বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন : রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে আবারও মূর্তি স্থাপনের টনটনে গরজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা উৎসে ফেরার শাণিত চেতনাজাত না বিদেশি ‘চাপ’ জনিত তা জানা না গেলেও অনুধাবনীয় নয়। প্রাচীন গ্রিক রূপকথার কল্প দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হলো জাতীয় ঈদগাহের কোল ঘেঁষে। মুসল্লি সমাগম বেশি হলে অনেক সময় জামাত ছাপিয়ে যাওয়ার কারণ হয় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেও। মসজিদ ও ঈদগাহ মূলত একই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত দুটি ধর্মীয় স্থান। নামাজ আন্তেÍ মুসল্লিগণ (যাদের মধ্যে প্রেসিডেন্টও থাকেন) ডান দিকে সালাম ফেরাতে গিয়ে এক নারী মূর্তি দেখতে পাবেন। অতঃপর চোখের সামনে পূর্ণ যৌবনা নারী মূর্তি দর্শনে সচেতন মুসল্লিগণের পক্ষে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলার পরিবর্তে ‘নাউজুবিল্লাহ মিন জালেক’ বলা ছাড়া উপায় থাকবে কী? কোনো অবিবেচক কসাই মন্দিরের পাশে গরুর গোস্তের দোকান বসাতে চাইলে আমরা তাকে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন বিবেচনা না করে পারি না। প্রশাসন, আইন-আদালত সঙ্গতভাবেই হেন প্রচেষ্টা প্রতিরোধে এগিয়ে আসবেন, অথচ এবেলা তারা নীরব নয় শুধু বরং সক্রিয় সহযোগী।
মসজিদ আর ঈদগাহে পার্থক্যটা কী? যে বিবেচনায় মসজিদের পাশে মদের দোকান বা সিনেমা হলের মতো ব্যবসা করা যায় না বা করতে দেওয়া হয় না, সেই একই বিবেচনা এবেলা প্রযোজ্য নয় কেন? অবাক হওয়ার বিষয় এমন একটি আগ্রাসন চাপিয়ে দেওয়া হলো কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা আর প্রগতির নামেই। এটি আদালতের মহত্ত ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মানুভূতি ও চেতনায় আঘাত লাগার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।
এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান এটাই যেন তাদের বড় দুর্ভাগ্য। যার সূচনা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই। প্রগতি-ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি শব্দগুলো তাদের বিরুদ্ধে শাঁখের করাতের মতোই ব্যবহৃত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই যেমনÑ যদি বলা হতো ‘আদালতের পবিত্র দায়িত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিবেচনায় কোরআন পাকের কোনো নির্দেশনা সুপ্রিম কোর্টসহ আদালতসমূহের সামনে উৎকীর্ণ করা হোক’। তক্ষুনি কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই তুলে বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে যাবেন, অন্যদিকে তারাই আবার দেবীর প্রতিকৃতি স্থাপনের পক্ষে দাঁড়াবেন ধর্মনিরপেক্ষতার নামেই। তা হলে ইসলামী চেতনার বিরোধিতার নামই কী ধর্ম নিরপেক্ষতা?
সাম্প্রদায়িক ও সাম্প্রদায়িকতা শব্দগুলো আজকাল মুখে মুখে। ক্ষুরধার অস্ত্রের মতো এই শব্দগুলোর শিকার সদা যে কেবল সংখ্যালঘুরাই তা কিন্তু নয়, বরং সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকেও একই পরিস্থিতির শিকার হতে দেখা যায় কোনো কোনো সমাজে। তবে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যখন এমন পরিস্থিতির শিকার হয় তখন তা হয় দুরারোগ্য ব্যাধির মতো যন্ত্রণাদায়ক, আর দাবানলের মতোই সর্বগ্রাসী। কারণ সংখ্যাগুরুদের জন্য সচরাচর কাঁদারও কেউ থাকে না। কারণ তারা সে সংখ্যাগুরু! আর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যহীনতায় প্রতিবাদ তো দূরের কথা কদাচ মুখ খুলে তা বলাও যায় না। নির্যাতনের শিকার ভাগ্যাহত পুরুষটির মতো গোপনেই তাদের হজম করতে হয় সকল বৈষম্য, সকল অত্যাচার। আইন প্রশাসন অভিযোগ পেয়েও সিরিয়াস হয় না, মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না, সুবিধা বঞ্চিত হলেও কোটার দাবি তুলতে পারেন না, তাদের অধিকার সংরক্ষণে ‘সংখ্যাগুরু ঐক্য পরিষদের’ মতো কোনো সংগঠন গড়ে উঠাও তো রীতিমতো অবাস্তব ও হাস্যকর বিষয়। সবচেয়ে বড় কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহংজনিত উদাসীনতা ও অসচেতনতার কারণে আসন্ন প্রলয়ের ভয়াবহতাও তারা সহজে বোঝতে চায় না বা সময় মতো বোঝতে সক্ষম হয় না।
অদ্ভুত ব্যাপার! এক শ্রেণির স্বঘোষিত প্রগতিবাদী উৎসে ফেরার নামে এই ডিজিটাল যুগে এসেও ঢাকাকে আদিম যুগের অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু দিগন্তে মেঘে ঢাকা আকাশটা যত কাছে মনে হয় আসলে তা নয়। হ্যাঁ, কিছু সময়ের জন্য কিছু লোককে হয়তো বিভ্রান্ত করা সম্ভব কিন্তু সব সময়ের জন্য সকল মানুষকে নয়। সুতরাং এ যুগেও চন্দ্র-সূর্যের বিয়ে বা মঙ্গল-অমঙ্গলের ধারণায় যারা বিশ্বাস করাতে চায় উৎস ও ঐতিহ্যের নামে তারা প্রকারান্তে বিবেকের সাথেই প্রতারণায় লিপ্ত মনে হয়। এক সময় কাবাঘরেও মূর্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আর সেই ‘ল্যাৎ-ওজ্জা’দের তুষ্টির জন্য উলঙ্গ হয়ে নারী-পুরুষ তাওয়াফ করত। উৎস আর ঐতিহ্যের নামে সেই জাহেলী যুগে ফিরে যাওয়ার আহ্বান একমাত্র ইবলিশ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব কী?
একটা বড় সমস্যা হলো এই যে, বিশুদ্ধ পানির সাথে দূষিত পানি মেশালে দূষিত পানি বিশুদ্ধ হয় না, বরং বিশুদ্ধ পানিরই বিশুদ্ধতার ইতি ঘটে। তাওহিদ ও মূর্তির সম্পর্কটা এরকমই। মূর্তির ব্যাপারে ইসলামে সতর্কতার কারণ এখানেই। একে বৈধতা দেয়া হলে মুসলমানদের ঘরে ঘরেও নবী-রাসূল আর বুজুর্গগণের প্রতিকৃতি শোভা পেত, আর তাকে আশ্রয় করে অন্ধ বিশ্বাস, শিরক-বিদাতের সয়লাবে মূর্তি পূজা অনেক আগেই তাওহিদের শেষ চেতনাটুকুও গ্রাস করে নিত অলক্ষ্যে, অজান্তেই।
এহেন বিবেচনায় আমরা জাতীয় ঈদগাহের ও সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা ও আস্থা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে মূর্তিটি অপসারণ একান্ত জরুরি মনে করছি। অতঃপর ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টসহ আদালত প্রাঙ্গণসমূহে কোরআনপাকে বর্ণিত এ সংক্রান্ত নির্দেশগুলো উৎকীর্ণকরণে অনুরোধ করছি।
যেমন বলা হয়েছেÑ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দেবে, যদিও তা আমাদের নিজেদের বা পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়, সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীনই হোক আল্লাহ উভয়েরই যোগ্য অভিভাবক। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে কামনা-বাসনার অনুসরণ কর না। যদি তোমরা প্যাঁচালো কথা বল বা পাশ কেটে চল, তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তার খবর রাখেন’ (সুরা নিসা ১৩৫)। অন্যত্রে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে উচিত সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারে তোমরা অবিচল থাকবে। কোনো সম্প্রদায়ের ওপর বিরাগ যেন তোমাদেরকে কখনও সুবিচার না করতে প্ররোচিত না করে। সুবিচার কর, এটা আত্মসংযমের আরো কাছাকাছি। আর আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর আল্লাহ তার খবর রাখেন’ (সূরা মায়িদা-৮)। অপর এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘আর তুমি যদি বিচার কর তবে ন্যায়বিচার কর। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন’ (সূরা মায়দ-৪২)।
আমাদের বিশ্বাস ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মূর্তি নয়, বরং আল কোরআনের শিক্ষাই হবে সর্বাধিক ফলপ্রসূ ও কার্যকর। অবশ্য এ লক্ষ্যে অন্য কোনো মহৎ জনের বাণী বা শিক্ষাও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ গণমানুষের চেতনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক যথাবিহিত ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করি।
য় লেখক : প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।