Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ট্রেন চালনায় নারী

প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪১ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। নারীরা চালাচ্ছেন ট্রেন? তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। কেউ হন বিস্মিত, কেউবা মুগ্ধ। অনেকেই প্রশ্ন করেন, এটা কি সম্ভব? পার্বতীপুরের সহকারী লোকো মাস্টার বেবি ইয়াসমিন বললেন, কাজের ক্ষেত্রে পুরুষ যা পারে নারীরাও তাই পারে। দাদু ও বাবা দু’জনেই চাকরি করতেন রেলওয়েতে। সে সুবাদে এখানে আসা। আর ট্রেনচালক হিসেবে যোগদান করতে পেরে আমি গর্বিত। বেবি ইয়াসমিন ছাড়া আরও ১৪ জন নারী ট্রেনচালক আছেন সারা বাংলাদেশে। তাদের মধ্যে প্রথম এসেছেন টাঙ্গাইলের সালমা খাতুন। বাংলাদেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক তিনিই। ঢাকায় কর্মরত সালমা বললেন, এ পেশা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। খুব এনজয় করি। আর কিছুদিন পরেই সালমা ছুটবেন দ্রুতগামী ট্রেন নিয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। সাব-লোকো মাস্টার (এসএএলএম) থেকে সালমা তখন অ্যাসিসটেন্ট লোকো মাস্টার (এএলএম) হবেন। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রেলওয়েতে ট্রেন চালনায় ১৫ জন নারী আছেন। পর্যায়ক্রমে ট্রেনিং শেষ করে তারা একদিন সারাদেশে দ্রুতগামী ট্রেন চালিয়ে বেড়াবেন। ট্রেনের মূল চালককে বলা হয় লোকো মাস্টার বা সংক্ষেপে এলএম। প্রতিটি ট্রেনে মূল চালকের সঙ্গে একজন সহকারী চালক বা এএলএম থাকেন। এএলএম থেকে লোকো মাস্টার বা পূর্ণাঙ্গ চালক হতে সময় লাগে কমপক্ষে ১০-১২ বছর। এখানে আবার গ্রেডিংয়ের বিষয় আছে। সাব লোকো মাস্টার থেকে তিন বছর পর সহকারী লোকো মাস্টার হতে হয়। লোকো মাস্টারকে শুধু ট্রেনচালনাই নয়, পাশাপাশি ট্রেনের ইঞ্জিনের যান্ত্রিক ও তড়িৎ (ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল) বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন করে ইঞ্জিনের যান্ত্রিক ত্রুটি ও রক্ষণাবেক্ষণসহ ছোটখাটো মেরামতের কাজও শিখতে হয়। জানতে হয় সিগন্যাল ব্যবস্থা ও ট্রেনের রুট। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী জানান, আপাতত ঢাকায় সালমা একাই কাজ করছেন। সালমা ছাড়াও চট্টগ্রামে আছেন পাঁচজন। তারা হলেন, খুরশিদা আক্তার, উম্মে সালমা সিদ্দীকা, কুলসুম আক্তার, রেহানা আবেদিন ও কোহিনুর আক্তার। চারজন এএলএম আছেন লালমনিরহাটে। তারা হলেন আফরোজা বেগম, ফরিদা আক্তার, নাছরিন আক্তার ও মুনিফা আক্তার। কৃষ্ণা সরকার আছেন পাবনার ঈশ্বরদীতে। তাঁরা সবাই যোগ দিয়েছিলেন ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। আর ২০১৪ সালে বেবি ইয়াসমিন, ছিপি খাতুন ও এ্যানি যোগ দিয়েছেন এএলএম হিসাবে। তারা রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে কাজ করছেন। এই ১৫ জনের মধ্যে চারজন যোগ দিয়েছেন ব্রডগেজে। বাকীরা সব মিটার গেজে। মিটারগেজের চেয়ে ব্রডগেজের ট্রেনের গতিবেগ অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিও বেশি। জানতে চাইলে ব্রডগেজের এএলএম বেবি ইয়াসমিন বলেন, যেহেতু ট্রেনচালনার উদ্দেশ্য নিয়েই এই চাকরিতে ঢুকেছি সেহেতু যেখানে যেতে বলবে সেখানে যেতে বাধ্য আমরা। এখানে ভয় পেলে চলবে না। তিনি বলেন, আমার ট্রেনিং শেষ। এখন পার্ব্বতীপুর লোকো শেডে ‘বুকিং ক্লার্ক’ হিসাবে কর্মরত আছি। এখানে কাজ হলো ট্রেনের ইঞ্জিন ও লোকো মাস্টারদের ডিউটি রোস্টার তৈরী করা। বেবি বলেন, ইতোমধ্যে আমি রুট চেনার জন্য লংরুটে গেছি। কিছুদিনের মধ্যেই দ্রুতগামী ট্রেনে সহকারী চালক হিসাবে যোগদানের সুযোগ হবে। পার্ব্বতীপুরের একজন গ্রেড-১ লোকো মাস্টার বলেন, বেবি অত্যন্ত দক্ষ চালক হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচ- পরিশ্রমী এবং কর্তব্যপরায়ণ মেয়েটি নিঃসন্দেহে এ পেশায় ভালো করবে। যদিও লং রুটে ডিউটি করা অনেক কষ্টের। কারন সিডিউল বিপর্যয়ের কবলে পড়ে ট্রেন যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকে তখন যাত্রীদের বিরক্তি প্রকাশের সুযোগ থাকলেও চালক বা সহকারী চালকের সে সুযোগ নেই। যা-ই কিছু ঘটুক না কেন গন্তব্যে পৌঁছে আরেক চালককে ইঞ্জিনের দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই।
এসব বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন বাংলাদেশের প্রথম ট্রেনচালক সালমা খাতুন। তিনি বলেন, নারী হিসাবে নয় চালক হিসাবেই ট্রেনের ইঞ্জিনে উঠি। এসময় সব ধরনের অসুবিধা বা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার মতো মন মানসিকতা তৈরি করে নিয়েছি। আশা করি খুব একটা অসুবিধা হবে না। ছোটবেলায় সালমার প্রিয় খেলনা ছিল ট্রেন। খেলতে খেলতেই ট্রেনের প্রতি ভালোবাসা যেনো তৈরি হয়েই ছিল। সালমা বলেন, প্রথাগত পেশার বাইরে কিছু করার স্বপ্ন ছিল। তবে কাজটি সহজ নয়। রেলওয়েতে বাবার চাকরির সুবাদে এ পেশা সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানতাম। ট্রেন চালাতে ভালো লাগে এই কারণে যে এখন আরও অনেক মেয়ে আসছেন। যত বেশি মেয়ে এ পেশায় আসবেন, তত তাড়াতাড়ি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে। প্রথম নারী ট্রেনচালক বলেন, আমি এখন কমলাপুরে কাজ করছি। কোনো ট্রেন এলে ইঞ্জিন খুলে সেটি চালিয়ে আরেকটাতে লাগাই। কমলাপুরে হাজার হাজার মানুষের সামনে যখন এ কাজ করি তখন অনেকেই বিস্ময় নিয়ে থাকে। অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীকে দেখান।
নরসিংদীর মেয়ে সালমা বেগম উচ্চমাধ্যমিক পাস করে যোগ দেন এএলএম হিসেবে। তবে এখনো লেখপাড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম কলেজে স্নাতক (সম্মান) পড়ছেন। সহকারী চালক হিসাবে প্রায়ই ডেমু ট্রেন নিয়ে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের প্রশ্নের শেষ নেই। তারা জানতে চান মেয়ে হয়েও এত সাহস পাই কী করে? ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এএলএম হয়েছেন চাঁদপুরের মেয়ে কুলসুম আক্তার। তাঁরও চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। তবে রেলওয়েতে যোগ দেবেন এমনটা ভাবেননি। তিনি বলেন, নানা জায়গায় চাকরির আবেদন করেছিলাম। এখানে হয়ে গেল। চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসাবে মনের মতো কাজ পেলাম। বিয়ে করেছেন ট্রেনেরই এক সহকারী চালককে। ডেমু ট্রেন নিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান কুলসুম। এক সাথে এত শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে খুব ভালো লাগে তার। দিনাজপুরের পার্ব্বতীপুরের মেয়ে নাছরিন আক্তারের। ডিগ্রি পাস করে তিনি রেলওয়েতে যোগ দিয়েছেন। এখন ডেমু ট্রেনের সহকারী হিসাবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, সহকারী চালক হিসেবে কাজ করতে ভালই লাগে। দারুন উপভোগ করি।
কুমিল্লার মেয়ে রেহানা আবেদিনের নানা ছিলেন রেলের লোকো মাস্টার। বাবাও রেলের কর্মকর্তা। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে নিজেও চলে আসেন এ পেশায়। মাঝেমধ্যেই ট্রেনে সহকারী চালক হিসেবে থাকেন। তিনি বলেন, ট্রেনের চালক হিসাবে আমাদের নিয়ে মানুষের অনেক আগ্রহ। নড়াইলের লোহাগড়ার মেয়ে কৃষ্ণা সরকার। যশোর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে তিনি এসেছেন এই পেশায়। এখন কাজ করছেন পাবনার ঈশ্বরদীর লোকোশেডে। কৃষ্ণা বলেন, খবরের কাগজে পড়েছিলাম দেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক সালমা আপার থা। মনে হলো আমিও পারব। আমি মনে করি শিক্ষিত লোকজন এই পেশায় এলে মানুষের শ্রদ্ধা আরও বাড়বে। চট্টগ্রামের মেয়ে উম্মে সালমা সিদ্দিকী বলেন, ছোটবেলা থেকেই ট্রেন দেখছি। তখন অনেক বড় মনে হতো একেকটা ট্রেনকে। এখন যখন ট্রেনের সহকারী চালক হিসেবে থাকি, তখন আর এত বড় মনে হয় না।
আফরোজার বাড়ি লালমনিরহাটের। এখন লালমনিরহাটেই আছেন। তিনি বলেন, অনেকে চালকের স্থানে একজন নারীকে দেখে বিস্মিত হন। এই বিস্ময় উপভোগ করি। অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা জানতে চায় কাজটা কেমন? আমিও উৎসাহ দিই। আফরোজার স্বামীও ট্রেনচালক। ২০১২ সালে রেলওয়েতে ৫৩ জন এএলএম যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন নারী ফরিদা আক্তার। বাড়ি বগুড়া। অত্যন্ত সাহসী ফরিদা ট্রেন চালনা দারুণভাবে উপভোগ করেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুরুষের পাশাপাশি সব ধরনের কাজ শিখলেও এখনো দূরের রাস্তায় নানা কারণেই আমরা মেয়েদের পাঠাতে পারছি না। অথচ তাঁরা সেটিও পারবেন তাতে কোনো সন্দে নেই। তিনি বলেন, মেয়েদের যেমন এই পেশার চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে, তেমনি সমাজের সবাইকেও এদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে হবে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ বছরের মধ্যেই আরও কয়েকটি নতুন ট্রেন যুক্ত হবে রেলওয়ের দুই জোনের বহরে। আসবে স্টিলের অত্যাধুনিক কোচ, নতুন ইঞ্জিন। কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেনে যুক্ত হবে ফাইভ স্টার আদলের নতুন কেবিন। এরই মধ্যে নারী সহকারী চালকদের অনেকেই সহকারী চালক হিসাবে গ্রেড-২-তে উন্নীত হবেন। তখন আর তাদের দূরের গন্তব্যে ট্রেন চালনাতে কোনো বাধা থাকবে না। দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছুটে চলবেন এই নারীরাই। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন যখন কোনো স্টেশনে ঢুকবে তখন আগ্রহী যাত্রীদের অনেকেই ইঞ্জিনের দিকে আগে লক্ষ্য করবেন, ট্রেনের চালক নারী নাকি পুরুষ!



 

Show all comments
  • Zarjish ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১১:৫৮ এএম says : 0
    valo to, valo na!!!!!!!!!!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রেন চালনায় নারী

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ