাপ কী এ জন্য যে বিদেশী বন্ধুরা ব্যাংকটিকে এখন বিশ্বের লিডিং ব্যাংক হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন? অথবা তারা কী ভাবছেন ব্যাংকটি গণআস্থা হারিয়ে ডুবতে বসেছে? এই ‘চাপ’ কী এ জন্য যে, ব্যাংকটির কর্মকা- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় ক্ষতির কারণ রূপে চিহ্নিত হয়েছে? নাকি এটি এ জন্য যে, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের একটি ব্যাংক দ্রুত প্রসার ঘটছে তাও আবার ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার ধারক রূপে? ব্যাংকটির সিংহভাগ শেয়ারের মালিক বিদেশী। অথচ তাদেরই অভিযোগ এই পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। এ অভিযোগ অসত্য না হলে স্বচ্ছতাই যে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ হলো তা নয়, বরং বিদেশী বিনিয়োগের এই দুর্ভিক্ষের দিনে এটি একটি মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে গেল।
নীতিগতভাবে আমরা পরিবর্তনের পক্ষে, উদ্দেশ্য যখন শুভ। পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে আজকের শিশুটি আগামী দিন যুবকে পরিণত হবে। ইসলামী ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব স্বনামধন্য সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পথিকৃত। ব্যাংকিং ব্যবসায়েও তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। সুতরাং যোগ্য পরিচালনায় ব্যাংকটি অগ্রগতি ও সাফল্যের আর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এমন প্রত্যাশা যদি অমূলক না হয় তা হলে আশা ভঙ্গের বেদনায় হতাশা বন্ধুদের পক্ষ হতে নতুন করে আর ‘চাপ’ আসবে না, এমনটি যদি আমাদের কপাল লিখন না হয়, সে ক্ষেত্রে ‘চাপ’ সামলাতে আবারও ‘আইনানুগ’ প্রক্রিয়া তালাশ করা হবে না এ বিষয় নিশ্চয়তা থাকা জাতীয় স্বার্থেই জরুরি। অবশ্য ‘চাপ’ থেকে বাঁচার সবচেয়ে সহজ উপায় দেশের সবগুলো ব্যাংককে ‘ব্যাসিক ব্যাংক’-এ পরিণত করে ফেলা। আমরা এখন কোন পথে যাব নীতিগতভাবে সেই সিদ্ধান্তটিও প্রচ্ছন্ন থাকা দরকার।
দায়িত্ব গ্রহণের পর আইবিবিএলের নতুন চেয়ারম্যান আরাস্তু খান ব্যাংকটির বিগত দায়িত্বশীলদের যে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, তা কেবল সৌজন্যতা ও গতানুগতিক এমনটি মনে না করাই শ্রেয়। শ্রেষ্ঠত্বের সকল সূচকে দেশের সেরা ব্যাংকই নয় কেবল, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সেরা ব্যাংক হিসেবে দেশের জন্যও সুনাম বয়ে এনেছে এই ব্যাংকটি। ‘ব্যাংকটির সততা ও স্বচ্ছতা প্রশ্নাতীত’ আরাস্তু খান সাহেবের এই মূল্যায়ন সঠিক বলেই হরিলুটের এ যুগেও হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ডেসটিনির মতো লুটেরাদের অনুপ্রবেশের সুযোগ হয়নি এখানে। সুতরাং নতুনদের জন্য এটি নতুন দায়িত্ব গ্রহণই নয় শুধু বরং নবতর এক চ্যালেঞ্জও বটে।
নতুন চেয়ারম্যানকে পূর্বসূরীদের অকুণ্ঠ প্রশংসার পাশাপাশি ব্যাংকটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের চাকুরে না থাকা এবং পরিচালনা পর্ষদে মহিলা সদস্য না থাকার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। আপত্তিগুলো সংবেদনশীল এবং এক কথায় সমর্থন বা বর্জন করার মতো নয়। কারণ চেতনা ও বিশ্বাসের মতো বিষয়গুলো এখানে সংশ্লিষ্ট এবং কোনক্রমেই উপেক্ষণীয় নয়। তবে অঙ্গুলি নির্দেশ করার মতো বোধকরি আরো বিষয় ছিল। ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধ ব্যাংকটির প্রকৃত মূলধন ও চালিকাশক্তি হলেও অনেকেই টুপি না পরলেও টাই পরেন, দাঁড়ি না রাখলেও গোঁফ রাখেন। এমনকি নামাজ ও পর্দার মতো ফরজ বিষয়গুলো অনুশীলনে গাফিলতির শিকারও নাকি কেউ কেউ। ‘ইসলামী ব্যাংক’ বলেই এ বিষয়গুলো বিচেনায় থাকা জরুরি মনে করি।
চাকরির ক্ষেত্রে মাসান্তে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি গৌন না হলেও একই সাথে আমানত ও ইবাদতের চেতনার সংযোগে দায়িত্ব পালন আদৌ এক কথা নয়। এই চেতনা লালন করেন বলেই অনেকে যেমনি কম বেতনে বেশি খাটেন, লোভনীয় অফার গ্রহণের সুযোগ থাকার পরও তা গ্রহণ করেন না, ঠিক তেমনি একই চেতনার অনুবর্তী হয়ে অনেকে দূর দূরান্ত থেকে কষ্ট ও ঝুঁকি স্বীকার করে ইসলামী ব্যাংকে যে লেনদেন করেন এ বাস্তবতা ছোট করে দেখার মতো নয়।
শতকরা হার জানা না থাকলেও ইসলামী ব্যাংকে অনেক অমুসলিমও লেনদেন করেন এই বাস্তবতা শুধু স্বস্তিদায়কই নয় বরং গর্বেরও। ঈমানী চেতনায় না হউক, সার্বজনীন সেবা, সততা ও স্বচ্ছতার মতো বিষয়গুলো যদি তাদের আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করে থাকে তাও কম কিসে? তবে ইসলামী ব্যাংকের মতো আদর্শিক চেতনা ও মূল্যবোধ দ্বারা লালিত প্রতিষ্ঠানের সেবা নেয়া আর চাকরি করার অধিকার আদৌ সমান্তরাল বিষয় নয়। কারণ এটি কেবল নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময় শ্রম দেয়া নয়। একজন অমুসলিমের কাছে অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রম দাবি করা যেতে পারে, কিন্তু চেতনা ও বিশ্বাসের দাবি করা যায় কেমন করে? ‘বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ দ্বারা পরিচালিত হিন্দু হোটেল’ এ অনেক মুসলমানকেও পানাহার করতে দেখা যায় এই যুক্তিতে মুসলিম বাবুর্চি ও কর্মচারী নিয়োগের দাবি ন্যায্য বলা যায় কী? মিশনারী স্কুলগুলোতে ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী মুসলমান বলেই কেউ কখনো মুসলমান শিক্ষক বা ম্যানেজমেন্টে মুসলমান প্রতিনিধি দাবি করেছেন কী? বরং মুসলিম শিক্ষার্থীদের ক্রুশ অংকিত ড্রেস ও মনোগ্রাম ধারণ করেই অধ্যয়ন করতে হয় বলে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বা সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন কী কেউ কখনো?
বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে অনেক অমুসলিমও ব্যবসায় করেন এই যুক্তিতে ফাউন্ডেশনে তাদেরও চাকরির অধিকার সৃষ্টি হয় কী? ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে আমাদের সেই আঙ্গিকেই ভাবতে হবে। এটা সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়াই প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন বলে বিবেচিত হবে, হিন্দু হোটেলে মুসলমান নিয়োগের মতোই। তার পরও কথা আছে- নিয়োগের দৌড়টা কতদূর হবে এবং তা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
যে কথাটি না বললেই নয়, আমাদের প্রাজ্ঞ অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় আইবিবিএল ‘দেশের এক নম্বর ব্যাংক’ তাদের সততা ও স্বচ্ছতাও বলা হয় প্রশ্নাতীত। বার বার রিওয়ার্ড প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে দেশের জন্য সুনামও বয়ে আনছে ব্যাংকটি। বিশ্বের সেরা ৫০০ ব্যাংকের মধ্যে এটি বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক। ‘ইসলামী’ শব্দটির কারণে জঙ্গি অর্থায়নের কল্পিত অভিযোগ বরাবরই বুমেরাং। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব জোগানে যাদের অবস্থান সব সময় প্রথম বা দ্বিতীয়, দারিদ্র্য বিমোচনে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের অবদান তুলনাহীন তেমন একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ‘বিদেশী চাপ’ কার স্বার্থে বিষয়টি জাতীয় প্রয়োজনেই স্পষ্ট হওয়া উচিত নয় কী? বাংলাদেশের কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে উঠে আসা অনেকের কাছেই চুক্ষশূলের মতো অসহনীয় ঠেকতেই পারে কিন্তু তাই বলে আমাদের কাছেও? সোনালী ব্যাংককে দু’বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াবার আল্টিমেটাম দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী কিন্তু এক্ষেত্রে অভিপ্রায়টাই কী যথেষ্ট? তাছাড়া অর্থমন্ত্রীর আহ্বান দু’বছর পর্যন্ত কেউ মনে রাখবে কী? অর্থমন্ত্রী নির্ভরশীল সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে হয়রান! নিয়ত ছহি হলে যোগ্যতা, সততা ও দক্ষতায় প্রশ্নাতীতভাবে যারা ‘এক নম্বর’ তাদের অসুস্থতার অজুহাতে ঘরে পাঠিয়ে না দিয়ে বেহাল ব্যাংকগুলোর হাল ধরার আহ্বান জানাতে কার্পণ্য কেন? ইসলামী ব্যাংকে বিবর্তন ঘটাতে মরহুম লুৎফর রহমান সরকারের অবদান কী অস্বীকার করার মতো? অপ্রাসঙ্গিক হবে না বিবেচনায় ইতিহাস থেকে দু’টি দৃষ্টান্ত পেশ করে লেখা শেষ করছি। বদরযুদ্ধে পরাজিত কুরাইশদের ৭০ জন বন্দি হলেন যাদের মধ্যে তৎকালীন মক্কার কতিপয় শিক্ষিত ব্যক্তিত্বও ছিলেন। রাসূল (সা.) সিদ্ধান্ত দিলেন, প্রতিজন শিক্ষিত বন্দি মুক্তিপণের বিনিময়ে মদিনার ১০ জন করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে এবং যত স্বল্প সময় টার্গেট (সিলেবাস) শেষ করতে সক্ষম হবে সে তত তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবে। আমাদের জন্য এতে শেখার কিছু আছে কী? পরবর্তীকালে এই বন্দিদের অনেকেই মুসলমান হয়ে ইসলামের খেদমতেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
ঠিক এর উল্টোটা করলেন হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের অন্যতম কারণ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন জার্মানীর নাগরিক। ইহুদি বলেই হিটলার তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জান বাঁচাতে তিনি জার্মানী ত্যাগ করলেন। হিটলার ভাবলেন আপদ গেল। আর আমেরিকা এই প্রতিভাকে সাদরে লুফে নিল। একের পর এক নতুন যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে আইনস্টাইনের মেধা ও সহযোগিতা কাজে লাগাতে থাকলো আমেরিকা, শেষতক আণবিক বোমাতে যার চূড়ান্ত পরিণতি।
আইবিবিএলের অসাধারণ প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে অনেকের মতো এক সময় কৌতূহল ছিল আমারও। ২২/২৩ বছর আগে ২৫ হাজার টাকার একটি বিনিয়োগ নিয়েছিলাম। মেয়াদান্তেও কিছু টাকা বকেয়া রয়ে গেল। বিরামহীন তাগিদে অস্থির হয়ে গেলাম। সাপ্তাহ না জেতেই তাগিদপত্র। গিন্নী বললেন টাকা কয়টা দিয়ে আস, তা না হলে ইজ্জত থাকছে না। বিরক্ত হয়ে ‘ম্যানেজারকে দু’কথা শুনিয়ে আসি’ এই ভাব নিয়ে এক দিন ব্যাংকে গেলাম। চেম্বারে বসে তিনি কথা বলছিলেন গ্রাহকদের সাথে। সেকেন্ড অফিসারের সামনে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এক সময় লোকগুলো বের হয়ে গেলে ম্যানেজার সাহেব উঠে ফ্যানটা বন্ধ করে দিলেন। ‘বেরিয়ে যাচ্ছেন’ ভেবে আমিও উঠে দাঁড়ালাম। সেকেন্ড অফিসার বললেন, ‘বসুন, স্যার যাচ্ছেন না।’ ‘কেন, ঐ যে ফ্যান বন্ধ করে দিলেন?’ সেকেন্ড অফিসার বললেন, ‘নামাজের সময় হয়েছে, অজু করতে যাচ্ছেন।’ আমি অবাক হলাম। মনের ক্ষোভ অর্ধেকটা এখানেই মিটে গেল। নামাজের পর চেম্বারে গেলাম। অসহনীয় তাগিদের ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে অন্যান্য ব্যাংকের উদাহরণ টেনে এটা যে এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি বলে বোঝাতে চাইলাম। আমার অভিযোগের জবাবে ম্যানেজার সাহেব যা বললেন তা মোটামুটি এই: ‘খেলাপি ঋণের ওপর সুদি ব্যাংকগুলো যে সুদ চার্জ করে তা তাদের প্রফিটে সংযুক্ত হলেও ইসলামী ব্যাংকগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে আরোপিত চার্জ প্রফিটে নিতে পারে না। এটি ভিন্ন খাতে রাখা হয় এবং কল্যাণমূলক কাজে খরচ করা হয়। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। নিজেকে এক্ষুনে অপরাধীই বোধ হলো। বললাম, তাগিদ দেয়ার আর প্রয়োজন নেই। এখন থেকেই ব্যাংকের পাওনাটা পরিশোধ করাই হবে আমার প্রথম ও প্রধান কাজ।’
অন্য একটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে চাকরি করেন এমন একজনকে দেখেছি। তাঁর দুটি মোবাইল। একটি ব্যাংকের। কোন সময়ই তাকে ব্যাংকের মোবাইলে কল করতে দেখিনি। এর পাশাপাশি এমন নজিরেরও বোধ করি অভাব নেই যাদের ছেলেমেয়ের কাগজ-কলম কেনার তেমন একটা প্রয়োজনই পড়ে না। ভুয়া ভাউচারে রিকশাভাড়া-নাশতা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই চলে। শত নয় হাজারো অফিসার-কর্মচারী কোন কাজ না করেই মাস শেষে শুধু বেতনই নেন না বরং শাখায় শাখায় ঘুরে চাঁদাও তোলেন। অথচ ম্যানেজমেন্ট তাদেরই সমীহ করেন বা করতে একান্তভাবেই বাধ্য। এমন অবস্থার তৃণমূল পরিবর্তন না ঘটিয়ে ‘ঘুরে দাঁড়াবার’ আহ্বানের সফলতা কীভাবে আশা করা যেতে পারে?
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ