বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন : অর্থনৈতিক অঙ্গনে শেয়ারমার্কেটে উদ্বেগজনক উল্লম্ফন এবং ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদসহ শীর্ষ পদগুলোতে ‘বিদেশী চাপ’জনিত ব্যাপক পরিবর্তন বছরের শুরুতে ব্যাপক আলোচিত দুটি ঘটনা। তবে ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তনের হাওয়ায় বিদেশী চাপ থাকার কথা অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের বক্তব্যে জানা গেলেও শেয়ারবাজারে যেন উল্লম্ফন অর্থনীতিতে বসন্তের হাওয়া লাগার কারণ, না এর পেছনে অতীতের মতো কোন সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র বর্তমান তা জানার জন্য আরো কয়টি দিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। তবে তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে যে, ততদিনে অসংখ্য বিনিয়োগকারীর পকেট আবারও শূন্য হওয়ার কারণ হয়ে না যায়।
খবরে প্রকাশ, শেয়ারমার্কেটের লাগামহীন উল্লম্ফন ইতোমধ্যে ২০১০ সালের বিপদসীমাও অতিক্রম করার পথে। তারপরও সময়টা আবার আওয়ামী শাসনের বলে আতঙ্কটা একটু বেশি। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখেও ভয় পাওয়া অমূলক না হলে; এক্ষেত্রে জনগণের ভয় ও সংশয় অর্থহীন নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং ২০১০-এর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত কমিটির প্রধান ইব্রাহীম খালেদের মূল্যায়ন, ‘শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক উল্লম্ফন স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত মনে হচ্ছে না।’ তাঁর মতে, ব্যাংক আমানতের সুদের হার কম, তাই কিছু লোক শেয়ারবাজারের দিকে ঝুঁকছে, পুরনো খেলোয়াড়রা সেটাকে ব্যবহার করে নিজেদের মতো খেলছে।’
এটা ভুলে যাওয়ার মতো নয় যে, শেয়ারমার্কেট বিপর্যয় ’৯৬ ও ২০১০ দুটোই আওয়ামী আমলের মর্মান্তিক ঘটনা; যার পরিণতিতে রাতারাতি ফতুর হয়ে গেলেন কমবেশি অর্ধকোটি বিনিয়োগকারী, আজও যারা নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। অনেকের ছেলেমেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়েছে। দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেও দেখা গেছে কারো কারো ক্ষেত্রে। ’৯৬তে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম কিবরিয়া সাহেব শেয়ারমার্কেট বোঝেন না বলে দায় এড়াতে চাইলেও বর্তমান বহুদর্শী অর্থমন্ত্রী তেমন কোন অজুহাত না দেখিয়ে লুটেরাদের ধরা ও আইনের আওতায় আনার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এক শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
নানা বাধা বিপত্তি এড়িয়ে ‘খালেদ কমিটি’ লুটেরাদের চিহ্নিত করে চূড়ান্ত রিপোর্টও পেশ করলো বটে কিন্তু লুটেরাদের জাত-পরিচয় জানার পর হতাশ ও হতচকিত অর্থমন্ত্রী তাদের নাম প্রকাশেও অপরাগতা জ্ঞাপন করলেন। লুণ্ঠিত টাকা উদ্ধার বা শাস্তি বিধানতো দূরের কথাÑ তাঁর ভাষায় ‘দুষ্টুদের’ নাম প্রকাশ করাও সম্ভব নয়। কারণ তাদের ক্ষমতার দৌড় অনেক। সুতরাং ‘দুষ্টুদের’ ধরা ও আইনের আওতায় আনার কথা ভুলে গিয়ে পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তিনি উল্টো বিনিয়োগকারীদেরই দূষলেন। তার ভাষায় ‘শেয়ারমার্কেটে বিনিয়োগকারীরা ফটকাবাজ। তাদের কষ্ট দেখে তার কোন দুঃখ হয় না। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বোধ করি একেই বলে।
’৯৬ ও ২০১০-এর বিপর্যয়ের সময়ও এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ একে সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলশ্রুতি বলে উৎসাহও জুগিয়েছেন যা বিনিয়োগকারীদের পকেট শূন্য করতে মন্ত্রের মতোই কাজ দিয়েছিল। বোধকরি এবারও সেই বিশেষজ্ঞগণ উন্নয়নের উপসর্গ হিসেবে আরো যুৎসই ব্যাখ্যা নিয়ে এগিয়ে আসবেন। সুতরাং বিনিয়োগকারীদের এখনই সাবধান হওয়া উচিত।
সব কথার বড় কথা হলো দেশতো কখনো সরকার ও প্রশাসন শূন্য ছিল না। দু দফায় কম করে হলেও ৫০ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের জীবনের সব সঞ্চয় এমনকি ঋণ করে নেয়া অর্থ হারিয়ে রাতারাতি ফতুর হয়ে গেলেন অথচ সরকার কিছুই টের পেল না এমনকি চিহ্নিত ডাকাতদের বিরুদ্ধে না কোনো ব্যবস্থা নিতেও সক্ষম হলো, না উদ্ধার করতে পারল একটি কানাকড়িও। এটি স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নেয়া যায় কি? হাতিয়ে নেয়া এই লক্ষ কোটি টাকা পকেটে না মানিব্যাগে লুকিয়ে রাখার মতো বিষয় না, ফলে কোনো না কোনো ব্যাংক একাউন্টেই তো থাকার কথা। আর আজকের ডিজিটাল যুগে তা খুঁজে পাওয়া ‘ওয়ান-টু’র ব্যাপার মাত্র। তাহলে লক্ষ কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেল কেমন করে? বিনিয়োগকারীরা দিন কয়েক রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল করলেও অবশেষে পুলিশের পিটুনি খেয়ে রাস্তা ছেড়ে ঘরে গিয়ে উঠলেন। নিরুপায় কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেও সরকারের পক্ষ হতে দুষ্টুদের ক্ষমতা অনেক তাই তাদের নামও প্রকাশ করা যাবে না এমন দায়িত্বহীন বক্তব্যের বাইরে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না।
শেয়ারমার্কেটের আজকের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি আর একটা বিপর্যয়ের পূর্ব লক্ষণ না হোক এটা আমাদের প্রত্যাশা। তবে বিনিয়োগকারীদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে বৈকি। বিনিয়োগটি বাস্তবসম্মত কিনা এ বিষয়টি সতর্কতা ও দূরদৃষ্টির সাথে বিবেচিত হওয়া উচিত। ৫ টাকা দামের একটি বলপেনের মূল্য আগামী দিন ৫০ টাকা হতে পারে এমন অবাস্তব-প্রত্যাশার ওপর ভরকে আজ তা ৪০ টাকা কেনা কোন ক্রমেই বুদ্ধিমানের কাজ নহে। এই বিষয়টি এ জন্যও জরুরি যে, যে কোন ধরনের বিপর্যয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে কোন সহায়তা পাওয়া যাবে না তা অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই ধারণা করা যায়। সম্ভবত আমাদের সরকারও এ বেলা বিনিয়োগকারীদের মতোই অসহায়। অভিজ্ঞজনের অভিমত, এর পেছনে ‘বিদেশী চাপ’ না হোক কূটকৌশল থাকা অবাস্তব নয়। সন্দেহটা এ কারণেও যে তাবৎ বিশ্বে এমনটি এখন পর্যন্ত নজিরবিহীন।
য় লেখক : প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।