বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মীর আব্দুল আলীম
সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার কতটা করতে পেরেছি আমরা? আমাদের আদালতে ইংরেজিতে রায় দেয়া হচ্ছে। ডাক্তারগণ ইংরেজিতে ব্যবস্থাপত্র লিখছেন। কোনো কোনো মহল ভিনদেশি ভাষা চর্চার নামে এক ধরনের বাংলার বিকৃত চর্চা করে বাংলাভাষাকে হেয় করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি আমাদের গণমাধ্যমেও প্রায়ই আমরা বিকৃত বাংলার ব্যবহার দেখতে পাই। বিশেষ করে, দেশের কিছু এফএম রেডিও এবং কিছু টিভি উপস্থাপক এই বিকৃত চর্চাকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে। এটা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা। বিকৃত ভাষা ব্যবহারের মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
স্পষ্ট বোঝা যায় আমাদের ‘সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার চাওয়াটা’ অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। এ চাওয়া কেউ পূরণ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে কেউ আমাদের সংগঠিত করেনি। তাই আজও সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন সম্ভব হয়নি। আমার প্রশ্ন যেখানে বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজি বোঝেন না সেখানে ডাক্তাররা কেন ইংরেজিতে ব্যবস্থাপত্র লিখবেন? একজন কৃষক, দিনমজুর কেন ইংরেজি ভাষায় রায় পাবেন? এছাড়া বাংলাভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। এতো কষ্টে পাওয়া ভাষার সৎ ব্যবহার কিন্তু আমরা করছি না। ভাষাকে যে যার মতো বিকৃত করছি সর্বক্ষেত্রে। এজন্য তরুণ প্রজন্মকে অগ্রণী ভূমিকায় থাকতে হবে। বিকৃত ভাষা ব্যবহার বন্ধ করে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তরুণরা উদ্যোগী হলে বাংলাভাষা পূর্ণ মর্যাদা ফিরে পাবে। বাংলাভাষা সঠিকভাবে শিখতে হবে এবং শুদ্ধরূপে বাংলা বলতে ও লিখতে হবে। বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অন্য ভাষাও শেখা দরকার, তবে বাংলাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে দেশের সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
ভাষার জন্য বহু প্রাণ ঝড়ে গেছে এই বাংলায়। ভাষার জন্য এভাবে প্রাণ দেয়ার নজির বিশ্বের কোথাও নেই। বাঙালিরাই সর্ব প্রথম রাজপথে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাভাষায় কথা বলার অধিকার সমুন্নত রেখেছেন। এই শহীদদেও রক্তের বিনিময়ে বাংলা এখন বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলোর একটি। গর্বিত পূর্বপুরুষদের রক্তের ধারাবাহিকতায় আমাদের নতুন প্রজন্ম ১৯৯৯ খ্রি. জাতিসংঘ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপনের স্থায়ী ব্যবস্থা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবী ও সভ্যতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, হাজার হাজার ভাষা ইতোমধ্যে বিলুপ্তির খাতায় নাম লিখিয়েছে। আবার স্কটল্যান্ডের অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অখ্যাত ভাষা ইংরেজি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাষার আসন দখল করেছে। অন্যদিকে, যে বাংলাভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের মেধা দিয়ে, রক্ত দিয়ে, সংগ্রাম দিয়ে সেই ভাষা আজও অবহেলিত। মহান একুশের চেতনাকে শাণিত করে বাংলাভাষাকে এবং বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষায় নতুন প্রজন্মকে আঁকড়ে ধরতে হবে নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে। তাতে করে বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা অচিরেই জাতিসংঘের অন্যতম অফিসিয়াল (দাপ্তরিক) ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হবে।
বাংলাভাষা প্রয়োগে কোথায় যেন এক ধরনের অবহেলা। কোথায় যেন এক ধরনের হীনমন্যতা। কেন এমন করা হয়? এ সব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। বলবার আর অপেক্ষা রাখে না যে দেশে বাংলার অবমাননা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভুলে ভরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টারেও বানানরীতি মানা হচ্ছে না। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পরও ভুল বানানের ছড়াছড়ি সর্বত্র। যুগের পর যুগ নানাভাবে এ বিষয়ে কথা উঠলেও বাংলার অবমাননা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এমনকি এ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশেরও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। শুধু রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সড়ক-ফুটপাতে বা ভবনের দেয়ালে সাঁটানো সাইনবোর্ড কিংবা বিলবোর্ডগুলোতে চোখ বুলালেই বাস্তব দৃশ্যটি ফুটে উঠবে। রাজধানীর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই নামকরণ করা হয়েছে বিদেশি ভাষায়।
কোথাও বিদেশি শব্দ লেখা হয়েছে বাংলায়। আবার কোথাও অহেতুক বাংলা শব্দকে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। আবার কোথাওবা বাংলা-ইংরেজির মিশেল আর ভুল বানানের ছড়াছড়ি। ঢাকার সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। উত্তরা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত শত শত বিপণিবিতান আর দোকানে লক্ষ করা গেছে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড। ইংরেজি নাম লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। সেঞ্চুরি, টপ ফ্যাশন, ক্যাটস আই, মনসুন-পোশাকের দোকানের এমন অজস্র সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। শহরজুড়ে মোবাইল ফোন কোম্পানির ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজি ভাষা। হাউজিং কোম্পানির বিলবোর্ডেরও দশা একই। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট (নিমকো) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর কাঁটাবন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ৫শ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র অর্ধশতাধিক নামফলক বা সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। ইংরেজি ভাষায় নামফলকের সংখ্যা আড়াই শতাধিক এবং অবশিষ্টগুলো লেখা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে। এয়ারপোর্ট রোড থেকে শুরু হয়ে প্রগতি সরণির দুই দিকে গড়ে ওঠা প্রায় সব দোকানের সাইনবোর্ডে সরণি বানান ভুল। কোনোটিতে লেখা হয়েছে ‘স্মরনি’, কোনোটিতে ‘স্বরনী’। রামপুরা সেতুর কাছে আনসার ও ভিডিপি ইউনিটের কার্যালয়ের সাইনবোর্ডটিতে গণপ্রজাতন্ত্রী শব্দটি লেখা ছিল ‘ন’ দিয়ে। পূর্ব রামপুরায় একটি সাইনবোর্ডে লেখা স্নেহময় মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্র। রামপুরা, মৌচাক, মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর, কাকরাইল, বিজয়নগর হয়ে পল্টন পর্যন্ত অধিকাংশ বিজ্ঞাপন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে বিদেশি ভাষায়। খাবারের দোকানগুলোতে দেশি খাবারের নামের বানানেও করা হয়েছে ভুল। যেমন-মালিবাগ মোড়ের একটি খাবারের দোকানে বিরিয়ানি না লিখে লেখা হয়েছে ‘বিরানী’, কোথাও লেখা হয়েছে ভর্তার পরিবর্তে ‘ভরতা’ এরকম অসংখ্য ভুল।
বাংলাভাষা নিয়ে তর্ক বহুদিনের পুরনো। বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুহিতা জেনে অনেকে গৌরব বোধ করেন। অনেকের আবার এ ধরনের জন্মগত সম্পর্ক মেনে নিতে রয়েছে প্রবল আপত্তি। এ তর্ক নতুন করে শুরু করার আগে আসুন আমরা আলোচনা করে ঠিক করি, ‘বাংলা ভাষা’ বা ‘সংস্কৃত ভাষা’ বলতে আমরা কি বুঝবো? ‘বাংলা ভাষা’র দুটি সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ভারতের বিহার, আসাম ও বার্মার আরাকান অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে সর্বজনবোধ্য যে মান উপভাষাটি আছে যাকে সাধারণভাবে ‘মান চলিত বাংলা’ বলা হয়। সেটাকে ‘বাংলা’ বলা যেতে পারে। এ ছাড়াও এ অঞ্চলে প্রচলিত বিশেষ কিছু ইন্দো-আর্য্য উপভাষার (যেমন চট্টগ্রাম, সিলেট, মেদিনীপুর, বীরভূম অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষা) সমষ্টিকেও ‘বাংলা ভাষা’ বলা যেতে পারে। ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি সব ভাষার ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা আছে। তবে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ইংরেজি বা ফরাসির মতো ভাষার ক্ষেত্রে একাধিক মান ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে (যেমন, যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রে আলাদা আলাদা মান ইংরেজি রয়েছে, ফ্রান্স আর কানাডার কুইবেকে রয়েছে আলাদা আলাদা মান ফরাসি)। সুতরাং ‘ইংরেজি’ বা ‘ফরাসি’ বলতে বোঝাবে সেই মান ভাষাগুলোর যে কোন একটিকে, বা একসঙ্গে ইংরেজি বা ফরাসির সবগুলো উপভাষাকে। মোটকথা, বর্তমান প‘থিবীতে ‹ভাষা› কথাটির অন্ততপক্ষে দুটি আলাদা অর্থ রয়েছে : ১. সর্বজনবোধ্য মান উপভাষা, এবং ২. সবগুলো উপভাষার সমষ্টি, সুতরাং ১. ‘বাংলা’ বলতে সর্বজনবোধ্য মান বাংলাকে বোঝাতে পারে আবার ২. সবগুলো আঞ্চলিক বাংলা সমষ্টিকেও ‘বাংলা’ বলা যেতে পারে। কিন্তু তার বালাই রাখছে কোথায় বাঙালি?
২১ শে ফেব্রুয়ারি বা ভাষা আন্দোলন স্কুলের পাঠ্যবইয়েই সীমাবদ্ধ থাকে বর্তমানে। একুশের ভোরেই কেবল অধুনা বাংলাদেশের মানুষের গন্তব্য হয় শহীদ মিনার। এই বিশেষ দিনটিতে মানুষের ঢল নামে পথে। বাংলাভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে শুধু নয় অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে বিসর্জিত প্রাণগুলোর জন্য অন্তর থেকে বর্ষিত হয় শ্রদ্ধা। ফুলের স্তবকে, গানে প্রকাশ পায় আবেগ। হৃদয় উদ্বেলিত হয় বাঙালি হওয়ার গৌরবে। কিন্তু সত্যিই কি আজ সেই রক্তে রাঙানো প্রেক্ষাপট আত্মস্থ করা সম্ভব হচ্ছে? এখন তো ইংরেজি শিক্ষার যুগ! যদিও আমি এই শিক্ষার বিপক্ষে নই। এই বিশ্বায়নের যুগে জাতি-ধর্ম-দেশ-মহাদেশ নির্বিশেষে একটিই সাধারণ ভাষা থাকলে সুবিধে হয় তা আজ দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপলব্ধি করাই যায়। আজ বাঙালি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা শীর্ষস্থানও লাভ করেছে এবং করছে। কিন্তু যে ভাষার নামে তাদের পরিচয় সেই ভাষা তাদের রোজকার জীবনে কোন স্থানে রয়েছে, বিশ্বের দরবারে সে কতটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ বা তাদের স্বপ্ন আজ কতটা সফল, একুশের চেতনা আজ আমাদের মন কতটা ধরে রাখতে পেরেছে? এই প্রশ্নগুলো আজও এই দিনটিতে সামনে এসে পড়ে! বাংলাভাষার এ অবহেলার অবসান ঘটুক। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে এটাই আমাদের আকাক্সক্ষা।
রাজনীতিকদেরও বাংলা ভাষার ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সচেতন হবেন; আমাদেরকে অবশ্যই বর্তমান অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাকে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে দিতে হবে। আর এই হোক ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে আমাদের বিশেষ শপথ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।