Inqilab Logo

বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিনোদন যেন সংসার ভাঙার হাতিয়ার না হয়

| প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল ফাতাহ মামুন : উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর কপালের ভাঁজে মঙ্গলবার সকালে সূর্য ওঠে বাংলার আকাশে। আগের দিন সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, উচ্চ আদালতে অপেক্ষমাণ একটি রিটের রায় হবে আগামীকাল। এতেই ঘুম হারাম হয়ে যায় এদেশের একশ্রেণির নারীর। রিটটি ছিল কোটি নারীর ‘প্রাণের স্পন্দন’ স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলার প্রদর্শন বন্ধ করা সম্পর্কে। অনেক দিন ধরেই ঝুলে ছিল রিটটি। ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা শাহীন আরা লাইলী এই তিনটি চ্যানেলের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করে একটি রিট আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ‘স্টার প্লাস, স্টার জলসা এবং জি বাংলাÑ ভারতীয় চ্যানেল তিনটিতে এমন সব অনুষ্ঠান প্রচার হয় যা বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এগুলো বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’ এরপর ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে ভারতীয় এই তিন টিভি চ্যানেল বন্ধে নির্দেশ কেন দেয়া হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ভাবতে খুব অবাক লাগে। একজন নারী হয়ে কীভাবে কোটি নারীর গলায় ছুরি চালানোর পরিকল্পনা করলেন সুপ্রিমকোর্টের ওই আইনজীবী! এই একজনের জন্য সবার ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ভাগ্যিস চ্যানেল তিনটির প্রদর্শন বন্ধ হয়নি। নয়তো কত নারী যে হার্ট অ্যাটাক করত আর কতজন যে গলায় দড়ি দিত তার কোনো হিসাবই থাকত না!
সব জল্পনা-কল্পনা শেষে মঙ্গলবার বিকেলে জয় হয়েছে সেই শ্রেণির নারী সমাজেরই। উচ্চ আদালত এই তিন চ্যানেল বন্ধের রিট আবেদন বাতিল করায় সকালের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিকেলের সূর্যের সঙ্গে মিলিয়ে যায় খুব সহজেই। রাতের চাঁদ নিয়ে আসে ‘বধূ বরণের’ জ্যোৎ¯œা।
এদেশের একশ্রেণির নারীর সঙ্গে ভারতীয় চ্যানেলের সম্পর্ক যে ‘রাখি-বন্ধনের’ মতোই দৃঢ়Ñ এ কথা এখন চোখ বন্ধ করেই বলতে পারি। তাই তো তাদের ‘প্রাণের স্পন্দন’ এখনো সচল। রায়ের দিন সন্ধ্যায় এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বন্ধুর বিরস মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। জানতে পারলাম, তার গিন্নি তাকে কঠিন ধমকের ওপর রেখেছে। এতদিন সে বউকে ভারতীয় সিরিয়াল দেখার ব্যাপারে নিষেধ করত। আজো করেছে। কিন্তু তার বউ আজ তাকে হাইকোর্টের রিট বাতিলের কথা বলে জেলহাজতের হুমকি দিয়েছে। বিষয়টি খুবই মারাত্মক। কিন্তু আমার কেন জানি হাসি পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কাগজ-কলম বের করে একটি ছড়া লিখে তাকে উপহার দিলাম। বন্ধুর বিরস মুখ আরো বিরস হয়ে গেল। পাঠকদের জন্য ‘গিন্নির হুমকি’ ছড়াটি তুলে দিলাম। অবশ্য পাঠকের মুখ বিরস করা আমার উদ্দেশ্যে নয়। ছড়াটি শুনা যাকÑ ‘তোমরা যারা স্টার জলসা/দেখতে করো মানা/এখন থেকে সেই কথাটা/আর যাবে না বলা।/স্টার জলসা স্টার প্লাস/ চলবে ঘরে ঘরে/ জি বাংলাও চলবে এখন/আপন আপন মনে।/এসব দেখতে করবে যারা/এখন থেকে মানা/ তাদের জন্য খোলা আছে/পাড়ার হাজতখানা।’
‘এ দেশের নারীসমাজের কাছে তুমুল জনপ্রিয় চ্যানেল তিনটির অর্জনও কম নয়। পরকীয়া, অশান্তি, বউ শাশুড়িতে দ্বন্দ¦Ñ এ তিন ক্ষেত্রে অগ্রগতির পেছনে তো ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়ালগুলোর অবদানই বেশি।’ কথাগুলো আমার নয়। মঙ্গলবার বিকেলে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তার ওয়ালে পোস্ট শেয়ার করেন। পোস্টে বলা হয়, ‘ভারতীয় সিরিয়ালগুলো এদেশের নারীসমাজকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে অনকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তারা সিরিয়ালকে দৈনিন্দন কাজ ও প্রিয় সন্তানের দেখভাল এবং খোঁজ-খবর নেয়ার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। এতে করে সন্তানরা হয়ে যাচ্ছে বখাটে। যার ফলে মাথা চারা দিচ্ছে কিশোর অপরাধ এবং গ্যাংস্টারদের দৌরাত্ম্য। যার কুফল ইতোমধ্যে রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং এসব চ্যানেল দেখার ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে সবাইকে।’
কিছুদিন আগের ঘটনা, টাঙ্গাইলে ২২ বছরের এক তরুণী পাশের বাসার আরেক তরুণীকে পিটিয়ে হত্যা করে। কোন এক সিরিয়ালকে কেন্দ্র করে তাদের মাঝে কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে এবং একজন নিহত হন। অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটি সত্য। গত ২৭ ডিসেম্বরের দৈনিক নয়া দিগন্তে খবরটি প্রকাশিত হয়। এছাড়া সিরিয়াল না দেখতে দেয়ায় আত্মহত্যা, স্বামী তালাকের ঘটনাতো ক’দিন পরপরই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। মা সিরিয়াল দেখছে আর সন্তান পানিতে পড়ে মারা গেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে এই দেশে।
শুধু কি তাই? সিরিয়ালের নামে বের হওয়া ড্রেস কিনতে না পারায় কোমলমতি শিশু-কিশোরীরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। এসব বিবেচনা করে একশ্রেণির মানুষ মনে করেন, এসব চ্যানেল নিষিদ্ধ করাই ঠিক ছিল। আমার কথা হলো বিনোদন যেন সংস্কৃতি এবং নৈতিকতার সীমা অতিক্রম না করে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে সবাইকে। পাশাপাশি সমাজ ও সংসার ভাঙনের হাতিয়ারও যেন না হয় বিনোদন। পারস্পরিক আক্রোশ তো নয়ই, বরং পরচর্চা ও পরশ্রীকাতরতা থেকেও মুক্ত থেকে বিনোদন চর্চা করা সুস্থ সমাজ ও দেশের নাগরিকের কর্তব্য। সেক্ষেত্রে নাগারিককেও যে সুস্থ ও সুনাগরিক হতে হবে তা বলাই বাহুল্য। তা না হলে রচিত হবে সভ্যতাধ্বংসের সিঁড়ি। যে সিঁড়ি বেয়ে মানুষ নামবে পশুত্বেরও নিচে। নামতে থাকবে আরো নিচে।
ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের কারণে আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান যেন বিপর্যস্ত ও ধ্বংসোন্মুখ না হয় সে দিকে নজন দিতে হবে। নজর দিতে হবে দেশীয় টিভি অনুষ্ঠানও যেন দর্শক শূন্য না হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের নির্মাতারা দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে। ভালো ভালো নাটক, সিনেমা বানিয়ে দর্শকদের দেশীয় অনুষ্ঠানমুখী করার দৃঢ় মনোভাব নিয়ে কাজ করলে এবং বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনা কমাতে পারলে সফলতা আসবেই। আসলে কোনো জিনিস আইন করে বন্ধ করলেই তা বন্ধ হয় না। বন্ধ করতে হয় সৃজনশীলতা দিয়ে। তাই হাইকোর্টের তিন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ না করার রায়টিরও যৌক্তিকতা আছে। তাই বলে, যে আইনজীবী এগুলোর সম্প্রচার বন্ধের রিট করেছিলেন, তিনিও যে ভুল ছিলেন তা আমি বলছি না। এদেশের অনেক মানুষই এসব চ্যানেলবিরোধী। সম্মানীত আইনজীবী অনেকের মধ্যে অন্যতম সাহসী একজন। আমি নিজেও তাদের একজন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ