Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

হিন্দি হটাও বাংলা বাঁচাও

প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৩ পিএম, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

স্টালিন সরকার : ভাষার মাস ফেব্রুয়ারী। মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দিয়েছেন দেশের বুদ্ধিজীবী, বিদ্যাজীবীরা। কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতির ব্যক্তিত্বরা নিত্যদিন টিভিতে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। বাংলার শুদ্ধ উচ্চারণের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। ইংরেজি ভাষার প্রতি কিছু মানুষের অতি উৎসাহের সমালোচনা করছেন। কিন্তু বাংলা ভাষার ওপর হিন্দির আগ্রাসন নিয়ে কেউ কোনো ‘রা’ করছেন না। আমাদের বাংলা ভাষার ওপর বর্তমানে ইংরেজির আগ্রাসন বেশি না হিন্দির? দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এক সময় ইংরেজি কার্টুন দেখতো। এখন আকাশ সাংস্কৃতির বদৌলতে হিন্দি কার্টুন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। হিন্দি কার্টুন ডোরেমন দেখে না এমন পরিবার কয়টি রয়েছে? হিন্দি কার্টুনের আধিক্যে ছোট ছোট শিশু ও ছেলেমেয়েরা বাংলার বদলে হিন্দির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। মায়ের বুলি বাংলার বদলে হিন্দিই বেশি উচ্চারণ করছে। শিশু জন্মের পর মাতৃভাষা বাংলা শোনার বদলে টিভির কার্টুনের বদৌলতে হিন্দির প্রতি আসক্ত হচ্ছে; অথচ বুদ্ধিজীবীরা নীরব! হিন্দির এই আগ্রাসন রুখতে বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, বিদ্যাজীবী ও সাংস্কৃতির ব্যক্তিত্বরা প্রতিবাদী হচ্ছেন না কেন? একুশ এলেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য দরদ উথলে পড়ে অথচ হিন্দির আগ্রাসনে দেশের শিশুরা এবং নতুন প্রজন্ম যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে সে খেয়াল নেই? এ ব্যাপারে রাজনীতিকরা ‘খামোশ’ কেন? ইংরেজির বিরুদ্ধে যত কথা উচ্চারিত হচ্ছে তার সিকিভাগ কি হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হচ্ছে? ’৫২ রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মার্যাদা দেয়া এবং ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা গৌরবের জাতি হিন্দির আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করছি?
ফেব্রুয়ারীর বাংলা একাডেমীর বইমেলা নিয়ে প্রতিদিন দেশের টিভিগুলোতে বাংলা ভাষার গৌরব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা বাংলা ভাষার প্রতি দরদী তারা নানাভাবে মাতৃভাষার শুদ্ধচর্চার আবেদন-নিবেদন করছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হাজী শরিয়ত উল্লাহসহ অনেক প-িত বাংলা ভাষার জন্য কাজ করেছেন। ভাষার প্রতি দরদ থেকে মানুষকে মাতৃভাষার উৎকর্ষ সাধন করেছেন। মাতৃভাষার প্রতি রাজানীতিকদের দরদও কম নয়। রাজনীতিকদের মধ্যে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, অলি আহাদ, ভাষা আবদুল মতিন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানসহ অনেক বাংলা ভাষাচর্চার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। কিন্তু এখন জাতীয়তাবাদী ধারার দলগুলো দিল্লী তোষণনীতির কারণে হিন্দির আগ্রাসণ রোধের প্রতিবাদ করার সাহস দেখাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নানা কর্মকৌশল করছেন। শহীদ মিনারের ফুল দেয়া নিয়ে হুড়োহুড়ি করছেন। অথচ হিন্দির আগ্রাসন থেকে মাতৃভাষাকে রক্ষায় উৎসাহী হচ্ছেন না। এই একুশের মাষে দেশের শিশুদের মাতৃভাষার প্রতি আকৃষ্ট করতে কয়টি সভা সেমিনার হয়েছে? সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে একটি পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। ১/১১ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত কিং পার্টি খ্যাত ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) পোস্টারটি করেছে। অমর একুশের ডাক দিয়ে পোস্টারে বলা হয়েছে ‘সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোষ নেই’। ‘হিন্দি হটাও বাংলা বাঁচাও- সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখে দাঁড়াও’। হিন্দির আগ্রাসনের চলমান সময়ে সেøাগানটি খুবই তৎপর্যপূর্ণ। যতই কিংপার্টি বলে পিডিপি নেতা ফেরদৌস কোরেশীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হোক তার সেøাগান এবং হিন্দির আগ্রাসন থেকে বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর আর্তি সত্যিই প্রশংসা যোগ্য। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যামিরেটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন হিন্দির আগ্রাসন চলছে। তারমতে আকাশ সাংস্কৃতির বদৌলতে এই হিন্দির যেভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হিন্দি হচ্ছে ভারতের ঐক্যের সূত্র। হিন্দির বিস্তারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতির মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। সাংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির মেরুদ-। আর এই হিন্দির আগ্রাসনের মাধমে আমাদের বাংলা ভাষাকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে’। ডোরেমন কার্টুন ছাড়াও ভারতীয় চ্যানেলে হিন্দিতে প্রচারিত মহাভারত, ঠাকুর মার ঝুলি, জয় হনুমান, গড গণেশ, গোপাল ভাঁড়সহ অসংখ্য সিরিয়াল দেখানো হয়। এসব সিরিয়াল নিয়মিত দেখে আমাদের বাংলাদেশের শিশুরা হিন্দির প্রতি উৎসাহী হচ্ছে। বাংলা ভাষার শেখার বদলে তারা হিন্দির প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। ইদানিং রাজধানী ঢাকার শিশুদের মধ্যে হিন্দীতে কথা বলা যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। শিশুদের উপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে শিশুরা টিভিতে যা দেখে তাই সত্য বলে মনে করে। আর সেই দেখা ও শেখা যদি হয় অভিভাবকের অবর্তমানে তাহলে তো সোনায় সোহাগা! হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে তৈরি শিশুতোষ কার্টুন, এনিমেশন এবং সিরিয়ালগুলো থেকে একটি মুসলিম পরিবারের শিশু কি শিখতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়। অবুঝ শিশুরা যে হিন্দির আগ্রাসনে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে সে দায় কার? শুধু ঢাকা শহর নয়; কোলকাতার টিভির কার্টুনের বদৌলতে গ্রামগঞ্জের অনেক শিশুই এখন হিন্দিতে কথা বলতে পারে সাবলীলভাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কার্টুনের কারণেই শিশুই এখন বাসায়, বন্ধুদের সাথে এমনকি স্কুলেও হিন্দি ভাষায় কথা বলে। শুধু বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করা শিশুরাই নয়; ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা শিশুদেরও দ্বিতীয় ভাষা হয়ে উঠেছে হিন্দি। যার কারণে শিশুদের মধ্যে মাতৃভাষার বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। অথচ একুশের মাসেও হিন্দির আগ্রাসন রুখতে কেউ আওয়াজ তুলছে না।
ভারতীয় চ্যানেলে হিন্দি ভাষায় প্রচারিত সিরিয়াল, নাটক নেতিবাচকভাবে আঘাত করছে আমাদের পারিবার ও সামাজিক মূল্যবোধে। হিন্দি সিরিয়াল বোম্বের সিনেমাবাহিত সংস্কৃতি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের অন্দরে ঢুকছে ভয়াবহভাবে। হিন্দি ভাষার সিনেমা, টিভি সিরিয়ালে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রেম করার কৌশল, ভাষা বিন্যাস, পোশাকের স্টাইল, পরকীয়া প্রেম, চুল চেহারার বিন্যাস, বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া, আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অথচ জাতি হিসেবে আমাদের শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আকৃষ্ট করা জরুরী। যাদের এসব করার কথা তারাও যেন শ্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে জ্ঞানচর্চা, ব্যবসা, অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে হিন্দি ভাষার গুরুত্ব নেই। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যারা কাজ করতে যান তাদের জন্য আরবী শেখা গরুত্বপূর্ণ। অথচ আকাশ সাংস্কৃতির আগ্রাসনে হিন্দির চর্চা আমাদের শিশুদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে। ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তান আমলের উর্দুর মতোই এখন এ জাতির ঘাড়ে হিন্দি চেপে বসছে। অথচ বুদ্ধিজীবী এবং দেশপ্রেমী রাজনীতিকদের কারো এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই! পিডিপির মহাসচিব এহসানুল হক সেলিম বললেন, হিন্দির আগ্রাষণ রুখতে বিবেকবান মানুষ যাতে এগিয়ে আসে সে জন্যই এই সেøাগান নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবে হিন্দির প্রতি অবুঝ শিশুরা উৎসাহী হলে এক সময় হিন্দির আগ্রাসনে বাংলা হারিয়ে যাবে।
ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর ‘উর্দুই হবে রাষ্ট্র ভাষা’ ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এ বক্তব্যের প্রতিবাদে ‘না না মানি না’ যে সেøাগান উঠেছিল। ছাত্র-তরুণদের মধ্যে যে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ আওয়াজ উঠেছিল; যার চূড়ান্ত পরিণতি ’৫২ ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারী এক সাগর রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা। ‘সাংস্কৃতি আগ্রাসন রুখে দাঁড়াও-হিন্দি হটাও বাংলা বাঁচাও’ যে সেøাগান উঠেছে এটাই হোক বাংলাদেশের মানুষের আজকের আওয়াজ। বহু ভাষাভাষির মানুষের বসবাসের দেশ ভারতের ঐক্যের সূত্র হিন্দি; কিন্তু বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য নয়। বিজাতীয় এই আগ্রাসন রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে চরম মূল্য দিতে হবে আমাদের। কারণ সাংস্কৃতির আগ্রাসনের বদৌলতে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেভাবে হিন্দির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তা রোধ করা কঠিন হবে। অতএব, এবারের একুশের সেøাগান হোক হটাও হিন্দি বাঁচাও বাংলা।



 

Show all comments
  • Nilu Ahmed ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৯:৩০ এএম says : 0
    চেতনা ব্যবসায়ীরা নীরব কেন ?
    Total Reply(0) Reply
  • Arif ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:৪৩ পিএম says : 0
    nice writing
    Total Reply(0) Reply
  • Laboni ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:৪৪ পিএম says : 0
    i agree with u
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হিন্দি হটাও বাংলা বাঁচাও

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ