বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
লিয়াকত হোসেন খোকা : চিকিৎসা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণমানুষের এ অধিকার পূরণে প্রথম থেকেই তুলনামূলকভাবে যতœবান ভূমিকা রেখেছে। দেশের চিকিৎসা খাতে জনগণের ট্যাক্সের অর্থ থেকে উল্লেখযোগ্য অংশ বরাদ্দ দেওয়া হয় জাতীয় বাজেটে। যারা সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে পড়াশোনা করছে তাদের পড়াশোনার ৯৫ শতাংশই অর্থের জোগান দেওয়া হয় দেশবাসীর পকেট থেকে। দেশের সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর পেছনেও ব্যয় করা হয় বিপুল অর্থ। তারপরও দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে চিকিৎসা খাত কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে তা একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়।
দেশে মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক এমনকি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনে সরকারিভাবে অনুমতি দেওয়া হয়েছে উদারভাবে। এত কিছুর পরও চিকিৎসা ব্যবস্থায় চলছে চরম নৈরাজ্য। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বেসরকারি চিকিৎসা খাত সেবার বদলে বাণিজ্যিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উভয় খাতেই বিরাজ করছে যাচ্ছেতাই অবস্থা। দেশের চিকিৎসকদের বেশির ভাগই ওষুধ কোম্পানির হুকুম বরদারের ভূমিকা পালন করছেন। রোগীদের কাছ থেকে বড় অংকের ফি নিয়েই তারা সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না। ওষুধ কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশন করার নামে তাদের কাছ থেকেও গ্রহণ করছেন বড় অংকের টাকা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে চিকিৎসকদের অলিখিত চুক্তি সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয়কে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা কমিশনের লোভে যেসব বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার নেই সেসব বিষয়ে পরীক্ষার জন্যও রোগীদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য করছে।
চিকিৎসকদের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক থাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যেনতেনভাবে রিপোর্ট দিয়েই খালাস। বাংলাদেশের এসব পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এমনকি ভারতে গেলে সে দেশের চিকিৎসকরা হাসাহাসি শুরু করেন। সোজা কথায় চিকিৎসার নামে বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রেই চলছে প্রতারণা। ফলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য জাতীয় বাজেটে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তা আদতে খুব একটা কাজে লাগছে না। জনস্বার্থে এসব বিষয়ে সরকারকে কুম্ভকর্ণের ঘুম থেকে জাগতে হবে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ।
চিকিৎসা এক মানবিক পেশার নাম। মুনাফা বা অন্য কোনো অর্জনের চেয়ে মানব সেবাই সেখানে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। হাজার হাজার বছর ধরে চিকিৎসার এই মানবিক বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখা হয়েছে। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক সুলতান গাজী সালাহউদ্দিন ঘোরতর শত্রু পক্ষের অধিনায়ক ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ডের অসুস্থতার খবর শুনে ছদ্মবেশে তার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। গাজী সালাহউদ্দিন নিজেই যেহেতু ছিলেন খ্যাতনামা চিকিৎসক, সেহেতু পরম শত্রুর বিপদে তার সেবা করাকে কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন।
কালের বিবর্তনে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাণিজ্য প্রাধান্য পাওয়ায় এর মানবিক উপাদানগুলো নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশের সংবিধানে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। গত চার দশকে দেশে বিপুলসংখ্যক সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরও মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতে হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আশা করা হয়েছিল চিকিৎসাসেবাকে মানবিক পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে এসব খাতের উদ্যোক্তারা ভূমিকা রাখবেন।
বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এ ক্ষেত্রে যথার্থ ভূমিকা পালন করলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলেই মনে করা হয়। রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠলেও এগুলোর সেবার কোনো মানই নেই। মুনাফার জন্য এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকরা যা ইচ্ছা তাই করাকে কর্তব্য বলে ভাবেন।
হাতেগোনা দু-একটি বাদে সিংহভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ডাক্তার সাজিয়ে কোথাও কোথাও রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। কোথাও কোথাও ক্লিনিকের মালিক অথবা ম্যানেজার অ্যাপ্রোন পরে চিকিৎসক সেজে রোগীদের চিকিৎসা করেন এমন অভিযোগও রয়েছে।
সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে সে ব্যবস্থা অপ্রতুল। এ সুযোগে দেশজুড়ে গজিয়ে উঠেছে গত ২০ বছরে সরকার অনুমোদিত ও অননুমোদিত অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অধিক ব্যয়সাপেক্ষ এসব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ তেমন সেবা পাচ্ছে না। বরং সেবার নামে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিক অর্থ আদায়, প্রতারণা, ভুল চিকিৎসা এবং জবাবদিহি ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যর্থতার কারণে দেশের শতকরা ৬৮ ভাগ লোক বেসরকারি স্বাস্থ্যকে›েন্দ্র চিকিৎসা নেন। এ সুযোগসহ সরকারের অদক্ষতা, অবহেলা, উদাসীনতার সুযোগে মালিকরা চালাচ্ছেন স্বেচ্ছাচারিতা। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা করার নামেই সরকারের অনুমোদন নেয়। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধ আমদানিতে সরকারি ভর্তুকিও পেয়ে থাকে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে।
দেশের অধিকাংশ বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নামসর্বস্ব। সেগুলোতে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, অস্ত্রোপচার কক্ষ (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত), চিকিৎসার জরুরি যন্ত্রপাতি, ওষুধ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ইত্যাদি নেই।
দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো যে পরিমাণ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক গড়ে উঠেছে তার শতকরা ৯০ ভাগ চিকিৎসকের ডিগ্রিই অপ্রয়োজনীয় এবং ভুয়া। সাধারণ রোগীরা এত এত ডিগ্রি দেখে সরল মনে এসব ডাক্তারকে দেখানোর জন্য ভিড় জমায়। এ সুযোগে তারা রোগী প্রতি ফি নেন নিম্নে ৩শ’ থেকে ৬শ’ টাকা পর্যন্ত। এর সাথে প্যাথলজি টেস্টের নামেও চলে কমিশন বাণিজ্য। তারা রোগীকে প্যাথলজি পরীক্ষার জন্য লম্বা স্লিপ দিয়ে মনোনীত ক্লিনিক কিংবা ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করার জন্য বলে দেন। নির্দিষ্ট প্যাথলজি ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা না করালে তারা রোগী দেখেন না। এতে প্রতিটি টেস্টের জন্য প্যাথলজি ল্যাবরেটরি থেকে ওসব চিকিৎসক ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমিশন পেয়ে থাকে। মূলত এসব ডাক্তার রোগীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছেন। এতে রোগীরা বিভ্রান্ত এবং শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ নৈরাজ্যের অবসানে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সজাগ হবে আমরা তেমনটিই দেখতে চাই।
নিতান্ত নিরুপায় না হলে কেউ সরকারি হাসপাতালে যেতে চায় না। দেশের সামর্থ্যবানরা সাধারণত বেসরকারি হাসপাতালে সেবা গ্রহণ করে থাকে। দেশের বাইরে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। বলাবাহুল্য, স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের একটি বিরাট অংশ ব্যয় হয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা প্রায় উঠে গেছে। কমবেশি যাই হোক, একপ্রকার অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের সরকারি হাসপাতাল ছাড়া যাওয়ার জায়গা কম। দেশের চিকিৎসা খাতের অবস্থা এমন যে, অনেককেই দেখা যায় যারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেবার পরও প্রয়োজনীয় ওষুধ বাইরে থেকে কিনছেন। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের কথা থাকলেও তা পাওয়া যায় না। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না দেশে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি হাসপাতাল অপ্রতুল। হাসপাতালগুলোতে প্রায়শই দেখা যায় রোগীদের উপচেপড়া ভিড়, এর ওপর রয়েছে নানা অনিয়ম।
সরকারি হাসপাতালে এই বিশেষ দালালদের কারণেই রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। আবার সংশ্লিষ্টদের সন্তুষ্ট করতে পারলে সরকারি হাসপাতালে হয় না এমন কোনো কাজ নেই। অপরদিকে, হাসপাতালে এদের অবস্থান অত্যন্ত শক্ত। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের অনুপস্থিতিতে ওয়ার্ডবয়-আয়াদের অপারেশন ব্যান্ডেজ করার সচিত্র প্রতিবেদনও ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। খোদ রাজধানীতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে ধরনের অব্যবস্থাপনার খবর প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় রাজধানীর বাইরের হাসপাতালগুলোর অবস্থা কতটা নাজুক। কেন কর্তব্যরত ডাক্তার ও সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব পালন করছে না তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
য় লেখক : সংসদ সদস্য, নারায়ণগঞ্জ-৩, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।