বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ আবদুল অদুদ : একটি জাতির উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি নির্ভর করে সেই জাতির শিক্ষাব্যবস্থার মানের ওপর। শিক্ষিতের হার, শিক্ষার ধরন, শিক্ষা বাস্তবভিত্তিক ও উৎপাদনমুখী কিনা প্রভৃতি বিষয় তার অনুষঙ্গ। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় গলদ থাকলে জাতির কপালে দুর্দশা থাকবেই। মানুষের মনোদৈহিক সুষম সমৃদ্ধির জন্য শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষা শুধু হিসাব করতে শেখায় না কিংবা কথা বলতে শেখায় না। শিক্ষা মানুষের চেতনার জগতে শক্তির সৃষ্টি করে। সেই শক্তির কারণে মানুষের মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হয়। তাই জাতি গঠনে উপযুক্ত শিক্ষাদান ব্যবস্থা চালু করা ও গতিশীল রাখা সরকারের অন্যতম একটি দায়িত্ব। কিন্তু ক’দিন পর পর শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের গড়িমসি সচেতন মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে চলেছে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা নেতিবাচক ভাবনার সুযোগ পাচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো বিষয়ে চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
গত ১০ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রীকে স্বীকার করতে হলো যে, ভুল ও অসম্পূর্ণ তথ্যে ভরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই। তাকে বলতে হলো, মানুষের ভুলত্রুটি হতেই পারে। তবে কিছু ভুল হওয়া উচিত ছিল না। এই ভুলের জন্য বিচার হওয়া উচিত। এনসিটিবির দুই কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে ওএসডি করা হয়েছে। এটাই কী শেষ? এ বছর ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ জন শিক্ষার্থীর হাতে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ‘ভুলেভরা পাঠ্যবই’ কথাটি শুনলে এক্ষেত্রে সরকারের সকল অর্জন তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়; যে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের খবর অভিভাবক মহলে নানা দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন ফাঁস করে ভালো ফল পাইয়ে দেওয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। দু-একটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বিজ্ঞ পাঠকগণ প্রশ্ন ফাঁসের কুফল বুঝতে পারবেন। (ক) যে ছেলেটি ৫ম শ্রেণিতে পড়ে, পরীক্ষার পূর্বরাতে বা পরীক্ষার দিন সকালে যে প্রশ্নগুলো তাকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ অত্যন্ত যতেœর সাথে পড়াচ্ছেন, সেই প্রশ্নগুলোই সেই ছাত্র যখন গিয়ে তার পরীক্ষার প্রশ্নে হুবহু পায়, সে ছাত্রটি হয়তো সাময়িকভাবে বুঝতে পারে না। যখন সে তার পিতা-মাতার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে, তখন তো বুঝতে বাকি থাকে না যে, তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তাকে ভালো ফলাফল করিয়ে স্কুলের সুনাম বৃদ্ধির জন্য চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করেছেন। তখন তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা কেমন হতে পারে ভেবে দেখেছেন? ওই শিক্ষক হয়তো লম্ফজম্ফ করবেন যে, আমার স্কুল থেকে এতগুলো এ প্লাস পেয়েছে। তিনি হয়তো খেয়ালের বশে ভাববেনই না যে, তিনি জাতির মেরুদ- ভেঙে খান খান করে দিয়েছেন। অথচ এই অপকর্মটিকেই তিনি নিচ্ছেন গর্বের বিষয় হিসেবে। কত নির্লজ্জ আমরা(!) (খ) কোনো কোনো বড় (ছাত্রছাত্রীর সংখ্যায়) স্কুল ৫০টি অবজেকটিভ প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে লেখার ব্যবস্থাও করে দেয় তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য। বাকি ৫০ নম্বর লিখিত পরীক্ষায় অনায়াসেই ৩০ পেয়ে ‘এ’ প্লাস নিশ্চিত করা যায়। এভাবে সুনাম কুড়ানোর পর তাদের শিক্ষার্থীরা কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েটসহ ভালো কোথাও ভর্তি হতে পারে না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যখন ইংরেজিতে পাস করে শতকরা মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী, তখন ‘এ’ প্লাসের দৌরাত্ম্য বুঝতে কারো বাকি থাকে না। এমন হাইব্রিড বা ফেঁপেফুলে ওঠা এ প্লাসের দরকারটাই বা কী? (গ) একটি ছাত্রকে কোনো একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর জন্য তার মা (শিক্ষিকা) ১৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছেন। ভর্তির জন্য বাকি টাকা না নিতে আমি মুঠোফোনে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে কথা বলি। ছেলেটির বাবা নেই বলাতে ওনার মনটা গলেছে। তিনি রাজি হওয়ায় আমি তার মাকে পাঠালাম ছেলেকে ভর্তি করতে। মাত্র ৩ দিনের মাথায় মহিলা এসে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। বললেন, ভাই, আপনি জানেন না, আমি কীভাবে এই ১৫ হাজার টাকা জোগাড় করেছি। ছেলে আমার বলে কী সে ওখানে পড়বে না। আমি সান্ত¦না দিয়ে বললাম, কাল ছেলেকে নিয়ে আসুন। আমি বুঝিয়ে বলব। ছেলেকে আমি বুঝাব কী? ছেলে আমাকে এমন সব কথা বলছে; যা পত্রিকার পাতায় ছাপানোর অনুপযোগী। ছেলে বলছে, আমার বন্ধুরা বলছে- ওখানে ভর্তি হয়েছ কেন? তুমিও কী চুরি শিখতে চাও? ওরা প্রশ্ন ফাঁস করে এ প্লাস পাইয়ে দেয়। আঙ্কেল আপনি যা-ই বলেন, আমি এমন প্রতিষ্ঠানে পড়ব না। ছেলেটিকে আমি সেদিন কী বলব, বুঝতে পারিনি। তার মায়ের কষ্টের কথা বলে বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম তুমি নিজে চুরি করিও না। সে তো নাছোরবান্দাহ। সে তার কথায় অটল থেকে বিদায় নিল। টিভি বিজ্ঞাপনে যেমন আমরা দেখিÑ ‘দেশটা তো আমার’। ছেলেটি যেন সেই বিজ্ঞাপনের বাস্তব রূপ। স্যালুট বাবা তোমাকে।
(ঘ) আমরা যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম তখনও নকল হতো। এখন সরাসরি প্রশ্ন ফাঁস। জাতির কোমলমতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিকলাঙ্গ করার ফন্দি এটি। যে কোনো মূল্যে প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। প্রধানমন্ত্রীর অনেক অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের মতো জঘন্য ঘটনায়। সুতরাং এক্ষেত্রে আপনি বলিষ্ঠ ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিন। এ কলঙ্ক থেকে জাতি মুক্তি চায়। ব্যক্তিগত জীবনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে পড়ালেখার কারণে সেখানকার বিধিনিষেধ, প্রথা সম্পর্কে একটু বলে নেওয়াই ভালো। প্রথাগতভাবে এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র পরিদর্শনে সেখানে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট প্রবেশ করতেন না। যে সকল শিক্ষক পরম ¯েœহে শিক্ষার্থীদের পড়াতেন, তারাই আবার অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে সেই ছাত্রকে বহিষ্কার করতেন। পরবর্তী সময় উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন যাই এবং সেখানকার পরীক্ষার হলে গেলেই আমার মনে হতো যে, সার্টিফিকেটে কোনো ভেজালের স্পর্শ লাগতে দেব না। শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীর মধ্যে এমনই চেতনা সৃষ্টি করবেন, যা তারা সারা জীবন বয়ে বেড়াবেন এবং পরম শ্রদ্ধায় সে সকল পিতৃতুল্য-মাতৃতুল্য শিক্ষককে স্মরণ করবেন। আমি পরম শ্রদ্ধার সাথে আমার প্রিয় শিক্ষক ড. জয়নাল আবেদীন, ড. স্বপ্না রায়, অধ্যাপক মতিউর রহমান, অধ্যাপক ইফতেখারুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুস সামাদ, অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস ও নেপাল চন্দ্র রায় প্রমুখ শিক্ষকগণের কথা বলছি। যারা ছাত্রের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতেন, এমন আদর্শ শিক্ষক তৈরির কার্যকর ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে।
(ঙ) ৫ম বা ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীর নিকট যেখানে প্রশ্ন ফাঁস একটি মামুলি ব্যাপার, সেখানে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার সময় তারা পড়বে কেন? তাদের লেখাপড়ার গতি নেতিবাচক পথে ঠেলে দেওয়ার পর ইতিবাচক করা খুবই কঠিন কাজ। আবার একইভাবে ছাত্র যখন বুঝতে পারে যে, তাকে পাপের পথে বা অন্যায়ের পথে ঠেলে দিয়েছেন যিনি, তিনি তার জন্য কল্যাণকামী নয়, তখন সেই শিক্ষার্থী তো শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই পারে। এ বিষয়ে কি বিপথগামী শিক্ষকগণ একটুও ভাববেন না?
বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশনগুলো বারবার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সেই ব্রিটিশ আমলের ধ্যান-ধারণা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় বাদ দিতে হবে। কর্মমুখী, কারিগরি, বাস্তবমুখী শিক্ষা চাই। বেকার তৈরি বা কেরানী তৈরির শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন বিপথগামী না হয়, সে জন্য শিক্ষায় ধর্ম ও নৈতিকতা খুবই জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব ব্যক্তির অবহেলা বা খামখেয়ালির কারণে আজ এত অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কারণ, শিক্ষা নিয়ে গড়িমসি মেনে নেয়া যায় না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহেরের মতটি এখানে স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন, পরীক্ষার পূর্ব রাতে জ্ঞানের মহাসমুদ্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। ভালো ফলাফলের জন্য ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। অথচ প্রাথমিক ও জেএসসির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। সেখানে যারা বেশি প্রশ্ন ফাঁস ও সংশ্লিষ্ট রহস্যম-িত স্থানে যোগাযোগ করতে পারে তারাই ভালো ফলাফল লাভ করতে পারে। এক্ষেত্রে টাকা খরচকে সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলো বিনিয়োগ মনে করে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। আমরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এমন ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।