বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ : বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটে উত্থান ও পতন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ঘটেছিল। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০১৪ এই দুই টার্মে পুঁজিবাজারের ইতিহাসে বিশেষ করে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল তাকে এক কথায় বলা যায়Ñ দুর্নীতির উন্নয়নে পুঁজিবাজার ছিল সবার শীর্ষে। ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারের উত্থান যেভাবে ঘটেছিল, সেই একই প্রক্রিয়ায় খেলোয়াড়রা ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব ঘটিয়ে প্রায় ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর প্রায় এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল। এই লুটপাট শুরুর আগে কুচক্রীরা পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ছিল কার্ব মার্কেটে শেয়ার সার্টিফিকেটের কাগজের ওপর সই দিয়ে এই রমরমা ব্যবসা হোটেলে বসে চালিয়েছিল প্রভাবশালী শেয়ার জুয়াড়িরা ছাত্রদের মাধ্যমে। তখন এ কথাও পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে, ভারত থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ী এসে বাংলাদেশের সস্তা বিনিয়োগে শত কোটি টাকা আয়ে যোগ দিয়েছিল। ২০১০ সালের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জরুরিভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ উক্ত তদন্ত কমিটির নির্বাহী প্রধান ছিলেন। তিনি দোষী ব্যক্তিদের নাম-পরিচয়সহ একটি দালিলিক রিপোর্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু জড়িত ব্যক্তিরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ার কারণে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে বাধাগ্রস্ত হয়।
বর্তমানে বাজারে যে শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে, এখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। জুয়াড়িরা প্রস্তুত এবং তারা স্ব-স্ব কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা মালিক পক্ষ। পুঁজিবাজার এখন পুরোপুরি সিন্ডিকেটের আওতায় চলে গেছে। এই সিন্ডিকেটই পুঁজিবাজার থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে নিয়ে যায়। বাজারটাকে ঊর্ধ্বগতি তারা নিজেরাই করে, যাতে সহজ-সরল বিনিয়োগকারীরা ব্রোকার হাউসে এসে শেয়ার কেনাবেচা শুরু করে। এটা একটা ভয়ঙ্কর নেশাও বটে। অনেকটা জুয়া খেলার মতো। কিন্তু পুঁজিবাজার হতে হবে স্থিতিশীল, বাজার ওঠানামার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকবে। এক লাফে প্রতি শেয়ারের মূল্য এক সপ্তাহে দশ টাকা বৃদ্ধি পাওয়া তাও আবার নি¤œমান বা ‘জেড’ গ্রুপ কোম্পানির শেয়ার। সন্দেহটা শুরু হয় এখান থেকেই।
আমি শেয়ারবাজার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি- স্বল্পপুঁজির বা হুজুগে উন্মত্ত হয়ে জমিজমা, গরু-ছাগল, ভিটেমাটি বিক্রি করে পুঁজিবাজারে ব্রোকার হাউসে অর্থবিনিয়োগ করে। তারা আসলে বোকা বা মূর্খ। অর্থ পাগল এসব লোকের লাভের কথা বাদ দিলাম, আসল টাকা পেতেও পাঁচ থেকে দশ বছর সময় লেগে যায়। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের ধাক্কা ২০১৭-তে এসেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ৩৪ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর এই বাজারে এসে লোকসান গুনতে হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে কয়েক জন মানুষ। পুলিশের গুলি ও বেনয়টের খোঁচায় আহত হয়েছে অনেকেই।
পুঁজিবাজারে সেকেন্ডারি ব্যবসা করতে চাইলে স্ব-বুদ্ধিতে ঠা-া মাথায় কোম্পানির প্রোফাইল নি¤œতম দশ বছর দেখে, তারপর ভালো-মন্দ বিচার করে ৫টি কোম্পানিকে সিলেক্ট করে শেয়ার কেনাবেচা করলে লাভের অংক কম হলেও লোকসানের খাতায় নাম লেখাতে হবে না। আজকাল অনলাইন পদ্ধতিতে সব কোম্পানির এজিএমের পুরোচিত্রটা দেখা খুবই সহজ। যেমন ধরুন একটি কোম্পানি ১০ বছর ধরে ভালো মুনাফা করছে। পার শেয়ার আর্নিং প্রোফিটও ভালো। বছর শেষে ক্যাশ ও বোনাস শেয়ারে লভ্যাংশ হারও ভালো। দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে এসব কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করলে ক্ষতির আশঙ্কা একেবারেই থাকে না। বর্তমানে যেখানে ব্যাংকে আমানতের সুদ ৪ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও ধীরে ধীরে কমছে। সেই হিসেবে ভালো কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করলে বছরান্তে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের চেয়ে দ্বিগুণ আয় করা সম্ভব। দালালদের খপ্পরে না পড়ে, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতি শনিবার তোপখানা রোডে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটে (বিআইসিএম) কোর্স করে বিষয়গুলো হাতেকলমে শিখতে ও জানতে চেষ্টা করুন। আমি নিজে এ ধরনের ক্লাস বা কোর্স এটেন্ড করে মোটামুটি একটি ধারণা অর্জন করেছি। এ কারণে অতি বেকারত্বের এ দেশে টাকা যাতে নষ্ট না হয় সে লক্ষ্যে প্রথমে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথম শ্রেণির কোম্পানির প্রোফাইল ঘেঁটে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করুন। লাভ নিশ্চয়ই হবে। বড় বড় কোম্পানির কিছু জুয়াড়ি পুঁজিবাজারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে নিজেদের স্বার্থে। এখন আর শেয়ারহোল্ডারদের উপস্থিতিতে বাৎসরিক সাধারণ সভা (এজিএম) হয় না। এ ব্যবস্থা কোম্পানির মালিক পক্ষ স্থগিত করেছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথা বলার স্থানটিও এখন রহিত হয়ে গেল। স্বীয় স্বার্থে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা ঢাকা ও চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জে ও বিএসইসি কর্তৃপক্ষবৃন্দ পুঁজিবাজার নিয়ে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে ৫ দিনের সর্ববৃহৎ মেলার আয়োজন করেছিল বিগত বছরের শেষ দিকে। বর্তমানে কিছু ব্রোকার হাউজও লোকসানের মধ্যে আছে। তারাও উৎসাহী হয়ে এসব আয়োজনের বড় উদ্যোক্তা সেজেছে। কিন্তু একটি কথা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। না জেনে না শুনে আবেগের বশবর্তী হয়ে অন্যের কথা শুনে পুঁজিবাজারে আর বিনিয়োগ করবেন না। প্রয়োজনে বিষয়টির ওপর প্রশিক্ষণ নেবেন। বাজারে যখন তেজিভাব থাকে তখন হঠাৎ করে বিনিয়োগ করবেন না। ২০১০ সালে উত্থান পর্বটা ছিল মাত্র ৬/৭ মাস। তারপর পতনের ধারা শুরু হয়। এই সময়েই ৩৪ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা লোকশানের মুখে পড়ে যায়।
শেয়ারবাজারে পুঁজিদস্যুদের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেছেনÑ ব্যাংকে আমানতের সুদের হার একেবারেই তলানিতে, সঞ্চয়পত্রের অবস্থা বেগতিক। তাই কিছু মানুষ পুনরায় বাড়তি মুনাফার প্রত্যাশায় শেয়ারবাজারে ঝুঁকছেন। পুরনো খেলোয়াড়রা আগের স্টাইলেই সেটিকে কাজে লাগিয়ে আবার খেলবেন। এই জুয়াড়ি সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে আবার কত মানুষ যে নিস্ব হয় সেটা দেখার জন্য চলতি বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ডিএসই সূচকের ৪ বছরের অস্থানটির দিকে লক্ষ্য করুন তাহলেই বুঝবেনÑ কীভাবে কলকাঠি নাড়ছে গেমলাররা। ১৯ জানুয়ারি ২০১৪, ডিএসই সূচক ছিল ৪৫৬৫, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫ সূচক দাঁড়ায় ৪৯১৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ সূচক হলো ৪৬৮৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭ সূচক দাঁড়ায় ৫৫৩৩, ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর অর্থাৎ ৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সূচক ছিল ১৭ জানুয়ারি ২০১৭ সালে। ওইদিন ধারাবাহিক উত্থানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক সাড়ে পাঁচ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করেছে এবং টাকার অঙ্কে মোট লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৬৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ২০১১ সালের শুরু থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে শেয়ারবাজার চরমভাবে ধসে আক্রান্ত ছিল। ২০১৫ সালের শুরু থেকে বাড়তে থাকে সূচক ও লেনদেন। কিন্তু ২০১৭ সালে গিয়ে জানুয়ারি মাসে সূচক ও লেনদেনের অংক বেড়ে যায় অস্বাভাবিক গতিতে। পুঁজিবাজারে সূচক ও মূলধন বাড়বে কিন্তু তা যদি হয় অস্বাভাবিক গতিতে তখনই সন্দেহের মাত্রা বেড়ে যায়। এ টাকা কোনোভাবেই সুস্থধারার পুঁজিবাজার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
৮ জানুয়ারি ২০১৭ বিএসইসির দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেছেন, আর ভুল করবেন না। আপনারা বহু ভুল করেছেন। নিজেরা ভুল করবেন মানুষের কান কথা শুনে, গুজবে কোনো কাজ করলে তার দায় বিনিয়োগকারীকেই নিতে হবে। তিনি এও বলেছেন, যেখানে সেখানে একটা বিনিয়োগ করে সব হারিয়ে শেষে বলে সব দোষ সরকারের, সব দোষ অর্থমন্ত্রীরÑ এ রকম অবস্থার সৃষ্টি যেন আর না হয়। তবে এটা লক্ষ করেছি, সব সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি পুঁজিবাজারে অলস টাকা বিনিয়োগ করে স্বল্প সময়ে শিল্পপতি হওয়া যায়। ব্যাংকে অলস পুঁজি আপনাকে কখনো বড়লোক বানাতে পারবে না। আমরা দেখেছি, দীর্ঘ ১০ বছর পুঁজিবাজারকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউস মালিক বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ বাজার নিয়ে বহু আশার বাণী শুনিয়েছেন। এখনো শুনাচ্ছেন। প্রতিদিনের কাগজ খুললেই তাদের স্তবকবাণীগুলো দেখতে পাই। কিন্তু পুঁজিবাজার এই ভালো এই খারাপ-এর কারণ কী তা জেনেও তারা বলেন না। নিশ্চয়ই কোথাও গোলমাল আছে। যারা পুঁজিবাজার নিয়ে অতি উৎসাহ ব্যাঞ্জক কথা বলেন, লাভের একটি অংশ তাদের পকেটেও হয়তো যায়। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দায়িত্বে যারা থাকেন, পুঁজিবাজার নষ্ট হওয়ার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। দেশে বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থ হলে আমরা যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দায়ী করি, ঠিক তেমনি যার যে দায়িত্ব সেটা সে যথানিয়মে পালনে ব্যর্থ হলে সে দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তথ্য বিবরণী দেখে হতাশায় ভুগতে হয়, কারণ- ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ঢাকার বাজারে প্রতিদিন গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪৯৯, ৪২১ ও ৪৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালে জানুয়ারির প্রথম ১৪ দিনে গড় লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০০ কোটি টাকায়। হঠাৎ করে ১৪ দিনে পূর্বের ৪ বছরের তুলনায় বড় মূল্য প্রতিদিন তিনগুণ বাড়ার নেপথ্য কারণ জানা দরকার। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বলব, সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেনের সময় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা জরুরি। বাজারে চলমান ঊর্ধ্বগতিতে আমরা লক্ষ করছি দুর্বল মৌলভিত্তির ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত কিছু কোম্পানির শেয়ারের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ ধরনের বাজে কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়লেও একপর্যায়ে দরপতন ঘটবে। ঋণ করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ না করাই উত্তম। সঞ্চিত অর্থ থাকলে বুঝেশুনে যেটা আমি নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি, সেভাবে বিনিয়োগ করলে লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে না। সবার শেষে বলব, ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল কারচুপি থেকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।