Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিশোর অপরাধ ও তার প্রতিকার

| প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব : কিশোর অপরাধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। সকল সমাজেই রয়েছে এর অনিবার্য উপস্থিতি। তবে প্রকৃতি ও মাত্রাগত দিক থেকে তা বিচিত্র। সারাবিশে^ ক্রমবর্ধমানহারে কিশোর অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যেই মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসাবে পরিণত হতে পারে। যা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুস্থ দেশ, জাতি ও শান্তিময় বিশ^ গঠনের লক্ষ্যে ও প্রবন্ধে কিশোর অপরাধের অনুসন্ধান করে প্রতিকারের উপায় তুলে ধরছি। শিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের উন্নত ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি। শিশু-কিশোররাই দেশ ও দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি। শিশু-কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের একটি অংশ কোন কারণে অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চর হুমকি ও সুস্থ সমাজ জীবনের প্রতিবন্ধক হোক তা কারো কাম্য নয়।
কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির সংজ্ঞায়নে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিশোর বয়সে অবাঞ্ছিত ও সমাজ বিরোধী আচরণ সম্পাদন করাকেই বলা হয় কিশোর অপরাধ। মার্কিন অপরাধ বিজ্ঞানী ঈধাধহ বলেন, সমাজ কর্তৃক অনাঙ্খত আচরণ প্রদর্শনে কিশোরদের ব্যর্থতাই কিশোর অপরাধ। আইনগত দিক থেকে কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক আইন বিরুদ্ধ দ-নীয় কর্ম সম্পাদন করাকেই বুঝায়। এ প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের কিশোর অপরাধের নির্ধারিত সংজ্ঞাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। সংজ্ঞায় বলা হয়, ঔাঁরহরষব উবষরহয়ঁবহপু ঝযড়ঁষফ নব ঁহফবৎংঃড়ড়ফ ঃযব পড়সসরংংরড়হ ড়ভ ধহ ধপঃ যিরপয রং পড়সসরঃঃবফ নু ধহ ধফঁষঃ, ড়িঁষফ নব পড়হংরফবৎবফ ধ পৎরসব .
কিশোর অপরাধ বলতে কমিশন সে কাজকে বুঝায়, যে কাজ একজন বয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে কিশোর অপরাধের পরিচয়ে বলা যায় যে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক সংঘটিত দেশীয় আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কর্মকা-কেই কিশোর অপরাধ বলে। কৈশোরকাল মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ স্তর শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক মানব সন্তানের ওপর বিভিন্ন শর’ঈ বিধি-বিধান ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব আরোপিত হয়। এর আগ পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীরা গায়রু মুকাল্লাফ বা বিধি-বিধান পালনের বাধ্যবাধকতামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। কেননা হাদিসে তিন ব্যক্তিকে শরী’আতের বিধান পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তিন ব্যক্তি যাবতীয় দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছে; ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হয়, অপ্রাপ্ত বয়স্ক যতক্ষণ না বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন হয়। শাস্তি প্রদান করার নিদের্শনা ইসলামী আইনে বিদ্যমান রয়েছে।’ যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছরে পদার্পণ করলে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিবে। দশ বছর বয়সের পর সালাত আদায় না করলে তাদেরকে প্রহার করবে এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দিবে।’
এ প্রসঙ্গে ড. আব্দুল আযীয আমির এর অভিমতটি উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর মতে, একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু-কিশোর ব্যভিচার চুরি অথবা ডাকাতির মতো অপরাধ করলে সামাজিকভাবে তাকে অপরাধী বলে গণ্যই করা হবে না-এমনটি মনে করা ঠিক নয়। কেননা তা হবে আইনের অপব্যাখ্যা মাত্র। বরং উত্তম হলো যে, প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির অপরাধের ন্যায় শিশু-কিশোরদের ওপর সুনির্দিষ্ট শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ করে অথবা সুনির্দিষ্ট তা’যীরী অপরাধসমূহের মধ্যে কোন একটি অপরাধ সংঘটন করে তাহলে তার অপরাধের মাত্রা বয়সের উপযুক্ততা বিচার করে সংশোধনমূলক কোন শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে ইসলামী আইনে কোন বাধা-নিষেধ নেই। অতএব, ইসলামের দৃষ্টিতে কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক শরী’আতের এমন আদেশ নিষেধের লঙ্ঘনকে বুঝায়, যা করলে তা’যীর প্রযোজ্য হয়।
কিশোর অপরাধের সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন বিষয়। তথাপিও অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস চালিয়েছেন। যা অপরাধের নানাবিধ সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ধারণা লাভে সহায়ক। কিশোর অপরাধের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবী অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বর্তমানের ধর্মহীনতাই অন্যান্য অপরাধের ন্যায় কিশোর অপরাধের কারণ। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের জনক কার্লমার্কস এর মতে, কিশোর অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রভাব। আধুনিক অপরাধবিজ্ঞানের জনক সিজার লোমব্রোসো কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে জৈবিক প্রভাবকে দায়ী করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী হিলি এবং ব্রোনোর কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে সামাজিক পরিবেশের প্রভাবকে চিহ্নিত করেছেন। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানে বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তে মানুষের মনোজগতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বংশগতি বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জৈবিক বৈশিষ্ট্য কিশোর অপরাধের অন্যতম একটি কারণ। শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে যে দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য লাভ করে সেটিই তার বংশগতি জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ব্যক্তির মন-মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-ব্যবহার, চিন্তাধারা, প্রভৃতি বিষয়। বংশগতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তারা স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তারা স্বাভাবিক আচরণ। অপরাধমূলক কর্মে জড়িয়ে পড়ে। জন্মগত শারীরিক ও মানসিক ত্রুটিগুলো যেমন মাথার খুলি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট বা বড়, গাঢ় ও ঘন ভ্রু, চেপ্টা নাক, প্রশস্ত হাতের তালু, প্রশস্ত কান, ঘন চুল, লম্বা বাহু, চোখ বসা, হাত-পায়ে অতিরিক্ত আঙ্গুল, সংকীর্ণ কপাল, অসামঞ্জস্য দাঁত, আত্ম-নিয়ন্ত্রণহীন, অলস প্রকৃতি ও বেদনার প্রতি অতি সংবেদনশীল ইত্যাদি। উপর্যুক্ত ত্রুটিগুলো থেকে পাঁচটি ত্রুটি শিশু-কিশোরের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে অপরাধকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. হিলি শিকাগো শহরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কিশোর অপরাধীদের ৩১% এর দৈহিক বিকাশ অস্বাভাবিক। এছাড়াও ইতালিতে সাম্প্রতিক গাবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, দৈহিক অক্ষমতা দূর করা গেলে কিশোরদের অপরাধমূলক আচরণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
কিশোর অপরাধ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সব সময় পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি। পরিবারের সূচনা হয় স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে আর পারিবারিক পরিম-লে সন্তানের জন্ম হয় এবং বিকাশ লাভ করে। সন্তানের স্বাভাবিক ও সুস্থ বিকাশের জন্য পিতামাতার মধ্যে সম্প্রীতিময় দাম্পত্য জীবন একান্ত অপরিহার্য। পিতা-মাতার মধ্যে মনোমালিন্য ও কলহ বিবাদ থাকলে সন্তানের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা পরিণামে শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে কিশোর অপরাধের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। দরিদ্র ও সম্পদের প্রাচুর্য উভয়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে কিশোর অপরাধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দরিদ্রতার কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে কিশোররা বিভিন্ন প্রকারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিশোর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পারিপাশির্^ক সামাজিক পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। বিধায় আবাসিক পরিবেশ, সঙ্গীদের প্রভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি সামাজিক উপাদানগুলো শিশু-কিশোরদের আচরণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। শিশু-কিশোরদের নৈতিক ও সামাজিক আচরণের ওপর আবাসিক পরিবেশের প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এজন্যই বাসস্থানের অনুপযুক্ত পরিবেশ (যেমন : ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকা) কিশোর-কিশোরীদের অপরাধমূলক কর্মকা-ে ধাবিত করতে পারে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ওপর পরিচালিত গবেষণামূলক জরিপে প্রতীয়মান হয় যে, বস্তি এলাকার লোকজন সাধারণত অস্থায়ী বাসিন্দা হয় এবং তারা ঘন ঘন বাসস্থান পরিবর্তন করে। তাদের পরস্পরর মধ্যে সামাজিক সংযোগ ও সংহতি থাকে না। এরূপ পরিবেশে শিশুরা ঘরের বাইরে অবাধে অপরাধমূলক আচরণে লিপ্ত হয়।
কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সঙ্গদলের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং পাড়া-প্রতিবেশী, খেলার সাথী সমবয়সীদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এ ধরনের সম্পর্কের মাধ্যমে শিশু-কিশোররা অত্যন্ত সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে, যা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা পরিবার-পরিজনের নিকট থেকে তা করতে পারে না। সামাজিক পরিবেশ পরিবারের ভূমিকার পরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাব শিশু-কিশোরদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজেও সকল প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যেমন শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান, সততা, আন্তরিকতা, ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, ছাত্রছাত্রীর নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চেতনা কার্যত অনুপস্থিত। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য গঠনমূলক চিত্তবিনোদন, খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবও প্রকট।
বর্তমানে জটিল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পেশা গ্রহণে ব্যর্থ কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারার কারণে সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়। ফলে তাদের মনে তীব্র হতাশা ও নৈরাশ্য দানা বাঁধে, যা এক পর্যায়ে সমাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও আক্রোশ রূপ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে এই ব্যর্থ কিশোর-কিশোরীরা সামাজিক আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এবং অপরাধমূলক আচার-আচরণে লিপ্ত হয়। অপরাধ বিজ্ঞানী ডেক্সটারের মতানুযায়ী, বায়ুর চাপের সাথে মানুষের ¯œায়ুবিক চাপ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত এবং তার ফলে ব্যারোমিটারে পারদের ওঠা-নামার সাথে অপাধ প্রবণতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
পিতা-মাতার ঘন ঘন কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে শিশু-কিশোররা নতুন নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সংস্পর্শে এসে সহজেই তা অনুসরণ করতে পারে না এবং তাদের ব্যক্তিত্ব অসম্পূর্ণভাবে বেড়ে উঠে। ফলে এটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার জন্ম দেয়। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই উক্ত গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
কিশোর অপরাধ প্রতিকারে ইসলামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যম-িত। সঠিক পন্থার শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ না হওয়ার কারণেই মূলত কিশোর অপরাধ সংঘটিত হয়। এছাড়াও যেসব কারণে এই ব্যাধির সৃষ্টি হয়, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কিশোর অপরাধ প্রতিকার করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ইসলাম সর্বজন স্বীকৃত প্রতিরোধমূলক ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে তা প্রতিকার করেছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় ইসলাম বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। আর সংশোধনমূলক ব্যবস্থায় নিয়েছে বাস্তবসম্মত নানা পদক্ষেপ।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে বুঝায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে যাতে প্রথম থেকেই অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি না হয়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করা। যেসব কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলোকে আগে থেকে দূর করাই এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো পরিবার। জন্মের পর শিশু পারিবারিক পরিবেশ মাতা-পিতার সংস্পর্শে আসে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এ জন্যই ইসলাম শৈশবকাল থেকে ঈমানের শিক্ষা, ইবাদতের অনুশীলন, ইসলামের যথার্থ জ্ঞানার্জন ও নৈতিকতা উন্নয়নের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে পরিবারের উপরে। যাতে করে আগামীদিনের ভবিষ্যৎ শিশু-কিশোররা অপরাধমুক্ত থাকতে পারে। আল্লাহতায়ালা মুমিনদেরকে এবং তাদের পরিজনদের অপরাধমুক্ত জীবনযাপন করার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, “হে বিশ^াসীগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।” অতএব বলা যায় যে, কিশোর-কিশোরীর আচরণ ও ব্যক্তিত্বের উন্নয়নে পরিবার সর্বাধিক অনুকূল পরিবেশ জোগায়। বিশেষ করে এক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকা অপরিসীম। কেননা তারাই শিশু-কিশোরের সামনে বহির্বিশে^ বাতায়ন প্রথম উন্মুক্ত করে দেয় এবং সন্তানদের অনুপম চরিত্র গঠনের কার্যকর অবদান রাখতে পারেন। এভাবে অভিভাবকগণ পর্যায়ক্রমে সন্তানদের সামনে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো যেমন আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং আখিরাতের প্রতিটি পর্যায় যেমন কবর, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের পরিচয় অত্যন্ত সুন্দর ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরে সেগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ^াস স্থাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবেন। ফলে সন্তানের ঈমান হবে সুদৃঢ়। তার ঈমান দৃঢ় ও শিরকমুক্ত হলে নৈতিক গুণাবলী অর্জন তার জন্য অত্যন্ত সহজ হবে। মাতা-পিতা সন্তানকে ঈমানের শিক্ষা প্রধা পর ইসলামের যথার্থ জ্ঞান দান করবে এবং তাদের অনুসন্ধিৎসাকে জাগিয়ে তুলবেন। যাতে করে তারা অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা ভালো-মন্দের, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করতে পারে এবং নিজেদেরকে বিরত রাখতে পারে অপরাধকর্ম থেকে। বিশ^বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহ.) চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘চরিত্র হলো মানব মনে প্রোথিত এমন অবস্থা, যা থেকে কোন কর্মচিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অনায়াসে প্রকাশিত হয়।’ আর মানুষের আচার-আচরণ ও কাজ-কর্ম সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আদর্শের শৈশবকাল থেকেই মূলত নৈতিকতা বিকশিত হওয়া শুরু হয় এবং কৈশোরকালের শেষ পর্যায়ে গিয়ে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। শিশু-কিশোরের নৈতিকতা উন্নয়নে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। মা-বাবা নৈতিকতা মেনে চলতে শিখবে।
পিতা-মাতা সন্তানদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার শিক্ষা দেবেন যেমন : খাবার, পানাহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও গ্রহে প্রবেশের শিষ্টাচারসহ যাবতীয় আদব। যা তাদের নৈতিক মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। শিশু-কিশোররা যে সমাজে বসবাস করে সে সমাজেরও রয়েছে অসংখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। সমাজে যদি অন্যায়-অনাচার অবাধে চলতে থাকে, তাহলে শিশু-কিশোররা তা অনুসরণ করে অপরাধ প্রবণ হতে পারে। ফলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ প্রতিরোধ করতে হলে কেবলমাত্র শিশু সমাজকে উন্নত করলেই চলবে না, বরং সমগ্র সমাজের উন্নয়ন করতে হবে। সমাজের নৈতিক আদর্শ, পারস্পরিক আচরণ, কর্তব্যপরায়ণতা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
য় লেখক : প্রাবন্ধিক ও সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ