বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মাহমুদ ইউসুফ : অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, নানা সঙ্কটে জর্জড়িত বিভিন্ন দেশ। এইসব সমস্যা, জটিলতার মূলে রয়েছে মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত, সংকীর্ণ চিন্তাধারা এবং সত্যপথ বিচ্যুতি। ভুলতথ্য, মিথ্যা ইতিহাস দ্বারা চালিত হচ্ছে জাতিরাষ্ট্র। সর্বত্রই ‘বঙ্কিমীয় ইতিহাসে’র ছড়াছড়ি। গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রই বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজের প্রধান উপজীব্য! অহির জ্ঞান, প্রভুর নির্দেশনা সেখানে গরহাজির, পুরোপুরি অনুপস্থিত। কল্পনার রাজ্যে অবগাহন করছে রাষ্ট্রের কর্ণধাররা। আর সত্যকে মিথ্যা বানাচ্ছে, মিথ্যা রূপান্তরিত হচ্ছে সত্যে। এ জন্যই সারা বিশ^ আজ বাইবেলীয়, কৃষ্ণীয়, মার্কসিয় উপত্যাকায়।
মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে হযরত নুহ নবি পর্যন্ত সকল মানুষ একই ভাষায় কথা বলত। পরবর্তীতে মানববংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন ভাষার পয়দা হয়। বাইবেলে উল্লেখ আছে, প্লাবনের পরে সমস্ত পৃথিবী এক ভাষাতে কথা বলত। সমস্ত মানুষ একই শব্দগুলি ব্যবহার করত। (বাইবেল, আদিপুস্তক ১১/১) এই সেই স্থান যেখানে প্রভু সমস্ত পৃথিবীর এক ভাষাকে অনেক ভাষাতে বিভক্ত করলেন। তাই এই স্থানটির নাম হলো বাবিল (বর্তমান ইরাক)। এইভাবে প্রভু তাঁদের সেই স্থান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিলেন। (বাইবেল, আদিপুস্তক-১১/৯) খ্রিস্টানদের স্বরচিত ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ভাষার ইতিহাসের ক্ষেত্রে সত্যের একটি দিক উন্মোচন করেছে। অথচ পুরো সত্য প্রকাশ করেনি। শ্লোক থেকে বুঝা যায় সেই প্রাচীনতম, সেই প্রথম ভাষার নাম বাইবেল রচয়িতরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে গেছেন।
তবে সত্যিকার ইতিহাস পর্যালোচনায়, প্রকৃত গবেষণায় এ সত্যটা বেরিয়ে এসেছে। আল্লামা জালালউদ্দিন আস সুয়ুতি বলেন, সর্বপ্রাচীন ও প্রথম ভাষা হলো আরবি। হযরত আদম আ.-কে জান্নাতে পরীক্ষার জন্য সর্বপ্রথম যে শব্দজ্ঞান ও ভাষা শেখানো হয়েছিল তা ছিল আরবি, এতে কোনো দ্বিমত নেই। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত জান্নাতে আদম আ.-এর ভাষা ছিল আরবি। কিন্তু ভুলবশত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর তিনি আরবি ভাষা ভুলে যান এবং তিনি সুরিয়ানি ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। অতঃপর যখন তার তাওবা কবুল হয় তখন তিনি পুনরায় আরবি ভাষায় কথা বলতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তিনি দুনিয়ায় আরবি ভাষায়ই কথা বলতেন। সকল আসমানি গ্রন্থ ও সহিফা আরবি ভাষায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আম্বিয়ায়ে কিরাম তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় তরজমা করে তাদেরকে সেই গ্রন্থের বাণী ও শিক্ষা পৌঁছান। আসমানি কিতাবসমূহের মধ্যে কেবল পবিত্র কুরআনই তার মূল ভাষা আরবিতে বহাল রয়েছে। (আল ইতফান ফি উলুমিল কুরআন. প্রথম খÐ, পৃ ১৩৬)
আবদুল মালিক ইবনে হাবিব (মৃত্যু ২২৮ হিজরি) এর বরাতে উল্লেখ আছে যে, সর্বপ্রথম আদম আ. যে ভাষা নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন সেটি ছিল আরবি। (আল বুলগা ফি উসুলিল লুগাহ, নওয়াব সিদ্দিক খান) হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল আযহারি র. (মৃত্যু ৩৭০ হিজরি) বলেন, মানুষ দুনিয়াতে আগমনের পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা আদম আ.-কে আরবি ভাষা শিক্ষা দানের মাধ্যমে এ ভাষার সূচনা করেন।’ আরবি ভাষা সবভাষার চেয়ে প্রাচীন ভাষা, এর বড় প্রমাণ হলো আল কুরআনের ভাষা আরবি। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৪, পৃ ১৭৪)
অতএব আরবিই প্রাচীনতম এবং দুনিয়ার প্রথম ভাষা। আরবি ভাষা থেকেই বর্তমান বিশে^র অপরাপর ভাষার উদ্ভব। বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান বলেন, ইউরোপের কোনো পাহাড়-পর্বত নয়; এশিয়ার আরব ভূমিই যে আদি আদম, আদি লিপি, আদি ভাষা ওগয়রহের পয়দা-স্থল, তা আধুনিক লিপিতত্ত¡বিদরাও কবুল করেছেন। ... কেবল ব্রাহ্মী লিপি ও বৈদিক ভাষা নয়; সংস্কৃত লিপি, বৈদিক ভাষা এবং আর্যত্ববাদী ব্রাহ্মণ জনকওমের প্রাচীন পুরুষ-মহিলারা যে, সেমিটিক (আরব) অঞ্চল এবং সেমিটিক (আরবীয়) জনকওমের-ই অন্তর্ভুক্ত- ইউরোপ আর ইউরোপিয়নদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং ছিল না- তা স্পষ্ট।
মোটের ওপর মানব জাতির আদি মানব-মানবী যেমন আরব ভূমিতেই আবির্ভূত হন; তেমনি আদি মানবগোষ্ঠী, ভাষা ও লিপিরও পয়দায়েশ এখানেই। সেই হেতু যে-ভাষাগোষ্ঠীকে ‘ইন্দো-ইউরোপীয় প্যারেন্ট স্পীচ’ বলা হয়ে থাকে; তা আসলে ‘সেমিটিক-প্যারেন্ট স্পীচ’ বা ‘সেমিটিক মূল ভাষা’ বলা উচিত। নির্দিষ্ট অর্থে এই ভাষাটি ‘আরবী’, আরবীয় বা আরব্য। আর এই ‘আরব্য’ শব্দটিকেই ম্যাক্সমুলার বানানোর বিকৃতি ঘটিয়ে করেছেন- ‘আর্য্য’।
অতএব, ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা বা ‘ইন্দো ইউরোপীয় প্যারেন্ট স্পীচ’- এর তরফে যত কথা, যত যুক্তি-ই দেয়া হোক না কেন; তা না- কবুল করার পক্ষে বহু যুক্তি আছে। (বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস দ্বিতীয় খÐ ,পৃ ৭৬-৭৭) তিনি আরও বলেন, আর্য্য শব্দটি যে, আকাশ থেকে পড়েনি, ‘আরব্য’ শব্দ থেকে তৈরী এবং তা প্রাচীন আরবীয় জনপ্রবাহের দেশান্তর, নৃতত্ত¡, ইতিহাস ও ভাষাতত্ত¡-ধ্বনিতত্তে¡র সাথে সংগতিপূর্ণ- তা পষ্ট। (ওই, পৃ ৭৬) অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ইউরোপ, ইউরোপিয়ান, আর্য্য, আর্য্যান এর উৎসও আরবি, আরব্য, আরবিয় থেকে। (ওই, পৃ ৭৩-৭৬)
বিশ^ রাজনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার দেউলিয়াত্ব ভাষার ইতিহাসের উপরও ভর করেছে। ভাষাবিজ্ঞানের সঠিক ইতিহাস নির্ণয়ে ভাষাবিদরা চরমভাবে ব্যর্থ। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক, অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক আল্লাহর মনোনীত পথকে এড়িয়ে মরীচিকার পেছনে ঘুরে ফিরছেন। সত্যকে বাদ দিয়ে কল্পনার মিশেলে রচনা করছেন ভাষার ইতিহাস। তাই তাদের চিন্তা চেতনা, ভাবনা দৃষ্টিভঙ্গি ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা পরিবারে গিয়ে থেমে যায়।
সা¤্রাজ্যবাদী চতুর চিন্তক ও ইউরোপীয় পÐিতদের উর্বর মস্তিষ্কের বিকৃত চিন্তাধারার ফসল হলো ইন্দো-ইউরোপীয় প্যারেন্ট স্পিচ। মূলধারার ভাষা পরিবার তথা সেমিটিক ভাষার বিরুদ্ধে একটি কাল্পনিক তত্ত¡ দাঁড় করানোই ছিল তাদের আসল এজেন্ডা। তাদের মনগড়া ভাষাতত্ত¡, লিপিতত্ত¡ই আধুনিক শিক্ষার বাহন হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাঠ করতে হচ্ছে প্রাচ্য-প্রতীচ্যে। এই কাল্পনিক, বানোয়াট ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে কবি গোলাম মোস্তফা বলেন, “১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের তদানীন্তন চিফ জাস্টিস এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এর প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়াম জোনস- সোসাইটির এক বাার্ষিক সভায় একটি মূল্যবান ভাষণ দান করেন। ওই ভাষণে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানি, পাহলবি, সংস্কৃত প্রভৃতি কতিপয় ভাষার অনেকগুলো শব্দ ও ধাতুরূপ বিশ্লেষণ করে দেখান যে, ওই সব ভাষার মূলে ঐক্য রয়েছে। তিনি তাই অনুমান করেন, ওই সব ভাষাভাষীজনেরা আদিতে একই স্থানে বাস করত এবং এক-ই ভাষায় কথা বলত। কালে কালে বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা নানা দেশে ছড়িয়ে পড়িতে বাধ্য হয়। এরূপেই বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হয়। এই ইংগিত পেয়ে জার্মান পÐিতদের মনে এক নতুন চিন্তার উদ্রেক হলো। তুলনামূলক ভাষাতত্তে¡র আলোচনায় তারা প্রবৃত্ত হলেন। ম্যাক্সমুলার, বপ, কোলাপ্রথ প্রভৃতি পÐিত এই বিষয়ে বহু গবেষণা করলেন। অতঃপর ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে স্যার থমাস ইয়ং নামক জনৈক মিসরীয় ভাষাবিদ পÐিত আলোচ্য ভাষাগুলোকে ‘ফ্যামিলি অব ইন্দো-ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলে অভিহিত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই সব ভাষাভাষী জনগণকে ইন্দো-ইউরোপিয়ান রেস নামে পরিচয় দেন। এরপরই ইন্দো-আর্য্য এবং আর্য্য নামের উৎপত্তি।” (উদ্ধৃতি: ওই, পৃ ৬১-৬২)
তথাকথিত প্রগতিবাদী ও সেক্যুলার ভাষা পÐিতদের মতে, প্রাগৈতিহাসিকালের মানুষদের কোনো ভাষা ছিলো না। তারা আকার ইঙ্গিতে, ইশারা সঙ্কেতে মনের ভাব বিনিময় করত। কিন্তু এটা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মানুষ পয়দা করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। ভাষাও পয়দা করেছেন আল্লাহ। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করবেন আর কথা বলতে শিখাবেন না। এটা হতে পারে না। বরং মানবসৃষ্টির আগেই ভাষা সৃষ্টি করেছেন তিনি। কারণ অহির কিতাবে থেকে আমরা আল্লাহ ও ফিরিশতাদের কথোপকথন লক্ষ করি। মহাকিতাব আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, “সেই সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার শুকনো মাটি দিয়ে ‘মানুষ’ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব পূর্ণভাবে তৈরি করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে” (সুরা হিজর ১৫/২৮-২৯)। তাছাড়া আল্লাহ প্রথম কলম পয়দা করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রসুল স. বলেছেন, “আল্লাহ্ তাআলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেন- লিখ। কলম বলল- হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ্ বললেন- কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী প্রত্যেক জিনিসের তাকদির লিখ।” অন্য বর্ণনায় এসেছে, কিয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে সব লেখ। (তাবারানি, ইবনু জারির, ইবনু আবি হাতিম, আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ, বায়হাকি এবং অন্যান্য) বিখ্যাত আলেম ইবনুল আরাবি বলেছেন- ‘কলমের পূর্বে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’ (আরেযাতুল আহওয়াযি) ভাষা না থাকলে কলম বা লেখার দরকারিতা বাতুলতা মাত্র।
আদম আ.-কে সৃষ্টির মাধ্যমে দুনিয়াতে মানব বসতি শুরু হয়। আল কুরআন ও বাইবেলে আদম হাওয়া সৃষ্টি, জান্নাতে তাদের অবস্থান এবং পৃথিবীতে প্রেরণ সম্পর্কে আল্লাহ, ফিরিশতা, আদম ও ইবলিসের মধ্যে কথাবার্তার বিভিন্ন রেকর্ড আমরা দেখতে পাই। সেখানে কোনো ইশারা, ইঙ্গিত, প্রতীক, সংকেত ছিল না। সে ভাষা অতি মাধুর্যপূর্ণ, গাম্ভীর্যপূর্ণ, ব্যাকরণসিদ্ধ ও পাÐিত্যপূর্ণ।
ঐতিহাসিক ড. এম. আবদুল কাদের বলেন, আদম আ. সর্বপ্রথম পয়গাম্বর। আল্লাহ তাঁর নিকট আসমানি প্রত্যাদেশসমূহ প্রেরণ করেন। ... আল্লাহ আদমকে কাবা নির্মাণের আদেশ দেন এবং জিবরাইল তাঁকে হাজ্জের আচার পদ্ধতি শিক্ষা দান করেন। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ^কোষ প্রথম খÐ, পৃ ১৫) আদম আ.-এর পর আল্লাহ ইদরিস, নুহ, হুদ, সালেহ, হুদ, ইবরাহিম, লুত, ইসহাক, ইসমাইল, ইয়াকুব, শুয়াইবসহ অগণিত নবি রসুল দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন বিপদগামী মানুষকে হেদায়েতের জন্য। ফিরিশতা, নবি, রসুলসহ বিভিন্ন যুগের মানুষেরা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। এটা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। তারা সবাই-ই মার্জিত ভাষায় কথা বলেছেন- ইহা মেনে নিতে আমরা বাধ্য। তাছাড়া নুহের কওম, লুতের কওম, আদ জাতি, ইরাম জাতি, নমরুদের জাতি, ফিরাউনের জাতি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট ভাষা ছিল।
আদম আ. মৃত্যুকালে শিষ আ. কে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। শিষ আ.-কে তিনি দিন ও রাতের সময় নিরূপণ পদ্ধতি শিক্ষা দেন। নুহ আ.-এর তুফানের খবর দিয়েছিলেন এবং দিনের প্রতি প্রহরান্তে নির্জনে বসে আল্লাহর ইবাদত করার হুকুম দিয়েছিলেন। ... তিনি মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত মক্কায় বসবাস এবং হাজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালন করতেন। আদম আ.ও স্বয়ং তাঁর নিকট অবতীর্ণ বাণীগুলো (৫০টি সহিফা) সংগ্রহ করেছিলেন এবং তদনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালনা করেন। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ^কোষ দ্বিতীয় খÐ, পৃ ৩৯৫-৩৯৬) অতএব সৃষ্টি সভ্যতার শুরু থেকেই ভাষা স্বমহিমায় বর্তমান। আর ভাষাটির নাম আরবি বা সামি।
আরবি বর্ণমালা সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, আরবি, ফিনিসিয়ান, হিব্রæ, আরমায়িক, সুরিয়ানি প্রভৃতি বর্ণমালা মূল সামি বা সেমিটিক বর্ণমালা হতে উদ্ভূত। পাশ্চাত্য লিপিবিদগণ অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন যে গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি প্রভৃতি ইউরোপীয় বর্ণমালার উৎপত্তিও সেই মূল সামি বর্ণমালা হতে। কেউ কেউ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, ভারতের ব্রাহ্মলিপিও এই সামি বর্ণমালা হতে উদ্ভূত হয়েছে। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ^কোষ প্রথম খÐ, পৃ ৭৪) এ-বিষয়ে, এ. সি. মুরহাউস ডৎরঃরহম অহফ ঞযব অষযধনবঃ গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-, ‘বস্তুত বর্ণমালা আছে মাত্র একটি-ই। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র তাই ছড়িয়েছে এবং বিভিন্ন ছদ্মরূপ ধারণ করলেও মূলে যে তাই এক-ই, তাও চাক্ষুষ দেখানো যায়। হিন্দুদের পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থ সব-ই লেখা দেবনাগরী লিপিতে; মুসলিমদের কোরান লেখা আরবি লিপিতে, ওল্ড টেস্টামেন্ট হিব্রুতে এবং নিউ টেস্টামেন্ট লেখা গ্রিকে। এই সমস্ত লিপি বস্তুত এক-ই মূল উৎস থেকে উদ্গত এবং তার-ই নানান রূপভেদ মাত্র। খৃ.পূ. দ্বিতীয় সহ¯্রাব্দের শেষ দিকে নিকট-প্রাচ্যে বিশেষত সিরিয়া ও প্যালেস্তাইনে ব্যবহৃত ঈষৎ-ভিন্ন এক গুচ্ছ সেমিটিক বর্ণমালা তাদের উৎসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।’ মি. মুরহাউস আরও বলেছেন- ‘সেমিটিক লিখনের আর-এক শাখা প্রাচীন ভারতের খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী বর্ণমালা।’
তবে লেখকের তৃতীয় বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় শেষ করতে গিয়ে বলেছেন- ‘এই অধ্যায় শেষ করার আগে আমরা সংক্ষেপে ইউরোপীয় লিপির উল্লেখ করব। দক্ষিণ সেমিটিক থেকে উদ্ভূত, সম্ভবত তা সাবা দেশীয় (সাবা আল কুরআন ও বাইবেলোক্ত রানি বিলকিসের দেশ)। এখানে স্বরবর্ণ-সমস্যা মেটানো হয়েছিল এই উপায়ে-সেমিটিক ব্যঞ্জন-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়, ব্যাঞ্জন যোগ ‘অ’ বোঝাতে; অন্যান্য স্বরবর্ণের জন্য বিশেষ মাত্রা যোগ করা হত- কিন্তু ডায়াক্রিটিক্যাল চিহ্নের মত পৃথক না থেকে তা স্থায়ীভাবে ব্যাঞ্জন-চিহ্নের সঙ্গে মিশে যায়।’ (উদ্ধৃতি: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস দ্বিতীয় খÐ ,পৃ ৭৬-৭৭)
শব্দাবলী ও সমার্থবোধক শব্দাবলীর দিক দিয়ে আরবি অভিধান সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। একটি বড় আরবি অভিধানে প্রায় ১ মিলিয়নেরও বেশি শব্দ থাকে। কেননা আরবি হল শব্দের ব্যুৎপত্তির ভাষা। যেমন ফরাসি শব্দের সংখ্যা ২৫ হাজার, ইংরেজি শব্দের সংখ্যা ১ লক্ষ আর আরবি মূল অক্ষর বা মাদ্দাহভিত্তিক শব্দের সংখ্যা ৪ লক্ষ। প্রসিদ্ধ আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরব’ গ্রন্থে ৮০ হাজার মাদ্দাহভিত্তিক শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলো হতে আরো অনেক শব্দ বের করা যাবে। (কওমী নিউজ, ৯ জানুয়ারি ২০১৬)
আরবি ভাষাতে সহজেই বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রয়োজনে নতুন নতুন শব্দ ও পরিভাষা তৈরি করা যায়। ইসলামের প্রচারকেরা ৭ম শতাব্দীতে আরব উপদ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে এক বিশাল আরব সাম্রাজ্য গড়তে বেরিয়ে পড়েন এবং প্রথমে দামেস্ক ও পরে বাগদাদে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। এসময় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এক বিশাল এলাকা জুড়ে আরবি প্রধান প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হত। ৯ম ও ১০ম শতকে বাগদাদে এক মহান বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন সম্পন্ন হয়। সেসময় বিশ্বের অপরাপর প্রাচীন ভাষা, বিশেষত গ্রিক ভাষার বহু প্রাচীন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক লেখা আরবিতে অনুবাদ করা হয়। এগুলোতে আবার আরবি চিন্তাবিদেরা নিজস্ব চিন্তা সংযোজন করেন। পরবর্তীতে আরব স্পেনে এই জ্ঞানচর্চাই ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে রেনেসাঁসের সূচনা করেছিল। আরবিই ছিল ১১শ শতকে মনুষ্য জ্ঞানভÐারের বাহক ভাষা এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচীন গ্রিক ও লাতিনের উত্তরসূরী। আরব সভ্যতা বলতে কেবল আরব জাতি বা ইসলামকে বোঝায় না; এই ভাষার মহিমা এই যে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মানুষকে এটি আকৃষ্ট করেছিল। বিস্তীর্ণ আরব সাম্রাজ্যের নানা জাতের মানুষ আরবি ভাষার ছায়ায় এক বৃহত্তর সমৃদ্ধিশীল আরব সভ্যতার অংশ হিসেবে একতাবদ্ধ হয়েছিল। ৮ম শতক থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত সংস্কৃতি, কূটনীতি, বিজ্ঞান ও দর্শনের সার্বজনীন ভাষা ছিল আরবি। ওই সময়ে যারা আরিস্টোটল পড়তে চাইত বা চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করতে চাইত বা গাণিতিক সমস্যার সমাধান খুঁজত বা যেকোন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় অংশ নিতে চাইত, তাদের জন্য আরবির জ্ঞান ছিল অপরিহার্য। (উকিপিডিয়া; ১২ ফেব্রæয়ারি ’১৭ ইং সংগৃহীত)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নবি করিম স. বলেছেন, তোমরা তিন কারণে আরবিকে ভালোবাস, কেননা আমি আরবি ভাষাভাষি, কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ এবং জান্নাতিদের ভাষা হবে আরবি। (শুয়াবুল ইমান, বায়হাকি, বুখারি) হযরত উমার রা. বলেন, তোমরা হাদিসের জ্ঞান অর্জন কর এবং আরবি ভাষার জ্ঞান হাসিল কর।’ অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তোমরা আরবি ভাষা শেখো কেননা, এটা তোমাদের দীনের অংশ। (ইবন আবি শায়বা)
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, গবেষক মোঃ আবু ইউসুফ বলেন, আরবি পৃথিবীর একটি পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী সর্বশ্রেষ্ঠভাষা। প্রাচীন ভাষা হিসেবে মানুষের শিক্ষার ভাষা আরবি হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আরবি ভাষার ন্যায় এত সমৃদ্ধশালী, মোহনীয়, সুমিষ্ট, চিত্তাকর্ষক ভাষা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এর প্রাঞ্জলতা, সাবললীতা, ভাবগাম্বীর্য, নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা সবকিছুই এ ভাষাকে পৃথিবীর অন্যসব ভাষা থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় দেদীপ্যমান করে রেখেছে। সুতরাং মর্যাদার দিক থেকে অন্যান্য ভাষার চেয়ে আরবি ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি। এমন মর্যাদাপূর্ণ ভাষার যথাযথ পরিচর্যা ও প্রয়োগ ছাড়া বিশ^ায়ন পরিকল্পনা অবান্তর। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৪, পৃ ১৭৪- ১৮১) তাই আরবি ভাষা, কুরআন হাদিসের ভাষা, অহির ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হওয়া আমাদের প্রধান ও মৌলিক কাজ। নৈতিক এবং দীনি দায়িত্বও বটে।
দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্তে¡ও এখানে আরবি শিক্ষা নেই বললেই চলে। স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে কোনো আরবি বা কুরআনিক শিক্ষা দেয়া হয় না। মাদ্রাসায় কোনমতে টিকে আছে আরবি ভাষা। অথচ এক সময় (১২০৫-১৭৫৭) আরবিই ছিল শিক্ষার প্রধান বাহন। সে আমলই বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। সেই স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে হলে আজ সর্বাগ্রে দরকার আরবি ও কুরআনিক শিক্ষার বাস্তবায়ন। তাহলেই গড়ে ওঠবে সোনার মানুষ। এই সোনার মানুষেরাই হবে দেশ গড়ার সত্যিকার কারিগর। সরকার বাহাদুর সেদিকে নজর দিবেন কী?
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।