Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী ইবাদাতের চতুর্থ রোকন : হজ

সত্যালোকের সন্ধানে

| প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হজের সংস্কারসমূহ :
হজের ফরজিয়ত বা অপরিহার্যতা অন্যান্য ইবাদাত হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র। সাধারণত : আরববাসীরা নামাজের সময় এবং আহকাম-আরকান ও বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ ছিল। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে এ বিষয়ে শিক্ষা দান করেন এবং পর্যায়ক্রমে উন্নতির দিকে প্রধাবিত করেন। জাকাত প্রথা পূর্ব থেকেই তাদের মাঝে চালু ছিল না। এ কারণে সাধারণ সদকাহ-খয়রাত হতে শুরু করে, জাকাতের ব্যবহারিক অপরিহার্যতা পর্যন্ত বিভিন্ন মনজিল অতিক্রম করতে হয়েছে। অনুরূপভাবে রোজা ও আশুরার দিন হতে শুরু করে মাহে রমজান পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকৃতি পরিবর্তন করেছে। কিন্তু হজ আরবদের একটি এমন সাধারণ পরিচয়-চিহ্ন ছিল, যার মাঝে এর সমুদয় নিয়ম-কানুন ও আহকাম-আরকান বিদ্যমান ছিল। ইসলামের আগমনে শুধুমাত্র এর স্থান এবং ব্যবহারিক পদ্ধতির পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। কিংবা এগুলোর মাঝে সে সকল অংশীবাদী রীতি-প্রথার প্রচলন হয়েছিল, ইসলাম সেগুলোর সংস্কার সাধন করে এর গর্হিত প্রক্রিয়াগুলো বিদূরীত করে বিধিবদ্ধভাবে হজে ফরজিয়তকে ঘোষণা করেছিল। সুতরাং এই সংস্কারসমূহ নিম্নে উপস্থাপিত করা হলো।
(এক) প্রতিটি ইবাদাতের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহপাকের জিকির করা, মাগফেরাত কামনা করা এবং আল্লাহপাকের কালিমাকে বুলন্দ করা। কিন্তু আরববাসীরা হজকে নিজেদের ব্যক্তিগত ও খান্দানী নাম এবং যশের উপায়-উপকরণরূপে স্থিরিকৃত করে ফেলেছিল। সুতরাং যখন তারা যাবতীয় হজের আরকানসমূহ আদায় করে ফেলতো তখন সকল গোত্র মিনাতে এসে অবস্থান করতো।
তাছাড়া অহমিকা ও অহংকার প্রকাশ করা ছিল আরব গোত্রগুলোর একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। তাদের জন্য এই সাধারণ সম্মেলন হতে উত্তম মাহফিল লাভ করার কোন সুযোগও ছিল না। এ কারণে প্রতিটি গোত্র আল্লাহর জিকির হতে গাফেল হয়ে নিজ নিজ গোত্র বা পিতামহ ও প্রপিতামহদের কর্মকাÐ এবং গুণাবলী বর্ণনায় ব্যস্ত হয়ে যেত। এ কারণে আল কোরআনে এই আয়াত নাজিল হয় : “তোমরা যেভাবে নিজেদের পিতা ও প্রপিতামহদের কথা স্মরণ করছো, তদনুরূপ বরং ততোধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করো।”
(সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
(দুই) আরবরা হজের সময় কুরবানী করতো, কিন্তু তারা এর রক্ত খানায়ে কা’বার দেয়ালে লাগিয়ে দিত এবং তারা মনে করতো যে, আল্লাহ নৈকট্য লাভ এতে সম্ভব হবে। ইহুদীদের মাঝেও এই প্রথা ছিল যে, তারা কুরবানীর রক্ত কুরবানগাহের সর্বত্র ছিটিয়ে দিত এবং কুরবানীর গোশতসমূহ জ্বালিয়ে দিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই উভয়বিধ গর্হিত কর্ম রহিত করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয় : ‘আল্লাহপাকের নিকট কুরবানীর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না বরং তার কাছে তোমাদের তাওয়া ও পরহেজগারী পৌঁছে।” (সূরা হজ : রুকু ৫)
আরও অগ্রসর হয়ে এ কথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, কুরবানীর উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিবদের জিয়াফতের ব্যবস্থা করা এবং ইব্রাহীম-ঐতিহ্যের প্রাক্কালে গরিবদের উদরপূর্তি আহার করার সুযোগ দান করা।
(তিন) ইয়েমেনের অধিবাসীদের দস্তুর ছিল যে, তারা হজের সফরে বেরুনোর সময় পথের সম্বল বলতে কিছুই সঙ্গে নিত না এবং তারা বলতো যে, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি। এর ফল এই দাঁড়াতো যে, যখন তারা মক্কায় এসে হাজির হতো, তখন ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হত। এ প্রসঙ্গে এ আয়াত নাজিল হয় : ‘তোমরা পথ খরচ সাথে নিয়ে চলো, কেননা উত্তম পথের সম্বল হচ্ছে পরহেজগারী।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫ এবং সহীহ বুখারী : ১খ: ২০৬ পৃ:, কিতাবুল হজ)
(চার) কুরাইশরা অন্যান্য আরব গোত্রের প্রতিক‚লে যে সকল পার্থক্যসুলভ বৈশিষ্ট্য কায়েম করেছিল, এর ফলশ্রæতিস্বরূপ একমাত্র কুরাইশ ছাড়া অন্যান্য আরব গোত্রের লোকেরা উলঙ্গ অবস্থায় খানায়ে কা’বা প্রদক্ষিণ করতো। এই উদ্দেশ্যে খানায়ে কা’বাতে একটি কাঠের মÐপ রাখা ছিল। যার উপর সকল মানুষ পরিধেয় বসন খুলে রেখে দিত। (তাবাকাতে ইবনে সায়াদ : তাজকেরায়ে সাইয়্যেদুস শোহাদা হযরত হামজাহ রা.)। এ সকল লোকের গাত্রাবরণ কেবলমাত্র কুরাইশদের বদান্যতার উপর নির্ভরশীল ছিল। এক্ষেত্রে কুরাইশদের তরফ হতে আল্লাহর মহব্বতে কাপড় বিতরণ করা হতো। পুরুষ মানুষ পুরুষদেরকে এবং মহিলারা মহিলাদেরকে নির্দিষ্টভাবে তাওয়াফের কাপড় ধার দিত এবং মানুষ এই কাপড় পরেই তাওয়াফ করতো। কিন্তু যে সকল লোক এই বদান্যতার আওতাভুক্ত হতে পারতো না তারা উলঙ্গ অবস্থায়ই তাওয়াফ করতে বাধ্য হত। কিন্তু ইসলাম এই জগণ্য লজ্জাহীনতামূলক কর্মকাÐকে সমূলে উৎপাটিত করে দেয়। (সহীহ বুখারী : ১ খ:, ২২৬ পৃ:, কিতাবুল হজ) এরই প্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয় : “তোমরা প্রত্যেক মসজিদ বা ইবাদাতের সময় লেবাস পরিধান কর।” (সূরা আ’রাফ : রুকু-৩) তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরি নবম সালের হজের মৌসুমে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-কে এই ঘোষণা দানের জন্য প্রেরণ করেন যে, আগামীতে কেউ যেন উলঙ্গ হয়ে খানায়ে কা’বা তাওয়াফ করতে না পারে। সুতরাং তিনি এই ঘোষণা প্রদান করলেন এবং এই নিন্দনীয় প্রথার বিলুপ্তি সাধিত হয়। (সহীহ বুখারী : কিতাবুল হজ)
(পাঁচ) কুরাইশদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, হজের সময় সকল গোত্রের লোকেরা আরাফাতে অবস্থান করতো। কিন্তু স্বয়ং কুরাইশরা হেরেমের সীমা রেখার ভেতর থেকে বাইরে বেরোনোকে নিজেদের মর্যাদার খেলাফ বলে মনে করতো। এ জন্য তারা মুজদালিফায় অবস্থান করতো। ইসলাম কুরাইশদের এই বিভেদমূলক নীতির মূলোচ্ছেদ সাধন করেছে। (সহীহ বুখারী) : কিতাবুল হজ-ই ১ম খ:, ২২৬ পৃ:) এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয় : “তারপর তোমরা ঐ স্থান হতে প্রস্থান কর যেখান হতে অন্যান্য লোকেরা প্রন্থান করে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৪)
(ছয়) সাফা এবং মারওয়ার মধ্যবর্তী যে ব্যবধান সেখানে আরবরা দ্রæত দৌড়াতো এবং এই কাজটিকে মাজহাবী সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু ইসলাম এ কাজকে তাদের অনুসৃত সুন্নাত হিসেবে গ্রহণ করেনি। (সহীহ বুখারী : ১ম খ:, ৫৪৩ পৃ:) বরং মধ্যমপন্থাকে গ্রহণ করেছে এবং দ্রæত দৌড়ানোকে বিশেষত্ব দেয়নি।
(সাত) জাহেলিয়াত আমলে হজের বৈশিষ্ট্য কেবল এত কিছুই ছিল একটি বৃহত্তর মেলার প্রতিরূপ। যেখানে সকল শ্রেণির জুয়াড়িদের আড্ডা বসতো। এখানে জমে উঠতো সোরগোল এবং কাব্য চর্চার মাধ্যমে খুন-খারাবি। এরই সাথে মহিলাদেরকে পণ্যের মতো ব্যবহার করা হতো। মোটকথা, অবিচার ও অনাচার চলত সর্বত্র। কিন্তু ইসলাম আগমন করেই এ সবের মূলোচ্ছেদ করে এবং হজকে পবিত্রতা, আত্মনিবেদন, পুণ্যধর্মী কর্মকাÐ ও জিকরে ইলাহীর প্রকৃষ্ট উদাহরণরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। একই সাথে আল কুরআনে ঘোষণা করা হয় : “সুতরাং যে এই মাসগুলোতে হজের নিয়ত করবে, তাহলে তার উচিত মহিলাদের প্রতি শ্লীলতাহানিকর কর্মকাÐ না করা, গালি-গালাজ না করা, ঝগড়া-বিবাদ না করা, তবে তোমরা যেসব অদনুষ্ঠান করবে, সে সম্পর্কে আল্লাহপাক সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
(আট) হজের বিধিবিধান আদায় করার পর যারা প্রত্যাবর্তন করতে মনস্থ করত, তারা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের একদল বলত যে, যারা ‘আইয়্যামে তাশরী’কে প্রত্যাবর্তন করে তারা গোনাহগার। অপর দল যারা দেরিতে প্রত্যাবর্তন করে তাদেরকে দোষারোপ করত। অথচ এই উভয় শ্রেণীর কেহই গোনাহগার ছিল না। এ জন্য আল কোরআন উভয় শ্রেণীর কাজকেই বৈধ বলে ঘোষণা করেছে। ইরশাদ হচ্ছে : “যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করে আইয়্যামে তাশরীকের দুই দিনের মাঝেই প্রত্যাবর্তন করে তাহলে এতে তার গোনাহ হবে না এবং যে দেরিতে প্রত্যাবর্তন করবে, তারও কোনো গোনাহ হবে না, তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
(নয়) আরবরা হজকে একটি নিঃশব্দ অনুষ্ঠানে পর্যবসিত করে তুলেছিল। অর্থাৎ তারা হজের ইহরাম বাঁধার পর নিশ্চুপ হয়ে যেত। তাই হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) একজন মহিলাকে নিশ্চুপ দেখে এর কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, সে নিশ্চুপ হজের ইহরাম বেঁধেছে। তিনি তাকে নিঃশব্দ থাকতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, এটা হচ্ছে অন্ধকার যুগের কুসংস্কার।
(সহীহ বুখারী, ১ম খ., ৫৪১ পৃ.)
আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় হজের সংস্কারসমূহ সম্পর্কে পর্যালোচনা করেছি। এর সাথে আরও কিছু সংস্কারের কথা উপস্থাপন না করলে অধিত বিষয়টির পূর্ণতা লাভ হয় না। তাই বক্ষ্যমান নিবন্ধে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলাম।
(দশ) আরবরা খানায়ে কা’বা পর্যন্ত পদব্রজে গমন করার জন্য মানত করত এবং তারা এ কাজকে বড়ই পুণ্যের বলে মনে করত। একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন বৃদ্ধকে দেখলেন, দুটি ছেলের ওপর ভর করে পদব্রজে হজে গমন করছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ কি? উত্তরে জানানো হলো যে, লোকটি পদব্রজে গমন করার জন্য মানত করেছে। ইরশাদ হলো, আল্লাহ কাহারো নফসকে আজাবে নিপতিত করা থেকে বেনিয়াজ। সুতরাং তিনি তাকে সওয়ারীর ওপর আরোহণ করে গমন করার নির্দেশ দিলেন। (জামে তিরমিজী : কিতাবুন নুজুরী ওয়াল আইমান)
অনুরূপভাবে মহিলারাও খানায়ে কা’বা পর্যন্ত খোলা মাথায় পদব্রজে গমন করার জন্য মানত করত। একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এই শ্রেণীর একজন মহিলাকে দেখতে পেলেন এবং বললেন, আল্লাহ এই পেরেশানী হালের জন্য কোনো বিনিময়ই প্রদান করবেন না। সুতরাং এই মহিলার উচিত সাওয়ারীর ওপর আরোহণ করা এবং উড়নী বা চাদর দ্বারা মাথা আবৃত করা।
(জামে তিরমিজী : কিতাবুন নুজুরী ওয়াল আইমান)
একই ধারণার বশে তারা কোরবানির জন্য যে সকল পশু গৃহ হতে আনয়ন করত, সেগুলোর ওপর আরোহণ করত না। কোরবানির পশু হিসেবে সেগুলোকে অন্যরকম মনে করত। সুতরাং একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) দেখতে পেলেন যে, একটি লোক উটের রশি ধারণ করে পায়ে হেঁটে চলেছে। তিনি বললেন, উটের ওপর আরোহণ কর। লোকটি উত্তর করল, এ হচ্ছে কোরবানির পশু (তাই আরোহণ করতে পারছি না)। একইভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) তিনবার তাকে উটের ওপর আরোহণ করতে বললেন। (সহীহ বুখারী : ১ম খ., ২২৯ পৃ., কিতাবুল হজ)
(এগার) আনসারদের মাঝে এই দস্তুর ছিল যে, তারা হজ হতে প্রত্যাবর্তনের পর দ্বারপথে গৃহে প্রবেশ করতেন না; বরং পেছনের দেয়াল টপকে গৃহে প্রবেশ করতেন এবং এ কাজকে পুণ্যময় বলে মনে করতেন। সুতরাং এক ব্যক্তি হজ হতে প্রত্যাবর্তন করে প্রচলিত নিয়মের খেলাপ দ্বারপথে গৃহে প্রবেশ করলেন। ফলে, অন্যান্য লোকেরা তাকে খুবই ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করল। সঙ্গে সঙ্গে আল কোরআনের এই আয়াত নাজিল হয়। ইরশাদ হচ্ছে : “গৃহের পেছনের দেয়াল ডিঙিয়ে প্রবেশ করার মাঝে কোনোই পুণ্য নেই; বরং পুণ্য হচ্ছে ওই ব্যক্তিরই প্রাপ্য যে তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করেছে এবং তোমরা গৃহসমূহে দ্বারপথে প্রবেশ কর।”
(সূরা বাকারাহ : রুকু-২৪ এবং সহীহ বুখারী : ১ম খ., ২৪২ পৃ.)
(বার) কোন কোন লোক তাওয়াফ করার সময় নিজেদের অপরাধী ও গোনাহগার হওয়ার অবস্থাকে বিভিন্ন অনুপযোগী পন্থায় প্রকাশ করত। এদের কেউ নাকের সাথে রশি ঝুলিয়ে রাখত এবং এই রশি ধরে অপর একজন তাকে টেনে বেড়াত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, তাকে রশি ধরে তাওয়াফ করানো হচ্ছে। তিনি তার নাকের রশি কেটে দিলেন। (নাসাঈ, কিতাবুল হজ, ৪৬১ পৃ. আল-কালামু ফিত্্ তাওয়াফ পরিচ্ছেদ)
আরও একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, সে নিজের হাত অপর এক লোকের সাথে বেঁধে রেখেছে এবং সেই ব্যক্তি তাকে তাওয়াফ করাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার রশি কেটে দিলেন এবং বললেন, এর হাত ধরে তাওয়াফ করাও। (সহীহ বুখারী : কিতাবুল হজ; আল কালাম ফিত্্ তাওয়াফ পরিচ্ছেদ)
একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) দেখলেন যে, দুজন লোক একই রশিতে আবদ্ধ হয়ে তাওয়াফ করছে। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, আমরা উভয়ে এই মানত করেছি যে, এভাবে রশিতে আবদ্ধ হয়ে খানায়ে কা’বাকে তাওয়াফ করব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “এই কুসংস্কারকে দূর করে দাও। এটা বৈধ মানত নয়; বরং বৈধ মানত হচ্ছে এটি যার উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।” (ফতহুল বারী : ৩য় খ., ২৮৬ পৃ.)
(তের) আরবের অধিবাসীরা হজের জন্য নির্ধারিত দিনগুলোতে ‘ওমরাহ’ আদায় করত না। তারা বলত, যখন সাওয়ারীগুলো হজ হতে প্রত্যাবর্তন করবে এবং তাদের পিঠের জখম শুকিয়ে যাবে তখন হয়তো ‘ওমরাহ’ আদায় করা যেতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) খাস হজের দিনগুলোতেই ওমরাহ আদায় করেছেন এবং কার্যত এই শ্রেণীর অপ্রয়োজনীয় রুসম ও রেওয়াজকে নির্মূল করে দিয়েছেন।
(সহীহ বুখারী : আইয়্যামুল জাহিলিয়্যা পরিচ্ছেদ)
(চৌদ্দ) অন্ধকার যুগে কোনো কোনো লোক হজের নিয়ত করত। কিন্তু তারা এ সময়ে তেজারত বা ব্যবসা-বাণিজ্য করত না এবং তেজারতকে হজের মূল কর্মকাÐের বিপরীত বলে মনে করত। এ জন্য অধিকাংশ লোক, যারা শুধু তেজারত ও ব্যবসা- বাণিজ্যের জন্য আগমন করত, তারা হজে অংশগ্রহণ করত না; বরং তারা একটি মেলা অনুষ্ঠানের মতোই হাজির হতো। এদের সাথে হজের কোনো সম্পর্কই ছিল না। তারা ‘ওকাজ’ অথবা ‘জুল্্-মাজাজ’ নামক মেলায় অংশগ্রহণের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য করত। ইসলাম আগমনের সময় এই দুটি পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল। এর কুফল ছিল এই যে, হাজী ব্যক্তি তেজারতের মুনাফা হতে বঞ্চিত থাকত। তাছাড়া হাজীদের ছাড়া যে ভিড় জমত, তা ছিল বাজারী ও তামাশাকারীদের আসর মাত্র। এগুলোতে সকল প্রকার পাপের কাজ অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু পবিত্র ইসলাম এই পৃথককরণ ব্যবস্থাকে দূরীভূত করে দিয়েছে এবং সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, তেজারত ও ব্যবসা-বাণিজ্য হজের পবিত্রতা ও মর্যাদার খেলাপ নয়। এ কারণে হজ এবং তেজারত উভয় কর্মই এক সাথে আদায় করা যায়। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে : “তোমাদের জন্য এটা গোনাহের কাজ নয় যে, (হজের মৌসুমে) আল্লাহর অনুকম্পা (তেজারত) অসন্ধান করবে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫) ফলে, এ পরিণাম এই দাঁড়াল যে, সকল লোক যারা মক্কায় সমবেত হতো, তারা হজের নিয়তেই জড়ো হতো। এর দরুন অন্ধকার যুগের ক্ষতিকর কুসংস্কারসমূহ দূরীভূত হয়ে যায় এবং একই সাথে সামগ্রিকভাবে বৈধ তেজারতের পথ সুগম হয়ে ওঠে। উপরোক্ত আয়াতের শানে নুজুল সম্পর্কে দুই ধরনের রেওয়ায়েত পাওয়া যায়। কোনো কোনো রেওয়ায়েত হতে জানা যায় যে, আরবরা হজ আদায় করার সময় তেজারত করাকে খারাপ জানত। এ জন্য এই আয়াত নাজিল হয়। অপর বর্ণনাগুলো থেকে জানা যায় যে, আরবরা এ সময় তেজারত করত। ইসলাম আগমন করার পর সাহাবিগণ মনে করলেন যে, হজ হচ্ছে খালেসভাবে আল্লাহর জন্য। এ জন্য এ সময়ে হেজারত করা সমীচীন হবে না।
সুতরাং তাদের এই খেয়াল নির্মূল করার জন্য এই আয়াত নাজিল হয়। (তাফসীরে তাবারী ও আসবাবুন্্ নুজুল : ওয়াহেদী)
(পনের) সাফা মারওয়ার তাওয়াফ সম্পর্কে দুদলের উদ্ভব ঘটেছিল। আনসারগণ শুধু মানাতের ইহরাম বাঁধত, যা ‘মুসল্লাল’ নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। তারা খানায়ে কাবাকে তাওয়াফ করত না। তাদের ছাড়া অন্য আরবরা সাফা এবং মারওয়ার তাওয়াফ করত। আল্লাহপাক যখন সর্বপ্রথম খানায়ে কাবা তাওয়াফের হুকুম দিলেন, কিন্তু তখনো সাফা এবং মারওয়ার তাওয়াফ সম্পর্কে কোনো নির্দেশ নাজিল হয়নি। তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করল যে, এটি কি কোনো নাযায়েজ কাজ? আনসারগণও এ ব্যাপারে রাসূলূল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন, তখন এই আয়াত নাজিল হয়। (সহীহ বুখারী : কিতাবুল হজ্জ, ১ম খ., ২২৩ পৃ.) “অবশ্যই সাফা এবং মারওয়া (পাহাড়দ্বয়) হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহর হজ আদায় করবে অথবা ওমরা পালন করবে, তাদের জন্য সাফা-মারওয়া তাওয়াফ করাতে কোনো গোনাহ হবে না।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৯)। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ