বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. ইশা মোহাম্মদ : ক্ষমতা নেয়ার আগেই ট্রাম্প পারমাণবিক অস্ত্র ভান্ডার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সাথে সাথে পুতিনও তার দেশের পারমাণবিক সামরিক ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছেন। এর অনেক আগে থেকেই বলাবলি হচ্ছিল যে, পুতিন ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। হিলারি তো প্রকাশ্যেই পুতিনকে দোষারোপ করেছেন। এখন মার্কিন গোয়েন্দারাও এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন দিচ্ছে বলে জানা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চূড়ান্ত বাছাই পর্বের আগেই ট্রাম্প পুতিনকে বড় মাপের নেতা বলেছিলেন এবং একই সাথে হিলারিকে অপছন্দের কথাও বলেছিলেন। কেন দুই পরাশক্তি, যারা সারা জীবন দ্বন্দ্বই করে গেল, তারা আবার একই সুরে কথা বলছে? কেন তারা পরস্পরের পিঠ চুলকাচ্ছে? সন্দেহ করার কি সঙ্গত কারণ নেই?
পুতিন-ট্রাম্প ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুরনো, কিন্তু সেটি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবসা ছিল না। দুটি শক্তিধর দেশের নেতারা কেন পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করছেন? মনে হয় তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবসার কথাই বলছেন। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত এবং অপ্রচালিত পণ্যের ব্যবসা এখন সাধারণ হয়ে গেছে। আগে বাজারে বিক্রি হতে পারে ভাবাই হতো না, তেমন জিনিসও বিক্রি হচ্ছে। ফলে সেগুলোকেও বাজার অর্থনীতি পণ্যে পরিণত করেছে। বিশ্বব্যাপী খুঁজে খুঁজে আর কি বেচাকেনা করে চমক লাগিয়ে দেওয়া যায় এমন পণ্যই নেই। সব কিছুরই ‘ব্যবসা’ হয়ে গেছে। কিন্তু বুর্জোয়াদের লোভ নিবৃত হচ্ছে না। অনেক অনেক টাকা চাই তাদের। কোথা থেকে ওই অনেক টাকা আসবে?
অস্ত্র ব্যবসায় প্রচুর লাভ। কিন্তু প্রচলিত এবং অপাঙ্ক্তেয় অস্ত্রের বাজার সীমিত হয়ে আসছে। তাছাড়া অনেক দেশ নিজেরাই অস্ত্র বানাচ্ছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা গ-গোল বাঁধিয়ে দিয়ে কিছু কিছু অপ্রচলিত অপাঙ্ক্তেয় গাদা বন্দুক টাইপের অস্ত্র বেচাকেনা করে। তাতে তাদের মূলধন ফিরে এলেও বিলাসবহুল জীবনযাপনের অঢেল টাকা-পয়সা আসে না। যেমনÑ মধ্যপ্রাচ্যে গ-গোল বাঁধিয়ে দিয়ে অস্ত্র বেচাকেনা করছে। কোন পক্ষ চূড়ান্তভাবে ক্ষমতায় থাকবে সেটা বড় কথা নয়। কত অস্ত্র বিক্রি হলো সেটাই বড় কথা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আর বেশি দিন চলবে না। দ্বিতীয় বড় সমস্যা হচ্ছে, যদি স্টার ওয়ার শুরু হয় তবে আগের দিনের ‘এটম বোমা’ অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবে। পারমাণবিক বর্জ্য হয়ে যাবে ওইগুলো। তৃতীয় প্রজন্মের পারমাণবিক বোমা তৈরি হয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, চতুর্থ প্রজন্মের পারমাণবিক বোমাও তারা মজুদ করছে।
পরিস্থিতি যদি এমনই হয়, তবে অতীত প্রজন্মের পারমাণবিক বোমায় যে মূলধন বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেগুলোর কী হবে? ওইগুলো বাজারজাত করা এবং বাজার অর্থনীতির কল্যাণে বিক্রি করে মুনাফাসহ মূলধন উসুল করতে হবে। কীভাবে করা যায়? পারমাণবিক অস্ত্র বেচাকেনার অনুমতি নেই। একবার কথা উঠেছিল, ন্যাটো এবং ওয়ারস জোট নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় এটম বোমা ধ্বংস করবে। কিন্তু ধ্বংসের ব্যাপারেও তারা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসী ছিল না। অনেকগুলোই কারণ আছে অবিশ্বাসের। তবে ওই বোমাগুলোতে বিনিয়োগকৃত মূলধন একটি শর্ত হয়েছিল।
বিশ্বের সবাই জানে যে, অস্ত্র ব্যবসায়ে ইহুদি পুঁজি সংশ্লিষ্ট। অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ হলে তাদের পুঁজি মুনাফা খেতে না পেরে হাহাকার করবে। পুতিন এবং ট্রাম্পই পারে, পরস্পরের যোগসাজশে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবসাকে ‘বাজারী’ করতে। খোলাবাজারে ‘ডেভিলস এস’ বেচাকেনা করা একেবারেই অসম্ভব। বিশ্ব জনমত বিরোধিতা করবেই। তাছাড়া ছোটখাটো গ-গোলে ওইসব দামি জিনিস বিক্রিও করা যায় না। তবে কোন উৎসাহী রাষ্ট্র যদি কেনে তবে বেচাকেনা সম্ভব। কিন্তু কে কিনবে?
একটা হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বে অনেক জাতিরাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। যারা রাষ্ট্রীয় পুঁজি পুঞ্জীভূত করেছে। তাদের সবার কাছে পারমাণবিক বোমা নেই। কিন্তু বোমা কেনার সামর্থ্য আছে। তারা যদি ক্রেতা হয় তবে বেচাকেনা ভালো হবে। কিন্তু কিনবে কেন? এসব উন্নয়নশীল দেশ যুদ্ধের মুখোমুখি হলে কিংবা তারা যদি যুদ্ধভীতিতে আক্রান্ত হয়, তবে বোমা কিনবে। একই সাথে বোমা রক্ষণাবেক্ষণ, বোমা মারার কৌশল নিতে হবে। দুটি কারণে প্রভূত লাভবান হবে বিক্রেতা দেশটি। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্রেতা দেশটি বিক্রেতার বশংবদ হয়ে যাবে।
তৃতীয় বিশ্বের কয়েকটি দেশে গ-গোলের ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে। মোটামুটি আগুন জ্বলার অবস্থায় পৌঁছে গেছে তারা। এই পরিস্থিতিতে সা¤্রাজ্যবাদীরা পারমাণবিক অস্ত্রবাজার উদ্বোধন করতে চাচ্ছে। কিন্তু বাজারী বুদ্ধিমানেরা ভালোভাবেই জানে যে, পুতিন বাধা দিলে ওই বাজারে ‘নৃত্য-বাদন’ হবে না। তাই তারা পুতিনকে ওই অমানবিক ব্যবসায় পাশে পেতে চাইবে।
এই পারমাণবিক ব্যবসার চূড়ান্ত ফল কী হবে? তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষ অকাতরে প্রাণ হারাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইহুদিবাদীরা আইএস বা এমনই অন্য কোনো নাম দিয়ে স্বাধীন জঙ্গি রাষ্ট্র তৈরি করার স্বপ্ন দেখিয়ে একটি স্থায়ী গ-গোল পাকাতে চাচ্ছে। একপর্যায়ে ওই জঙ্গিদের মারার জন্য তারাই আবার পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের পরামর্শ দেবে। জঙ্গি জ্বালাতনে অস্থির হয়ে অনেকেই বোমা কিনবে এবং মারবে। এমনও হতে পারে যে, ওই জঙ্গিদের কাছেই অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বোমা বিক্রি করবে এবং দু-একটা বোমা তাদেরকে দিয়েই ফাটিয়ে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক তৈরি করবে। ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যেমন বোকাসোকা মানুষেরা ওঝার কথায় যা করার নয়, তা-ই করে, তেমনই বোমাতঙ্কে বোকাসোকা নেতারা বোমা কিনবে এবং মারবেও। এভাবে বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র বাজার তৈরি হতে পারে।
বিশ্বের কোথায় কী আছে, তা সা¤্রাজ্যবাদ ভালোভাবেই জেনে গেছে। তারা মহামূল্যবান আকরের সন্ধান জানে। কিন্তু ওই আকর ব্যবহার করে কোনোরূপ মুনাফা সংগ্রহ করতে পারছে না। ভয়ও আছে। আকর বেহাত হওয়ার ভয়। যাদের আকর তারাও প্রযুক্তিতে শক্তিশালী হয়ে ওই আকর ব্যবহার করতে পারে। আকর বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয় আছে উভয় কারণে। সে জন্য তারা শতাব্দীকাল অপেক্ষা না করে এখনই ওইসব আকর ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু বাজারে চাহিদা না থাকলে তো আকরে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া যাবে না। সে কারণে ট্রাম্প-পুতিন যৌথ উদ্যোগে নতুন ধরনের বাজার অর্থনীতি চালু করতে চাচ্ছে।
পুতিনের জন্য বোমা ব্যবসা খুবই খারাপ উদাহরণ। বোমা ব্যবসায় না নামলেও পুতিনের দিন যাবে। কেননা, পুতিনের মূল শক্তি রুশ জনগণ। তাদের সোভিয়েত অভিজ্ঞতা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তাদের এখনও শুকায়নি। পুতিন যত বিজয় উৎসব করুক না কেন যার জ্বালা সে ঠিকই বুঝছে। যুদ্ধ চাই না শান্তি চাইÑ এমন কথাবার্তা সাধারণ মানুষেরা বলাবলি করে। ইউরোপ যুদ্ধ চায় না। কিন্তু ইউরোপের বনেদী ধনতন্ত্রীরা মুনাফা চায়। তারা অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত। কয়েকটি দেশ খুবই উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু বেচাবিক্রি খুবই কম। এখন যদি পারমাণবিক যুদ্ধের আগাম তৎপরতা শুরু হয়, তবে ওইসব উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করেও লাভবান হওয়া যাবে। যেমন ভারত বিশেষজাতীয় বিমান কেনার অর্ডার দিয়েছে। শুধুমাত্র ভারতই নয়, সবাই গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে কেনাবেচায় জড়িত হয়েছে। সা¤্রাজ্যবাদী ও বনেদী ধনতন্ত্রীদের লোভ-লালসাকে প্রতিরোধ করার একমাত্র উপায় যুদ্ধের দামামা থামিয়ে দেওয়া। সেটা সম্ভব হতে পারে কেবলমাত্র পুতিনের সহযোগিতায়। কিন্তু পুতিন পারমাণবিক কূটনীতি ত্যাগ করে পারমাণবিক যুদ্ধে নেমেছে। তার দেশের বড় ব্যবসায়ীরাও এটাই চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ চায় না। তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে, তার দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে পুতিনের উচিত হবে পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন করা। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মতো সারা বিশ্বকে একত্র করা সম্ভব হলে অবশ্যই যুদ্ধ এড়ানো যাবে।
কিন্তু সাধারণ মানুষ কী করবে? দেশে দেশে গণআন্দোলন করতে পারে। শুভবুদ্ধির মিছিল করতে পারে। পুরনো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন জোরদার করতে পারে। মানুষের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। মার্কিন মুল্লুকের সাধারণ মানুষের কি কিছুই করণীয় নেই? প্রথমেই তারা বাজার অর্থনীতির বিরোধিতা করতে পারে। পৃথিবীর সব কিছুই পণ্য নয়। আন্দোলন তো করাই যায়। ট্রাম্পবিরোধীরা তো রাস্তায় নামতেই পারেন। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারেন। পারমাণবিক অস্ত্র কারখানাগুলোকে খেলনা বানানোর কারখানায় পরিণত করার আন্দোলনে নামতে পারেন। ট্রাম্পের দেশের মানুষরা, পুতিনের দেশের মানুষরা কেন বুঝবে না যে ভবিষ্যতের পারমাণবিক যুদ্ধের অমানবিক ভয়াবহতা থেকে তারাও রেহাই পাবে না। এমনও হতে পারে, তাদের চিহ্নই বিশ্ব থেকে মুছে যেতে পারে।
সাধারণ মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে। ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না, জানতে হবে এবং আন্দোলনে নামতে হবে। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে কোনো নেতা নেই। জনতাই নেতা। কামনা করি বিশ্ব ধ্বংসযজ্ঞের পাঁয়তারার বিরুদ্ধে জনতার যাত্রা শুরু হোক।
য় লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।