বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আল ফাতাহ মামুন : রক্ষক যখন ভক্ষক- কথাটি হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের বেলায় অনেকাংশে সত্য। সুন্দর ও নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব তারাই যাত্রী হয়রানির নায়কের ভূমিকা পালন করছেন। অসংখ্য অভিযোগ, মন্ত্রীপর্যায়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ, সিভিল এভিয়েশনের কড়া তদারকি, প্রশাসনিক নজরদারিসহ গোয়েন্দা বিভাগগুলোর নানামুখী তৎপরতার পরও বন্ধ হচ্ছে না হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি। বিমানবন্দরে প্রবেশপথের মোড় থেকেই শুরু হয় হয়রানি। এরপর কনকর্স হল, মূল ভবন, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস পোস্টসহ ঘাটে ঘাটে চলে হয়রানির মহোৎসব।
যাত্রীদের লাগেজ প্রদানের ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপণ, যাত্রীদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ না করা, হুমকি-ধমকিতে যাত্রীদের আতঙ্কিত করে তোলাসহ নানা রকম ভয় দেখিয়ে তাদের টাকা-পয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু বিমান কর্মচারী। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে কর্মত বাংলাদেশিরা। ইমিগ্রেশন বিভাগে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা এসব প্রবাসী কর্মজীবীর সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেন। তুই-তুকারি করে কথা বলা, পেটে কলমের গুঁতা দেওয়া, ইয়ার্কির ছলে দুই হাতে গলা চেপে ধরে পাছায় লাথি মেরে হটিয়ে দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অপমানজনক ঘটনায় ক্ষুব্ধ অনেক যাত্রী রাগে-দুঃখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন, অপমান-লজ্জায় বিমানবন্দরের মেঝেতে গড়াগড়ি পর্যন্ত দেন। অনেকে জীবনে আর কখনো দেশে না ফেরার শপথ পর্যন্ত করেন। বিমানবন্দরে কাস্টমস চেকিং পয়েন্টে মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী বাঙালিদের পাসপোর্ট হাতে নিয়েই লাগেজ টেপাটেপি শুরু করা হয়। দায়িত্বরত একশ্রেণির কর্মকর্তার প্রথম প্রশ্ন থাকে, ‘কয় বছর পর দেশে আসলি? আমাদের জন্য কী আনছোস তাড়াতাড়ি দে।’ মান-সম্মানের দিকে তাকিয়ে ভুক্তভোগী যাত্রীরা বিদেশি মুদ্রা হাতে গুঁজে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসেন। বিমানবন্দরের দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক গেল শনিবার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে যাত্রীদের মালামাল তল্লাাশি ও হয়রানির জন্য দায়িত্বরত আর্মড পুলিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, আর্মড পুলিশের দায়িত্ব হলো বহির্গমন, পার্কিং লট, ক্যানোপি, কনকর্স হল, আগমনী কনভেয়ার বেল্ট, টারমাক, রানওয়ে, ড্রাইওয়ে ও অ্যাপ্রোন এলাকায় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকা। কিন্তু তারা অধিকাংশ সময়ই ব্যস্ত থাকে আগমনী আর কার পার্কিং এলাকায় যাত্রীদের মালামাল তল্লাশির কাজে। বিদেশ থেকে আসা অনেক যাত্রী বিমানবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গাড়িতে ওঠার পরই এই আর্মড পুলিশের তল্লাশির মুখোমুখি হন। নানা প্রশ্নে বিব্রত করা হয় যাত্রীদের। টানাহেঁচড়া করে আবার বিমানবন্দরের ভিতর নেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।
হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাইরের তুলনায় ভেতরে বেশি হয়রানির শিকার হন যাত্রীরা। যাত্রীসেবায় নিয়োজিত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর পুলিশ, কাস্টমস, কেবিন ক্রুসহ বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের একটা বড় অংশই সংঘবদ্ধভাবেই যাত্রী হয়রানি করছেন। বিমানবন্দর অভ্যন্তরের অন্তত ১০টি ধাপে যাত্রীদের কাছ থেকে চাহিদামাফিক টাকা হাতানো হয় বলে ভুক্তভোগী যাত্রীরা স্বীকার করেছেন। বিমানবন্দরের ভেতর ব্যাংকের বুথে মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়েও হয়রানির শিকার হন যাত্রীরা। মুদ্রা সংগ্রহে গেলে ব্যাংক থেকে জানানো হয়, সংল্লিষ্ট দেশের মুদ্রা নেই। অবশেষে বাধ্য হয়েই ব্যাংকের আশপাশে অবস্থানকারী অবৈধ মুদ্রা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পয়োজনীয় দেশের মুদ্রা মাত্রাতিরিক্ত দামে সংগ্রহ করতে হয়। যাত্রীরা বিদেশ গমনের সময় বহির্গমন লাউঞ্জের প্রবেশমুখে কর্তব্যরত একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর খপ্পরে পড়েন। সেখানে টার্গেটকৃত যাত্রীদের পাসপোর্ট, টিকিট ইত্যাদি চেক করার সময় জানানো হয়, তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে। কাজেই তাকে দেশ ছেড়ে যেতে দেওয়া সম্ভব নয়। বিমানে ওঠার আগ মুহুর্তেই একজন যাত্রীর জন্য এমন সংবাদ কতটা অসস্বস্তিকর তা সহজেই অনুমেয়। এই অবস্থায় অফিসারদের ‘ম্যানেজ’ বাবদ হাজার হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয় যাত্রীকে।
এছাড়া কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাবেও হয়রানি হতে হয় যাত্রীদের। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব বিভাগে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হলেও যথেষ্ট দক্ষ নন। তারা ধীরগতিতে কোনোরকম কাজকর্ম চালিয়ে নেন মাত্র। এতে যাত্রীদের প্রতিক্ষার প্রহর হয় দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘ। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যথেষ্ট সময় নেন তারা। পাশের দেশগুলোর বিমানবন্দরে একেকজন যাত্রীর সব কাগজপত্র পরীক্ষা করতে সময় লাগে পাঁচ-সাত মিনিট। আর শাহজালাল বিমানবন্দরে একেকজন যাত্রীকে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ২০-২৫ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অদক্ষ কর্মী দিয়ে কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থাপনা চালাতে গিয়ে ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র শেষ করতে বেশির ভাগ সময়ই ফ্লাইট বিলম্বিত হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবচেয়ে বড় হয়রানি বোধহয় লাগেজ সংগ্রহরের সময় পোহাতে হয়। লাগেজ সংগ্রহের জন্য বেল্টের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের অপেক্ষা করানো হয়। এই সুযোগে সংঘবদ্ধ চক্র লাগেজ কেটে ভিতরের মালামাল সরিয়ে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে গোটা লাগেজই গায়েব করে দেয়া হয়। এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এ ছাড়া লাগেজ আসেনি, পরবর্তী ফ্লাইটে আসবে- এসব কথা বলে চিরকুটে দায়িত্বরত কর্মকর্তার মোবাইল ফোন নম্বর লিখে দিয়েই যাত্রীকে বিদায় করা হয় বলেও জানাগেছে। এর পরই শুরু হয় হয়রানির নানা ধাপ। কয়েক দফা বিমানবন্দরে ঘোরাঘুরি করানোর একপর্যায় টাকা লেনদেনের বিনিময়ে লাগেজ ফেরত পেতে হয়। লাগেজ পাওয়ার পর দেখা যায় অনেক জিনিসই পাওয়া যাচ্ছে না। যতেœর সঙ্গে না রাখার কারণে লাগেজের অনেক জিনিসই নষ্ট হয় কিংবা ভেঙ্গে যায়। অনেকসময় তো যাত্রীর সামেনই তার লাগেজটি সজোরে আছড়ে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। কিন্তু কিছুই বলা যায় না এসবের বিরুদ্ধে। বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো ভুক্তভোগীকেই ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। হাত তোলা হয় গায়েও।
তবে আশার কথা হচ্ছে, শাহাজালাল বিমানবন্দরের যাত্রীদের হয়রানি রোধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের তৎপরতায় অনেকটা স্বস্তি এনেছে যাত্রীদের মাঝে। অযাচিত হয়রানির শিকার যাত্রীদের ফেসবুকে পাঠানো খুদে বার্তা বা মোবাইল ফোনের কল পেলেই দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ছুটে যাচ্ছেন ঘটনাস্থলে। যাত্রীর অভিযোগ শুনে ও ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে ততক্ষণাৎ হয়রানিমুক্তির ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। হয়রানি কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে। লাগেজ হারানোর ক্ষেত্রেও মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থাপনায় যাত্রীরা ততক্ষণাৎ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন। অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাচ্ছেন শাস্তি। তবে এটা সত্য যে, ম্যাজিস্ট্রেটদের পক্ষে সম্ভব নয় পুরো বিমনাবন্দরের শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে রাখা।
বিমান বন্দরের মতো জায়গায় আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনিত কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, বিমানবন্দর একটি দেশের রুচি-সভ্যতার অনেক বড় পরিচয় বহন করে। এখানে সেবা-শৃংখলা ভালো মানে পুরো দেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের ধারণা ভালো হওয়া, আর এখানের সেবা খারাপ মানে বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের দেশের দুর্নীতি-অনিয়ম কাপড় খুলে দেখিয়ে দেয়া। তাই আমরা মনে কির, দেশের মুখ উজ্জ্বল করতেই বিমান সেবার সুদিন ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।