Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনীতির সংলাপ, সংলাপের রাজনীতি

| প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন : অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। গত ২৫ জানুয়ারি রাতে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য মনোনীত এ সার্চ কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করে। গণমাধ্যমের সংবাদ সূত্রে সার্চ কমিটির সদস্যদের নাম-ধাম পরিচিতি ইতোমধ্যেই দেশবাসী জ্ঞাত হয়েছে। এরমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- গত নির্বাচন কমিশন গঠনে যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সে কমিটির যিনি প্রধান ছিলেন, এবারও তাকেই প্রধান করা হয়েছে। ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, দুই জন বিচারপতি এবং বাকি দুইজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা।
সার্চ কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণার পর সঙ্গত কারণেই তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রত্যাশাজনিত অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলগুলোর প্রতিক্রিয়াকে গণমাধ্যম মিশ্র প্রতিক্রিয়া বলে অভিহিত করেছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ব্যক্ত করেছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। সার্চ কমিটি ঘোষণার পরপরই ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি একটি প্রতিষ্ঠান, বিএনপি আশা করেছিল, তার কাছ থেকে একটা নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। সংকট নিরসনে সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। এখানেই বোঝা যাচ্ছে, বাছাই কমিটি কী ধরনের ইসি গঠন করবে। এই কমিটির মাধ্যমে আবারও অন্ধকার গহ্বরের দিকে দেশকে ঠেলে দেয়া হলো।’ তিনি এও বলেছেন যে, ঘোষিত সার্চ কমিটি নিয়ে বিএনপি শুধু হতাশাই নয়, প্রচ-ভাবে ক্ষুব্ধ।
সার্চ কমিটি সম্পর্কে বিএনপি তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে গত ২৭ জানুয়ারি। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন- ‘রাষ্ট্রপতির গঠিত ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির পাঁচজনই বিতর্কিত। এ কমিটি নিরপেক্ষ নয়। এ কমিটিতে সরকারের ইচ্ছা পূরণে সহযোগিতায় পুরস্কৃত ও আওয়ামী পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি একে শুধু বিতর্কিতই করেনি, এর মাধ্যমে জনমতকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।’ মির্জা আলমগীর এও বলেছেন যে, ‘এমন সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী ও যোগ্য ব্যক্তিরা আগামী নির্বাচন কমিশনের প্রধান কিংবা সদস্য হবেন এমনটা আশা করাও বাতুলতা মাত্র।’
অপরদিকে সরকারের পার্টনার জাতীয় পার্টি স্বাগত জানিয়েছে ঘোষিত সার্চ কমিটিকে। দলটির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি নিয়ে সব দলের সঙ্গে যে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা রাজনীতিতে সমঝোতা ও আস্থার জায়গা তৈরিতে প্রথম ধাপে সফল হয়েছেন।’ এ সার্চ কমিটি সদিচ্ছা থাকলে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, এ সার্চ কমিটির মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কমিশন গঠনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
সার্চ কমিটি নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্টজনেরাও। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, একজন আইনজীবীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই ব্যাপারটি আমার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তবে, যেহেতু সার্চ কমিটি হয়ে গেছে, তাদের কাজ থাকবে একটি ভালো কমিশন গঠন করা।’
আর ঘোষিত সার্চ কমিটিকে সমর্থন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল। তারা বলেছে, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত সার্চ কমিটিকে সবার মেনে নেয়া উচিত। তাছাড়া ঘোষিত কমিটি সম্পর্কে বিএনপির ইতিবাচক মনোভাব দেখানো উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা। আর বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, সার্চ কমিটিকে বিতর্কিত করলে বিএনপিরই ক্ষতি হবে। কেননা, এ কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে বাংলাদেশের কর্মরত পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদন করেছিল। কিন্তু সরকার সে আবেদনে সাড়া দেয়নি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এ ধরনের সাক্ষাতের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তবে ইসি পুনর্গঠনের ইস্যুতে অগ্রগতি বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করা হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সার্চ কমিটির ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। ওই দিন চলে গেছে।
সার্চ কমিটি গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বিএনপি যে অত্যন্ত খুশি হয়েছিল সেটা তাদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ যে রকম আন্তরিকতার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সনের নেতৃত্বে বঙ্গভবনে আগত প্রতিনিধিদলকে গ্রহণ করেছিলেন এবং ততোধিক আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছিল, তাতে বিএনপি হয়তো আশা করেছিল যে, সার্চ কমিটি গঠনের সময় রাষ্ট্রপতি তাদের প্রস্তাবনাকে মূল্যায়ন করবেন। সে সময় বিএনপির পক্ষ থেকে ‘রাষ্ট্রপতিই শেষ ভরসা’ এমন কথাও বলা হয়েছিল। তারা এ আশাবাদও ব্যক্ত করেছিলেন যে, একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে রাষ্ট্রপতি একটি দল নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সার্চ কমিটি গঠন করবেন।
কিন্তু বিএনপির সে প্রত্যাশা যে পূরণ হয়নি সেটা না বললেও চলে। বিশেষত গত সার্চ কমিটির প্রধানকেই পুনরায় প্রধান করায় শুধু বিএনপির ভেতরেই নয়, রাজনীতি সচেতন মহলেই প্রশ্ন উঠেছে। তারা বলছেন যে, ওই ব্যক্তিটি ছাড়া সার্চ কমিটির প্রধান করার মতো আর কোনো লোককে কি রাষ্ট্রপতি খুঁজে পাননি? অনেকে মনে করেন যে, আওয়ামী লীগ তথা সরকারের দেয়া তালিকাতেই রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করে দিয়েছেন মাত্র। ফলে সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিরাই সার্চ কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। এক্ষেত্রে বিএনপি যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছে সেসব ভিত্তিহীন নয়, বরং অনেকাংশেই সঠিক। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হোক, বা মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক কিংবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানই হোক, সরকারের একান্ত আস্থাভাজন না হলে তারা ওইসব পদে স্থান পেতেন না। ফলে সার্চ কমিটি যে ক্ষমতাসীনদের অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং তারা যে নির্বাচন কমিশন সদস্যদের নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রে শাসক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সন্তুষ্টির প্রতিই বেশি গুরুত্ব দেবে তাতে সংশয় থাকা উচিত নয়।
গঠিত সার্চ কমিটি ইতোমধ্যেই তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছে গত ২৮ জানুয়ারি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক একত্রিশটি রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচন কমিশন সদস্য করার জন্য পাঁচটি করে নাম চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। অপর দিকে সোমবার দেশের ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথেও পরামর্শ করেছেন সার্চ কমিটি। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ ২৭টি দল তাদের পক্ষ থেকে সার্চ কমিটির কাছে নাম পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অনেকেই বলছেন, বিশিষ্টজনদের পরামর্শ কিংবা বিএনপি বা অন্য কোনো দলের পক্ষ থেকে নাম দিলেও তাতে তেমন কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। কেননা, রাষ্ট্রপতি শেষ পর্যন্ত সরকারের পছন্দের লোকদের দিয়েই যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবেন সে আলামত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যারা আশা করেছিলেন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে রাষ্ট্রপতি যে সার্চ কমিটি গঠন করবে, তার মধ্য দিয়ে হয়তো চলমান রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটবে, নিদেনপক্ষে জটিলতা অনেকাংশেই কমে আসবে। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর সরকার পক্ষ এবং বিরোধী দলের পরস্পর বিরোধী যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে, তাতে নিরসন তো দূরের কথা সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠার আলামত দেখা দিয়েছে। গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশ বা প্রস্তাবনায় যে সরকার তথা সরকারি দলের ইশারা-ইঙ্গিতের প্রতিফলন ঘটবে তা বুঝতে বেশি জ্ঞান-বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে না।
বাস্তবিক, যে সুযোগ রাষ্ট্রপতির হাতে ছিল, তিনি যদি তার সদ্ব্যবহার করতেন, তাহলে দেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক বায়ু প্রবাহ শুরু হতে পারত। তবে যারা এমন প্রত্যাশা করেছিলেন, তারা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে, বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাষ্ট্রপতির আগ বাড়িয়ে কোনো কিছু করার ক্ষমতা বা সুযোগ নেই। সরকার যা বলবে তিনি সেভাবেই তার দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান সেভাবেই রাষ্ট্রপতিকে দায়িত্ববান করেছে। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ তার জন্য অপরিহার্য। ফলে সার্চ কমিটি গঠনেও তিনি সে পরামর্শ গ্রহণ করে থাকবেন এবং তদানুযায়ীই সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এটাই যদি হবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি যদি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সার্চ কমিটি করবেন, তাহলে এক মাসব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কেন এ সংলাপ নাটক হলো? এর কি দরকার ছিল? বলে দিলেই হতো, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের বাইরে যেতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সার্চ কমিটি, নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। তাহলেই ল্যাঠা চুকে যেত! বঙ্গভবনে অতো ঘটা করে খানা-পিনা- আলোচনার কী দরকার ছিল?
হ্যাঁ এটারও দরকার ছিল। কারণ, সরকার দেখাতে চেয়েছে রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে শুধু প্রধানমন্ত্রী নয়, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শও অত্যন্ত আগ্রহভরে ও গুরুত্বসহকারে শ্রবণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমি দৈনিক ইনকিলাবের ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় আদিগন্ত পাতায় এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছিলাম- ‘নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ প্রক্রিয়াকে কেউ কেউ ‘ত্রি-পক্ষীয় আই ওয়াশ’ বলেও অভিহিত করেছেন। তারা বলছেন- প্রথমত রাষ্ট্রপতি দেশবাসীকে এটা দেখাতে চাচ্ছেন যে, সাংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নির্বাচন কমিশন গঠনের একক এখতিয়ার তার থাকলেও সব দলের মতামতকেই তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে তা সবারই জানা। (সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের দৃষ্টান্ত স্মর্তব্য)। দ্বিতীয়ত- বিএনপি দেশবাসীকে বোঝাতে চায় যে, নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে তারা রাজপথে আন্দোলন না করে (সে সক্ষমতা তাদের আছে- এটা কেউ মনেও করে না) আলোচনা-সমঝোতাই তারা চান। তৃতীয়ত- সরকার তথা আওয়ামী লীগ জানে যে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাইরে যেতে পারবেন না, তাই তারা রাষ্ট্রপতির সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছে। এটা দ্বারা তারা দেশবাসীর কাছে এ বার্তা পৌঁছে দিতে চান যে, আওয়ামী লীগও সংলাপ-সমঝোতাকে গুরুত্ব দেয়।’
সহৃদয় পাঠক, আমার উপর্যুক্ত আগাম মন্তব্য যে একেবারে অসার প্রমাণিত হয়নি সেটা তো জোর গলায় বলা যায়, নাকি? যারা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করে আসছেন তারা আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত হবেন যে, সংলাপের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক সমস্যারই সমাধান হয়নি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া সংলাপ ব্যর্থ হয়েছিল, ১৯৯৬ এবং ২০০৬-এ সালে ব্যর্থ হয়েছিল বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংলাপ। দুঃখজনক হলো, প্রতিটি সংলাপের ব্যর্থতার পরই ঘটেছে রক্তাক্ত ঘটনা। ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয়েছে পাক হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও তৎপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগের আন্দোলন ছিল সহিংস। ২০০৬ সালে তো তারা সংঘটিত করেছিল লগি-বৈঠার নৃশংসতা। সুতরাং, এ কথা বলা নিশ্চয়ই অতিশয়োক্তি হবে না যে, ‘সংলাপ’ আমাদের দেশের রাজনীতিতে সংকট সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এ সংলাপ সময়ক্ষেপণ আর জনগণের কাছে নিজেদের ‘সদিচ্ছা’র উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন ছাড়া কিছু নয়। যদিও প্রকৃত সদিচ্ছার অভাব সবারই রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সংলাপগুলো বারবার ব্যর্থ হয় কেন? অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে উ™ূ¢ত সমস্যা সমাধানে সংলাপ-ই তো হওয়া উচিত সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু বাস্তবতা হলো-তা কখনোই হয় না। সংলাপের এ ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো- রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাব। তারা যে বিষয়কে নিয়ে সংলাপে বসেন সে বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও সামনে বা পেছনে যেতে রাজি হন না। এতটুকু ছাড়া দিতে রাজি হন না কেউ কাউকে। ফলে তারা যেমন যার যার অবস্থানে অটল থাকেন, তেমনি সমস্যা-সংকটও তার অবস্থানে থাকে বহাল তবিয়তে। মাঝখানে ‘সংলাপ’ নামে প্রক্রিয়াটি কয়েকদিন লাফালাফি করে ধীরে ধীরে অপসৃত হয়ে যায়। ঠিক একই পরিণতি হলো রাষ্ট্রপতি-রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ প্রক্রিয়ার। সারাদিন যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ অংক কষে সন্ধ্যায় ফলাফল পাওয়া গেল ‘শূন্য’।
প্রশ্ন উঠতে পারে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সংলাপ যদি কার্যকর না হয়, তাহলে সমস্যা সমাধানের পথটা কী? এ প্রশ্নের এক কথায় জবাব হলো ‘জনগণের দাবি বা প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে বাধ্য করা’। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের চরম ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো সরকারকে বাধ্য করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি এখন নেই। ফলে সংলাপ-আলোচনা যাই হোক, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীনদের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটছে এবং ঘটবে।
সংলাপের রাজনীতি বলি, আর রাজনীতির সংলাপই বলি, বাংলাদেশের নিকট ইতিহাসে এর সফলতার নজির নেই এটা আগেই বলেছি। সে ব্যর্থ সংলাপের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলো সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলসমূহের সংলাপ। এ ব্যর্থতা দেশের বিদ্যমান, রাজনৈতিক সংকটকে কোন মাত্রায় নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
য় লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ