ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এম. কে. দোলন বিশ্বাস
বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ। এটি কৃষিনির্ভর দেশ হিবেসেও বিশ্বখ্যাত। এ দেশটি গ্রাম প্রধান। অন্তত ৬৮ হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত। এ দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি ৬০ ভাগ কৃষি কাজে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। যার ফলে এ দেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টরের নাম কৃষি।
বলা যায়, কৃষি খাতটি অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনাময় বাজারের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও বাংলাদেশের প্রবেশের বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি বিশ্ববাজারে প্রবেশের বড় সম্ভাবনাও বিদ্যমান। কৃষি এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিক্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে যেমন পারে তেমনি গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকাও রাখতে পারে।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি শিল্পের উন্নয়ন এবং এ খাতকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্য কৃষি খাতের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করেছে। তবে ২০০৮ সাল থেকে বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ তেমন বাড়েনি বরং মোট বাজেটে তা শতকরা হারে ক্রমাগত কমছে। জাতীয় বাজেটে মোট ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু কৃষি খাতে তা প্রতি বছর ক্রমাগতভাবে কমছে।
প্রাণিসম্পদ খাত : বৃহৎ অর্থে কৃষিতে শস্য, প্রাণিসম্পদ (গবাদিপশু, মৎস্য ও পোল্ট্রি) এবং বন খাত অন্তর্ভুক্ত। প্রাণিসম্পদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত গবাদিপশু, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, হাঁস-মুরগী ও মৎস্য। কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উপ-খাত হল ফসল যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৭২ ভাগ জোগান দেয়। মৎস্য, পশুসম্পদ এবং বন উপ-খাতের অংশ যথাক্রমে শতকরা ১০.৩৩, ১০.১১ এবং ১০.০০ ভাগ।
পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ : একটি কৃষিভিক্তিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং ফলমূল উৎপাদিত হয়। অধিকন্তু পোল্ট্রি, ডেইরি, মৎস্য ইত্যাদি উপ-খাত হিসেবে সাম্প্রতিককালে উদীয়মান এ সকল কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে রপ্তানিরও অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক শিল্পের মধ্যে রয়েছে পোল্ট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, মৎস্য হিমায়িতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। দেশের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী। জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রকল্প এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সমবায় পদ্ধতিতে চাষ : বাংলাদেশের কৃষি জমি খ--বিখ-িত এবং তা সাধারণত ছোট, যা সমবায় পদ্ধতিতে আবাদ করে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার জনপ্রিয়তার লাভ করছে। এর মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব।
চাহিদার যোগান : জাতির খাদ্য চাহিদার যোগান দেয়াই সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, সিডর, আইলা ইত্যাদির ফলে খাদ্য এবং অর্থকরী ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারও বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ। এসব কর্মসূচীর মধ্যে আরো রয়েছে উন্নত জাতের ফসলের জাত, বীজ ব্যবহার এবং বালাই দমন ইত্যাদি।
যদিও ধান এবং পাট আমাদের প্রাথমিক ফসল তবে গম, ভুট্টা এবং শাকসবজি ইত্যাদিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণের ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গম চাষীরা ভুট্টা উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ভুট্টা মূলত মাছ এবং পোল্ট্রি ফিড প্রস্তুতে ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চালে চা এর আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের উর্বর মাটি ও পর্যাপ্ত পানি থাকার কারণে অনেক এলাকাতেই ধানের আবাদ হচ্ছে বৎসরে তিন বার।
গৌণ ফসল : বাংলাদেশের গৌণ ফসল যেমন- ডাল, মসলা, ইক্ষু, ফলমূল, শাকসবজি এবং তামাক এর উৎপাদন আগেকার মতই থেকে যাবে বলে ধারণা করা যায়। এ সকল গৌণ ফসলের অবদান আমাদের ফসল উপ-খাতে প্রায় ৩০ ভাগ।
শস্য খাত : শস্যের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, গম, শাকসবজি, আখ, ডাল ফসল ইত্যাদি। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা, যেহেতু দেশটি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যশস্য, ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদন এবং এর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে চলছে। আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শিম, বিভিন্ন জাতের লাউ-কুমড়া, পালংশাক, মটরশুঁটি ইত্যাদিও উৎপাদিত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। পাশাপাশি ব্রকলি, গাজর, সেলারি, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরী ইত্যাদির উৎপাদনও হচ্ছে। কিন্তু কৃষি ব্যবসা জোরদারকরণে উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, প্রাকৃতিক গ্যাসের সহজলভ্যতা ছাড়া ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষিজাত পণ্য বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় দেশসমূহে রপ্তানি করতে হলে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। যাতে করে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এর ফলে কৃষকরাও কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের আয় এবং জীবনমান উন্নয়নে অনুপ্রাণিত হবে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাত উপ-খাত : এদেশের শিল্পখাতের মধ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প অন্যতম প্রধান এবং সম্ভাবনাময় খাত। যা কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজন ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প দেশের প্রস্তুতকৃত খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ২২ ভাগের চাইতেও বেশী এবং এই উপ-খাত ২০ ভাগ শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান করছে। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) সকল খাদ্য প্রক্রিয়াজাত এন্টারপ্রাইজের অবদান ২ ভাগ। দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প প্রকৃতিগতভাবেই আকার, প্রযুক্তি, পণ্যের গুণগতমান, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিপণন এবং বন্টনের ভিত্তিতে বহুমুখী। এই খাতে প্রাথমিকভবে মূলত ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পই বেশী এবং স্থানীয় উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণের সম্ভাবনা, মূল্য সংযোজন এবং রপ্তানীর সাথে সংযুক্ত। দেশে প্রায় ৭০০ প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য প্রস্তুতকারী শিল্প রয়েছে, যার মধ্যে গৃহে প্রস্তুতকৃত পণ্যও আছে এবং এর মধ্যে অন্তত ৩০টি শিল্প কারখানা। যার মধ্যে রয়েছে কনফেকশনারী, ফলমূল ও শাকসবজি, সিরিয়াল, ডেয়রী বা দুগ্ধজাত, কার্বনেটেড এবং নন কার্বনেটেড জুস, কোমল পানীয় এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে এখানে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিপুল অভ্যন্তরীণ বাজার। এই সম্ভাবনা বরং আরো বৃদ্ধি পাবে যদি আমাদের সীমানা সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলের জনগণের একই ধরনের খাদ্যভ্যাস এবং সংস্কৃতিকে বিবেচনায় রাখা হয়।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পক্ষেত্রে এখনো রয়েছে যথাযথ প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব। এই শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা যদি সহযোগিতা, অংশীদারিত্ব এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘ভড়ৎধিৎফ ধহফ নধপশধিৎফ লিংকেজ স্থাপন’ করা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং বিকল্প প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বহু ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের উৎপাদন লক্ষ্যণীয়। কেবলমাত্র নতুন পণ্যের উন্নয়নই নয় বরং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, গুণগতমানের উন্নয়ন, বায়োসেপ্টি এবং প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং সেই সাথে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিপণন জোরদার করার পাশাপাশি উৎপাদন পদ্ধতির উপরেও জোর দেয়া হয়েছে।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কৃষি উৎপাদনের উপরে বহুলাংশে নির্ভরশীল যেহেতু তার কাঁচামাল মূলত কৃষিজাত পণ্য। এ কারণে এই শিল্পকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ এর মোকাবেলা করতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা এবং মৌসুমভিত্তিক ফসল উৎপাদন। প্রতিবন্ধকতা থাকার সত্ত্বেও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের রয়েছে সর্বাধিক সম্ভবনা। এই সম্ভবনাকে সম্পূর্ণ রূপে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন ঝঁংঃধরহবফ ফসল উৎপাদন, মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশের বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং রপ্তানির ভিত্তিতে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে এসব থেকে পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ এবং এই সেক্টরের উন্নয়ন ঘটতে পারে।
সমীক্ষা ও গবেষণা : বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে- কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মনে করছেন আগামী ১২-১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা নিজেদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ফসলের জিন আবিষ্কার করবে যা দ্বারা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে একই সাথে মানুষের চাহিদা অনুসারে ফসলের গুণগত পরিবর্তন ঘটবে। জিন আবিষ্কারের অগ্রগতি আমাদেরকে আশাবাদী করে তুলেছে। পাটের জিন ও ফসলের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকের জিনম আবিষ্কার সেই অগ্রগতিরই চিহ্ন বহন করে। এরই ধারাবাহিকতা হতে লবণসহিষ্ণু জিন আবিষ্কার সম্ভব হলে শুধু বাংলাদেশের কৃষিতে নয়, ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বিশ্ব কৃষিতে।
বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ লবণাক্ত জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এ থেকে যে অতিরিক্ত ফসল ফলবে তার পুরোটাই বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে, যা থেকে দেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে এবং লবণসহিঞ্চু জিনের পেটেন্ট স্বত্ব নিয়ন্ত্রণ করে সমগ্র বিশ্বের কৃষিতে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে। লবণাক্ততা সহিঞ্চু উন্নত জাত রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক শষ্য ও বীজ দ্বারা বাজার দখল করা সম্ভব হবে। এভাবে অন্যান্য ফসলের জিন আবিষ্কার করে এবং তা যথপোযুক্ত ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে আমাদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন ফসলের পেটেন্ট স্বত্ব নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য আমাদের কৃষিতে প্রচুর পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে।
প্রতিটি কৃষক দেশের তৈরী বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের ফসল ও বীজ উৎপাদনের দক্ষতার পাশাপাশি খরচ কমাতে সক্ষম হবে। প্রতিটি কৃষকের হাতে নিজেদেও তৈরী উন্নত জাতের দেশী বীজ থাকবে ফলে বীজ বা প্রযুক্তির জন্য কারো উপর নির্ভর করতে হবে না। বাংলাদেশের কৃষিতে একক বা ক্ষুদ্র কৃষকের স্থলে যৌথ বা সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হওয়া বৃহৎ কৃষকের সৃষ্টি হবে। ফলে তারা যৌথভাবে একটি এলাকার কৃষির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে এবং যার অংশীদার হবে তারা নিজেরা। তারা নিজেরাই নিজেদের ফসলের বীজ, উন্নত জাতের মাছের বীজ ও মাছ উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রি করতে পারবে। তাদের নিজেদের আয় হতে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা তারা নিজেরাই আবার পোল্ট্রি, গবাদি বা দুগ্ধজাত খামার করে নিজেদের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পুষ্টি চাহিদা মেটাবে অন্যদিকে অতিরিক্ত উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। কৃষকরা দেশে তৈরী পাওয়ার ট্রিলার, ধান মাড়াই যন্ত্র বা দানা ফসল মাড়াই যন্ত্র, আগাছা নাশক যন্ত্র, বীজবপন যন্ত্র, ফসলকাটা ও শ্রেণি বিন্যাসকরণ যন্ত্র, মূলজাতীয় ফসল মাটি থেকে উত্তোলন যন্ত্র, উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন সেচ যন্ত্র, ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করনের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা ও খরচ দুটোই কমাতে সক্ষম হবে। একই সাথে দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে যা দ্বারা অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
পর্যায়ক্রমে কৃষিতে জৈব চাষ পদ্ধতির বিকাশ ঘটবে। ফলে আমাদের মাটির গুণগত মান বজায় রাখা ও ভেজালমুক্ত খাবার পরিবেশন করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতিটি গ্রাম থেকে অতিরিক্ত ফসল ও বীজ সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে রপ্তানি করে দেশের মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং শস্য আমদানি বাবদ খরচ কমানো সম্ভব হবে। যৌথভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলো বিক্রির জন্য কৃষকদের দ্বারাই সৃষ্ট বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। ফলে কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাবে এবং ভোক্তারাও ভেজালমুক্ত পণ্যের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও লাভবান হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস পাবে।
কৃষিকে উচ্চশিক্ষা ও পেশা : একটা সময় ছিল অভিভাবকদের স্বপ্ন থাকত তাদের সন্তান চিকিৎসক নয়তো প্রকৗশলী হবে। কৃষির ওপর তাদের সন্তান উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে এটা তারা ভালোভাবে গ্রহণ করতেন না। কিন্তু সময় বদলেছে। কৃষিকে উচ্চশিক্ষা ও পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে আধুনিক অনেক তরুণ-তরুণীরা। এ পেশাকে বিশ্বজুড়ে বলা হচ্ছে সম্ভাবনাময় সবুজ ক্ষেত্র। সত্যি বলতে কি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি কিছু দিয়ে থাকে তাহলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই দিয়েছে। এ পেশার সঙ্গে জড়িত কৃষিবিদ আর কৃষিবিজ্ঞানীদের কল্যাণেই দেশ আজ খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিতে পড়াশোনা করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক ভালো চাকরি পাওয়া যায়। রয়েছে দেশের বাইরে কৃষি নিয়ে কাজ করার অপার সুযোগ। সব মিলিয়ে কৃষি খাতে রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনার হাতছানি।
কৃষি খাতে জনশক্তির কর্মসংস্থান : কৃষি এখন শুধু ধান-আলু চাষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কৃষি খাতে বর্তমানে শত শত উচ্চ শিক্ষিত জনশক্তির কর্মসংস্থান হচ্ছে। এর পরিধিও ক্রমসঃ বাড়ছে। সবজি-ফল উৎপাদন-প্রক্রিয়াজাতকরণ, বীজ সংরক্ষণ-বিপণন, কৃষির বাই প্রোডাক্ট, উৎপাদন-বিপণন, মৎস্য চাষাবাদ-বিপণন এবং এসব নিয়ে গবেষণা সবই কৃষি অর্থনীতির আওতাভুক্ত। এছাড়া খামার ব্যবস্থাপনা এবং দুধের বাই প্রোডাক্ট তৈরি-রফতানি ও গবাদি পশুর চিকিৎসা, পোল্ট্রি ব্যবস্থাপনায় প্রান্তিক চাষিদের সঠিক পরামর্শ দেয়ার জন্যও দরকার হচ্ছে কৃষিবিদের।
কৃষিতে ডিগ্রি লাভ করে বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের (বিসিএস) পরীক্ষায় টেকনিক্যাল ও সাধারণ উভয় ক্যাডারে আবেদনের সুযোগ পাওয়ায় দেশের সব কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারবে। সরকারি-বেসরকারি ও বহুজাতিক বিবিধ প্রতিষ্ঠানে কৃষিবিদদের কাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এনজিও এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন কৃষিক্ষেত্রে তাদের কাজের পরিধি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো কৃষিবিদদের জন্য কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার, বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন, লাইফ স্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, রেশম উন্নয়ন বোর্ড, মসলা, গম কন্দাল ওপরে আলাদা গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন অধিদফতর, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বীজ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান। এ রকম অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বিষয়ক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড), যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক বিষয়ক উন্নয়ক সংস্থা (ডিএফআইডি), ডেনমার্কের বৈদেশিক বিষয়ক উন্নয়ন সংস্থা ড্যানিডা, সুইডেন ও কানাডার সিডা, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, ওয়ার্ল্ড ফিম, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), আন্তর্জাতিক সার গবেষণা ইনস্টিটিউট (্আইএফডিসি) ও অক্সফাম জিবির মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে। ব্র্যাক, স্কয়ার, এগ্রোভেট, লালতীর, ন্যাশনাল এগ্রো কেয়ার, প্রশিকা, আশা, এসিআই, কৃষিবিদ গ্রুপ, অ্যাকশন এইড, কয়ার বাংলাদেশের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও উচ্চ বেতনে চাকরি পাওয়া সম্ভব। ভেটেরিনারি থেকে পাস করে বিসিএস পরীক্ষায় ভেটেরিনারিয়ানরা উপজেলাগুলোতে ভেটেরিনারি সার্জন হয়ে যোগদান করা যায়। একই পরীক্ষায় পশুপালন অনুষদের স্নাতকেরা উপজেলাগুলোতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পশু উৎপাদন কর্মকর্তা কিংবা পোল্ট্রি উন্নয়ন কর্মকর্তা হয়ে যোগদানের সুযোগ পান।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিএলআরআই) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হয়ে যোগ দেয়া যায়। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিভিন্ন সরকারি ফার্ম ও গবেষণা কেন্দ্র আছে। বিসিএস পরীক্ষায় মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা বিসিএসের মাধ্যমে টেকনিক্যাল কোটায় উপজেলাগুলোতে মৎস্য কর্মকর্তা এবং মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হয়ে যোগ দেন। এ ছাড়া সাধারণ কোটায় অনেকেই যোগ দিচ্ছেন। অনেক ফিসারিজ গ্র্যাজুয়েট ব্যক্তিগত খামার ও হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করে মৎস্য উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়িয়েছেন। কৃষিবিদদের জন্য বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে উচ্চশিক্ষার বিশাল সুযোগ। যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত ও মালয়েশিয়ায় প্রতি বছর বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাচ্ছে এদেশের ভবিষ্যৎ কৃষিবিদরা।
নাগরিক সুবিধা : কৃষকরা অত্যাবশ্যকীয় নাগরিক সুবিধা ও প্রকৃত রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবে। দেশের প্রশিক্ষিত কৃষক ও কৃষিবিদদের দ্বারা দেশের বাইরে জমি লিজ নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করে বিশ্বে খাদ্যঘাটতি ও খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যেতে পারে। যার পদক্ষেপ হিসাবে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে জমি লিজ নিয়ে সেখানে বীজ ও ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে। কৃষির এই আমূল পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেশের সমুদ্রসীমায় লবণাক্ত পানিতে হাইড্রোপনিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক এলাকা চাষের আওতায় এনে অতিরিক্ত ফসল ফলানো সম্ভব। শহরাঞ্চলের বাড়ীর ছাদে ছাদে ফুল, ফল ও সবজি শোভা পাবে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করবে। গ্রামগুলোও একসময় রাস্তার দু’পাশ দিয়ে সুবৃহৎ অট্রালিকা আকারে গড়ে উঠবে এবং কৃষিজমির উপর চাপ কমানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশ আবার শস্য শ্যামলে ভরপুর হয়ে তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।