পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টাফ রিপোর্টার : ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ত্যাগ করে জনগণের কাতারে যাওয়ার চেষ্টা করছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতার বলয় থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেই সিদ্ধান্তে অটল আছি। মরার আগ পর্যন্ত অটল থাকব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূতের পদ থেকে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি সারা দেশ ঘুরবো মানুষের কাছে যাব’। রংপুরে তিনি বলেছেন, দলকে দালাল হিসেবে পরিচিত করতে চাই না। দলকে ‘প্রকৃত রাজনৈতিক দল’ এবং ‘প্রকৃত বিরোধী দল’ হিসেবে গড়ে তুলতে ভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করেছেন। এ ঘটনার পর তার স্ত্রী জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে দলের ভাঙনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন মহাসচিব পদহারানো জিয়াউদ্দিন বাবলু। কিন্তু সংসদীয় দলের বৈঠকের পর মনে হচ্ছে ভাঙনের হাত থেকে এ যাত্রায় শেষ রক্ষা পাচ্ছে জাতীয় পার্টি। আনিস-বাবলু পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সংসদীয় কমিটি এরশাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, স্যার (এরশাদ) ও ম্যাডাম (রওশন এরশাদ) বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে দলের অর্ধশত নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা দারুণ খুশি। তাদের ভাষায় তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও কয়েকজন এমপি ছাড়া রওশন এরশাদের সঙ্গে কোনো নেতাকর্মী নেই, থাকবেও না। আর রওশনকে ফাঁদে ফেলে তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা দেয়া হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
রংপুর থেকে গতকাল দুপুরে বিমানে ঢাকায় ফিরে সোজা বনানীস্থ কার্যালয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন এইচএম এরশাদ। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মহাসচিবের পদ থেকে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে অব্যাহতি দিয়ে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে ফের মহাসচিব ঘোষণা করেন। তিনি ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিব মনোনীত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য রওশন এরশাদ দলের আওয়ামী লীগপন্থী নেতাদের নিয়ে সংসদ ভবনে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে প্রথমে এরশাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন একাধিক নেতা। কিন্তু এরশাদ সেখানে উপস্থিত হওয়ায় পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বৈঠকে এরশাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হন অন্যান্য নেতারা। জানা যায়, দুপুরে এরশাদ সংবাদ সম্মেলন করে দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে বাদ দিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেন। তার এই সিদ্ধান্ত দলের সংসদীয় দল প্রত্যাখ্যান করে বলে জানান চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। সাংবাদিকদের কাছে তিনি দাবি করেন এরশাদের দু’টি সিদ্ধান্ত সংসদীয় কমিটি মেনে নেয়নি।
সংসদ ভবনে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের সভাপতিত্বে সংসদীয় দলের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর সোয়া ৩টায় বৈঠক শুরু হওয়ার ১৫ মিনিট পর বৈঠকে যোগ দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি নিজেও বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। বৈঠকে সিনিয়র এক নেতারা এরশাদের কাছে জানতে চান কেন জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান আর রুহুল আমিন হাওলাদারকে কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব করা হল। আর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে কেন সরিয়ে হাওলাদারকে মহাসচিব করা হলো? এ সময় এরশাদ জানান তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাই হবে। দলের গঠনতন্ত্র তাই বলে। এরশাদ উপস্থিত হওয়ায় অন্যান্যরা ‘বিদ্রোহী’ ভাব থেকে ‘নরম’ হয়ে যান। অতপর উপস্থিতি বেশিরভাগ সদস্য এরশাদের বিপক্ষে গিয়ে সুবিধা করা যাবে না বলে মত দেন। তবে বৈঠকের মাঝপথে এরশাদ বেড়িয়ে যাওয়ার সময় রুহুল আমিন হাওলাদার তাজুল ইসলাম চৌধুরী তাকে অনুসরণ করেন। জানা যায়, রওশন এরশাদ আওয়ামী লীগপন্থী নেতাদের এরশাদ ও জিএম কাদেরের ঢাকা ফেরা পর্যন্ত ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ঘোষণা’ দেয়া থেকে বিরতে থেকে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন সে খবর এরশাদ আগেই পেয়ে যান। তাই স্ত্রী রওশনের প্রতি এরশাদের তেমন ক্ষোভ দেখা যানি। তবে এরশাদ বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ বলেন, আপনি জাতীয় পার্টিকে তছনছ করছেন। এভাবে একটি দল চলতে পারে না। আশা করি আপনি তা বুঝবেন। এরশাদ বেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রায় ৪০ মিনিট বৈঠক চলে। বৈঠকে এরশাদের সব সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বক্তব্য দেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। পরে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, সংসদীয় বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনের জন্য সংসদীয় দলের নেতা রওশন এরশাদকে যৌথসভা ডাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু আনিসের সঙ্গে জিয়াউদ্দিন বাবলু ছাড়া কেউ নেই বলে সূত্রের দাবি।
সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে সংসদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সংসদের গেটে সাংবাদিকদের কাছে এরশাদ নিজের সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। এ সময় তার পাশে ছিলেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, এর আগে তিনি এরশাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘স্যারের (এরশাদ) সঙ্গে সংসদীয় দল একমত হয় নাই। স্যার ও ম্যাডাম (রওশন এরশাদ) পরবর্তীতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।’ অথচ এক ঘণ্টা আগে তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, উল্টো কথা বলেছেন। তিনি এরশাদের সিদ্ধান্ত সংসদীয় কমিটির প্রত্যাখ্যানের তথ্য দেন। তবে এরশাদের উপস্থিতিতে তাজুল বলেন, ‘তাদের এই অবস্থানের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত এইচ এম এরশাদও নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছেন। দলের চেয়ারম্যান বলেছেন, জাপা ও সংসদীয় দল আলোচনা করে মহাসচিব বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে।
এর আগে বনানীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘রওশন এরশাদের সঙ্গে বিরোধ নেই’ দাবি করে এইচ এম এরশাদ এরশাদ বলেন, ‘আমার স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। তিনি সংসদ চালাবেন, আমি পার্টি চালাব। আমাদের মধ্যে বিভেদের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের কোনো বিরোধ নেই’। স্ত্রীর প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রী প্রেসিডিয়ামের কোনো বৈঠক ডাকেননি। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উনাকে দিয়ে তারা (আনিস-বাবলু) স্টেটমেন্ট দেয়ার চেষ্টা করেছিল। উনি স্টেটমেন্ট দেননি। এ পার্টিকে কেউ বিভক্ত করতে পারবে না।’ জিয়াউদ্দিন বাবলুকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি হাওলাদারকে সরিয়ে বাবলুকে মহাসচিব করেছিলাম। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বাবলু ২ বছরে একদিনও দলের বর্ধিত ও প্রেসিডিয়ামের সভা ডাকতে পারেনি। তিনি হঠাৎ করে পার্টির প্রেসিডিয়াম ও বর্ধিত সভা ডাকতে পারেন না। আমার ঘোষণার পর তিনি পার্টিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। তাকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো।’
জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এইচ এম এরশাদ দলকে গণমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সে লক্ষ্যে নিজেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পাশাপাশি মানুষ যাতে দলকে নিয়ে ‘ঠাট্টা তামাসা’ করতে না পারে সে জন্য প্রকৃতবিরোধী দল এবং গণমানুষের সংগঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ছোটভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দেন এবং নিযুক্ত করেন। এরশাদের এ সিদ্ধান্তে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা দরুণ খুশি হলেও আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতারা নাখোশ হন। তারা সরকারের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খেতে চান। এ জন্য এরশাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোমবার রাতে পাল্টা কমিটি করেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সিনিয়র সদস্য রওশন এরশাদপন্থীরা। রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম কয়েকজন সদস্য ও সংসদীয় দলের একাংশের যৌথ সভায় রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায় রওশন এরশাদ নিজেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণার বিষয়ে আপত্তি তোলেন। তিনি সকলকে শান্ত থেকে এরশাদ ও জিএম কাদেরের ঢাকা ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করার অনুরোধ করেন। কিন্তু উপস্থিত এমপি ও মন্ত্রীরা তাকে ‘এখনোই’ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার ঘোষণা দেয়ার জন্য চাপ দেন। অতঃপর বৈঠক শেষে লিখিত বক্তব্যে গণমাধ্যমকে জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু জানান বেগম রওশন এরশাদ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। এ ঘটনায় কার্যত ভেঙ্গে যায় জাতীয় পার্টি। তবে ভাঙনের এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এরশাদ বলেন, অসম্ভব জাপা ‘ভাগ’ হবে না। আমি জাপার চেয়ারম্যান। যারা এর আগে চলে গেছে, তাদের সঙ্গে ৮-১০ জন লোকও যায়নি। যে দু’জন (ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু) দলে বিভ্রান্তির চেষ্টা করছেন, তাদের সঙ্গেও কেউ নেই। আজকের ঘটনায় জাপায় নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, জি এম কাদের পার্টির কো-চেয়ারম্যান। আমি তাকে যেটুকু দায়িত্ব দেব তিনি ততোটুকুই পালন করবেন। আর হাওলাদার এর আগেও তিনটি কাউন্সিল সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই তাকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব নির্বাচিত করা হয়েছে।
আক্ষেপ করে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, সর্বশেষ কাউন্সিলে কাজী জাফরকে চেয়ারম্যান ও হাওলাদারকে সদস্য সচিব করেছিলাম। এর আগে ব্যারিস্টার আনিসকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছিলাম, হাওলাদারকে সরিয়ে দিয়েছিলাম, তখন তো গঠনতন্ত্রের কথা বরা হয়নি। এখন কেন বলা হচ্ছে। আমি পার্টির চেয়ারম্যান, আমার ক্ষমতা রয়েছে। আমি ৩৯ ধারা মোতাবেক যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি। পরে সেটা প্রেসিডিয়ামে পাস করিয়ে নিব। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ ছাড়ার বিষয়ে এরশাদ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মান করেন। আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমি উনাকে (প্রধানমন্ত্রী) বলব, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি সারাদেশ ঘুরে বেড়াব, পার্টিকে শক্তিশালী করব। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব।’ সংবাদ সম্মেলনে এরশাদের বাম পাশে ছিলেন জি এম কাদের। ডান পাশে ছিলেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, ভাইস চেয়ারম্যান এটিমে গোলাম মাওলা চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব রুরুল ইসলাম নুরুসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অর্ধশত নেতা। এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেন, এরশাদ দলের চেয়ারম্যান। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ, বেগম জিয়া ছাড়া বিএনপি ও এরশাদ ছাড়া জাতীয় পার্টি কল্পনাই করা যায় না। গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারায় তাকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই বাস্তবতা।
আত্মপ্রকাশ ঃ দেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি নামে এখন মাঠে সক্রিয় রয়েছে পাঁচটি দল। এর মধ্যে চারটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধি। ’৯০-এর পট-পরিবর্তনের পর থেকে বেশ কয়েকবার ভাঙন ধরে দলে। এর মধ্যে চারটি ভাঙন ছিল বড় ধরনের। তারা এরশাদকে ছেড়ে গিয়ে একই নামে আবার দল করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দলটির আরও কিছু নেতা বিভিন্ন সময় ক্ষমতার উচ্ছিষ্টের লোভে দলছুট হয়ে সরকারী দলে যোগদান করেছেন। একাধিকবার ছোট ছোট ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। এমনকি ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রওশন এরশাদ নিজেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়ে এরশাদের বাইরে দল গঠন করে বেগম জিয়ার আশীর্বাদ নিয়ে ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেন। যদিও ওয়ান ইলেভেনের কারণে ওই নির্বাচন বন্ধ হযে যায়। বড় ভাঙনগুলো হয়েছিল মূলত বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে। কখনো আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আবার কখনো ভেঙেছে মন্ত্রী হওয়া নিয়ে। সরকারের লেজুড়বুত্তি ইস্যুতে এখন এইচ এম এরশাদ ও তার স্ত্রী সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশনের দ্বন্দ্বে পার্টি আবার ভেঙে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে জাতীয় পার্টিতে এরশাদ ও রওশনকে কেন্দ্র করে দলে দু’টি বলয় তৈরি হয়। সে দুটি বলয় এখন প্রকাশ্য দুই শিবিরে বিভক্ত। রংপুরে গিয়ে এরশাদ তার ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এর একদিনের মাথায় গত সোমবার রওশনপন্থীরা এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন।
ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মাথায় এইচ এম এরশাদ ১৯৮৪ সালে প্রথমে ‘জনদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন করেন। ’৮৫ সালের প্রথম দিকে এরশাদ দুটি প্রধানবিরোধী জোটে (আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন) ভাঙন ধরাতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মুন্সিগঞ্জের কোরবান আলী ও বিএনপির মানিকগঞ্জের আবদুল হালিম চৌধুরীকে তিনি মন্ত্রিত্ব দেন। পনেরো দলীয় জোটের শরিক দল মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একাংশ, পাঁচদলীয় জোটের শরিক ইউপিপির কাজী জাফর আহমেদ ও সিরাজুল হোসেন খানের গণতন্ত্রী দল জোট ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়। বিএনপির একটি অংশের নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ডা. এম এ মতিন এবং আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইল ও ডিএলের সাধারণ সম্পাদক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এরশাদের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। এ ছাড়া জাসদের জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মতো কিছু নেতা, মুসলিম লীগের একাংশের নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, প্রখ্যাত সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ, দলবিহীন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে এরশাদ তার জনদল, বিএনপির একাংশ, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি এবং মুসলিম লীগের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ফ্রন্ট। একপর্যায়ে কাজী জাফর স্বেচ্ছায় ইউপিপি ভেঙে দিয়ে এরশাদের দলে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘সরকারী রাজনৈতিক দল’ জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নতুন এ দল গঠনের সকল প্রক্রিয়ায় অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করেন প্রবীণ রাজনীতিক এডভোকেট মাহবুবুর রহমান। মসনদের পৃষ্ঠপোষকতায় নবগঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন এইচ এম এরশাদ এবং মহাসচিব নিযুক্ত হন সিরাজগঞ্জের ডা. এম এ মতিন।
ভাঙন কাহিনী : এরশাদের জাতীয় পার্টিতে প্রথম বড় ধরনের ভাঙন ধরে এরশাদের কারাগারে থাকার সময়। ’৯১ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী দল পুনর্গঠন করার পর শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. এম এ মতিন বের হয়ে গিয়ে পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন। কয়েক বছর পর তারা আবার দলে ফিরে এলেও শামসুল হুদা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। কারাগারে থেকেই এরশাদ ’৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে ৫টি করে আসনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়েন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও সরকার গঠনের অবস্থা ছিল না। কারাবন্দী এরশাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে করা হয় মন্ত্রী। কারামুক্তির কিছুদিন পর এরশাদ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় জোটে চলে যায়। সেসময়ের মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। চর দলীয় জোটে মতের অমিল হওয়ায় এরশাদ জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাবজ্জীবন কারাদ- মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন ভারতে থেকে দেশে ফিরে এসে নাজিউর রহমান মঞ্জু হন অতিরিক্ত মহাসচিব। অতঃপর তিনি জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে যায়। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। এই অংশটির ভেতরও আরেকটি ভাঙন আসে। মন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলার একপর্যায়ে ডা. এম এ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। আর কাজী ফিরোজ রশিদ কিংপার্টি খ্যাত ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপি হয়ে পুনরায় এরশাদের কাছে ফিরে যান। এক এগারোর সময় বিএনপির প্ররোচণায় বেগম রওশন এরশাদ নিজের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তার মহাসচিব ছিলেন গোলাম মসিহ। আর এরশাদ নিজেও চাপের মুখে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে কিছুদিন ঝামেলামুক্ত থাকেন। সর্বশেষ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরান তার পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া নিয়ে এরশাদের সঙ্গে কাজী জাফরের মতভেদ ঘটে। কাজী জাফর গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন আন্দোলনরত বিএনপি জোটে। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে দলের বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন জাতীয় পার্টির ঘোষণা দেন কাজী জাফর।
নানা শ্রোত ঃ এরশাদের নেতৃত্বাধীন এই অংশটি মূল জাতীয় পার্টি হিসেবে পরিচিত। নির্বাচন কমিশনে এ দলটি নিবন্ধিত লাঙল প্রতীক নিয়ে। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) নিবন্ধিত বাই সাইকেল প্রতীক নিয়ে, নাজিউর রহমান মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নিবন্ধিত গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে। ডা. তাসমিনা মতিনের নামে কাঁঠাল প্রতীকে জাতীয় পার্টি (মতিন) নিবন্ধিত। আর ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে এরশাদের দলে আরেক দফা ভাঙন ধরিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি গঠন করেন কাজী জাফর আহমদ। সে দল ড. ফজলে রাব্বী চৌধুরী ও মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে বর্তমানে ২০ দলীয় জোটে রয়েছে।
দলের ভিতরে এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় টান টান উত্তেজনায় নেতাকর্মীরা। কখন কি ঘটনা ঘটে সেটা জানার জন্য মুখিয়ে থাকেন তারা। এরশাদকে স্বাগত জানানো কয়েকশ’ নেতা বিমানবন্দরে হাজির হন। এরশাদের সঙ্গেই তারা বনানীর অফিসে আসেন। দলের পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী বলেন, তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা এরশাদের সঙ্গেই আছে। কিছু সুবিধাভোগী অন্যত্র চলে গেলেও এরশাদের এ ঘোষণা সবাই খুশি। দেরিতে হলেও দল জনগণের কাতারে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জিএম কাদেরকে পাশে রেখে এরশাদ সারাদেশ ঘুড়লে লাঙ্গলের পক্ষ্যে সাড়া পড়ে যাবে। এ সিদ্ধান্তের জন্য এরশাদকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। সাবেক যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু বলেন, দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হয়ে যাচ্ছে এবং সরকারের দালালী করছে এ অভিযোগ তুলেই আমি পদত্যাগ করেছিলাম। এখন স্যার প্রকৃত চিত্র বুঝতে পেরে দলকে দালালমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমি ও আমার কর্মীরা উৎফুল্ল। এরশাদ ছাড়া জাতীয় পার্টি চিন্তা করাই যায় না। যারা হালুয়া রুটির জন্য ওখানে (রওশন) গেছেন তারা কিছুদিনের মধ্যে আবার ফিরে আসবেন। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সৈয়দ (কক্সবাজার) বলেন, চেয়ারম্যানের এ সিদ্ধান্তে দল গতিশীল হবে। মজা পুকুরের মতো এতোদিন জাতীয় পার্টি বন্দী ছিল। এরশাদের এ সিদ্ধান্তে দল ক্ষরশ্রোতের নদীতে পরিণত হবে। সাংগঠনিক সম্পাদক (সিরাজগঞ্জ) বলেন, দলের গতি বাড়বে। ক্ষমতার হালুয়া-রুটির জন্য যারা ওদিকে গেছেন তারা বুঝতে পারছেন না এরশাদের অপর নাম জাতীয় পার্টি। পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, তেমনি এরশাদের নাম ছাড়া জাতীয় পার্টি টিকবে না। যারা এরশাদকে ছেড়ে গেছেন তারা এক নেতা এক দলে পরিণত হয়েছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক (কক্সবাজার) মনোয়ার আলম বলেন, আমি অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিলাম জিয়াউদ্দিন বাবলু অপদার্থ। তাকে মহাসচিব পদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে কাঁন্দার লোকও পাবেন না। সেটাই এখন বাস্তবতা। চট্টগ্রাম নগরের সাংগঠনিক সম্পাদক খোকন চৌধুরী বলেন, আনিস বাবলুকে ছুঁড়ে ফেলায় চট্টগ্রামের মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। দলের নেতারা খুশি যে দল রাহুমুক্ত হয়েছে। দলের আরো কয়েজন নেতা জানান, তারা এরশাদের নির্দেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ক্যারিশমা করে জাপাকে নির্বাচন করিয়েছে। চিকিৎসার কথা বলে এরশাদকে সিএমএইচএ নেয়া হয়েছে। এসব ফিরিস্তি দিয়ে তারা বলেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলু দলকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনে পরিণত করে শুধু গণধিকৃত হননি; তারা কর্মী ধিকৃত। স্যার যদি সিদ্ধান্তে অটল থেকে সত্যিই জনগণের কাতারে যান, দলকে সুসংগঠিত করেন, দলকে ক্ষমতাসীন বিরোধী দলের হাসি ঠাট্টার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন তাহলে স্যার (এরশাদ) এবং জাতীয় পার্টি কলঙ্কমুক্ত হবে। কারণ ওই পাতানো নির্বাচন মানুষ মেনে নেয়নি। ৫ জানুয়ারী জনমত উপেক্ষা করে ভোটে যাওয়ায় জনগণ দল থেকে দূরে সরে গেছে। উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেছে। সত্যিকার অর্থে গণমানুষের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গেলে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।