মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
মো. আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায় : গেল ১০ জানুয়ারি ২০১৭ রোজ মঙ্গলবার, দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকগুলোতে প্রথম পৃষ্ঠায় হেড লাইন হিসেবে দুইটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। দৈনিকগুলোর সংবাদ প্রকাশনার মধ্যে পার্থক্য ছিল মাত্র ডান-বামে পরিবেশনায়। দেশপ্রেমিক সাংবাদিকবৃন্দ খবর ২টি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার দায়িত্ব পালন করেছে।
সংবাদ ২টি দেশ ও জাতিকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। একটি হলো পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলোকিত, স্বপ্ন, দিক-নির্দেশনা অন্যটি হলো হতাশা আমাবশ্যার চাঁদের মতো ঘোর অন্ধকার। দেশ ও জাতির কর্ণধার, পরিকল্পনাবিদরা ২টি সংবাদকে একটি টেবিলে রেখে আলোচনা পর্যালোচনা বিশ্লেষণ গবেষণা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করলে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিবে।
সংবাদের প্রথমটি হলো উন্নয়ন মেলা। এতে সচেতন নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আমি দেশকে এগিয়ে নিতে দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতা চাই’। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এ মেলা দেশের ৬৪টি জেলা ও ৪৯০টি উপজেলায় একযোগে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে মেলার উদ্বোধন ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সব জেলা উপজেলায় বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা মেলার উদ্বোধন করেন। ভিডিও কনফারেন্সে সরাসরি যুক্ত ছিল টাঙ্গাইল, বরিশাল, খুলনা ও গোপালগঞ্জ জেলা। মেলার উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী এসব জেলার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়। মেলার মূল উদ্দেশ্য চলমান উন্নয়ন ও সাফল্য জনগণের সামনে তুলে ধরে সরকারের উন্নয়নকাজের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করা। পাশাপাশি সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে সরকারের সাফল্য প্রচার ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
‘উন্নয়নের গণতন্ত্র শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত উন্নয়ন মেলা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কী কী কাজ করছি, জনগণের তা জানা উচিত। পাশাপাশি জনগণকে এতে সম্পৃক্ত হতে হবে। কারণ, জনগণের জন্য আমরা কাজ করছি ও তাদের সঙ্গে নিয়েই পথ চলতে চাই।’
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সর্বস্তরে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আছেন। সংসদ সদস্য থেকে ইউনিয়ন পরিষদ ও ওয়ার্ড মেম্বার, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, প্রশাসনে যুক্ত ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সবার সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে এই বাংলাদেশকে আমরা অতি দ্রুত দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারব।’ প্রত্যেক মানুষ একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন। তার ভেতরেও আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে।’ এ ধরনের উদ্যোগ দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন তরান্বিত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
দ্বিতীয় গুরুত্বের সাংবাদটি হলো উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। নবগঠিত সংস্থা সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দুটি চিত্র উঠে এসেছে, যাকে খুবই অস্বস্তিকর বলে মনে করেছেন বিশ্লেষকেরা। এ দুটি হলো দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ২৫ শতাংশ তরুণ নিস্ক্রিয়। তারা কর্মবাজারে নেই, শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। এদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। আরেকটি চিত্র হলো দেশের উচ্চ শিক্ষতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি।
সিডার ও বিআইডএস এর মাধ্যমে ৯ জানুয়ারি সেমিনারটি আয়োজন করে। এতে জানানো হয়, সিডার এখন থেকে নিয়মিত শ্রমবাজার পর্যালোচনা ও গবেষণা করবে। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের তরুণদের নিট নামের একটি সূচক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যার মানে হলো ‘নট ইন এমপ্লয়মেন্ট, এডুকেশন অর ট্রেনিং’। গত মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা তাদের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক সম্মেলনে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৪ বছয় বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। অবশ্য বাংলাদেশে মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার ছেলেদের চেয়ে কম। ছেলেদের ২৯ শতাংশ ও মেয়েদের ২২ শতাংশ শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণের বাইরে আছে।
শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে সেমিনারে জানানো হয় এসএসসি পাস করা ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার সাড়ে ৭ শতাংশ, এইচএসসি পাস ব্যক্তিদের মধ্যে এ হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। স্নাতক ও স্নাতক পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বেড়েছে। ২০১০ সাল উচ্চ শিক্ষিতদের মদ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে আলোচকেরা শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দেন। দেশের শিক্ষা খাত শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। শিল্প যে ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতার কর্মী খুঁজছে, তা মিলছে না। ফলে বিদেশ থেকে লোক এনে কাজ করাতে হচ্ছে। আমাদের তরুণরা যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছে, বেকারত্ব তত বাড়ছে। আগে বলা হতো পড়াশোনা করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। এখন তো তার উল্টা আর ভয়ঙ্কর। মানুষ চাকরি খুঁজে মরছে, আর শিল্পে লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এটা একটা কাঠামোগত সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কর্মকেন্দ্রিক ডিপ্লোমা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার।
এই চিত্র থেকে ফুঁটে উঠে আমাদের ডিপ্লোমা শিক্ষার বাস্তব চিত্র। দেশে ১০টি আঞ্চলিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাথে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অলিতে গলিতে অবস্থিত।
উপনিবেশিক আমলে গড়া ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী ৭টি প্রতিষ্ঠান যথা কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, আয়ুর্বেদীয় বোর্ড, হোমিওপ্যাথিক বোর্ড, নার্সিং কাউন্সিল, ফার্মেসি কাউন্সিল, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ, প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ভিত্তিক কর্মের হাতছানি দেওয়া ডিপ্লোমা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। চাকরি বাজারের চাহিদা পণ্য অনুসরণ করে করে নতুন নতুন বিষয়ে ডিপ্লোমা শিক্ষা কোর্স চালু, প্রতিষ্ঠিত ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আধুনিকায়ন করে নাগরিক সমাজের কাছে এই শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শুরু করেছে উন্নয়ন মেলা ২০১৭। এই মেলা সার্থক উচ্চ শিক্ষিতদের বেকারত্বের কলঙ্ক মোচন করতে হলে ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা শিক্ষা কার্যক্রম পৃথক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, খুলনা ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, সিলেট ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, বরিশাল ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, রংপুর ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, ময়মনসিংহ ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আর তা সম্ভব হলেই দেশের উন্নয়ন মেলা হবে স্বার্থক। প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষা বেকারত্ব মোচনের শিক্ষায় দেশের তরুণ যুব সমাজ সম্পৃক্ত হবে।
ষ লেখক : যথাক্রমে সভাপতি ও মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।