বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মাহমুদ ইউসুফ : নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মৃত্যু তারিখ ১৬ জানুয়ারি ১৯১৫। তার অকাল মৃত্যু নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল, নানা প্রশ্ন, নানা জল্পনা-কল্পনা। অনুসন্ধানকারীদের অনুসন্ধিৎসু মন আজও খুঁজে বেড়ায় তার রহস্যময় মৃত্যু ঘটনার কারণ। কেন অকালে ঝড়ে গেলেন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ প্রাণ, মুক্তির দূত, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা স্যার সলিমুল্লাহ?
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকত না। এদেশ থাকত কেবলই ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে। তাই এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ গঠন এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খাজা সলিমুল্লাহই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার, জনক এবং স্বপ্নপুরুষ।
সাধারণ পাঠকরা তার মৃত্যুকে নিছকই মৃত্যু হিসেবেই জানে। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, সেটা ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকা-। বর্ণহিন্দুরা তাকে বারবার হত্যা করার চেষ্টা চালায়। হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে, গুলি করে। ইতিহাস গবেষক মরহুম সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খ- বইতে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, বঙ্গভঙ্গ আইন বহাল রাখার দাবিতে কুমিল্লার এক জনসভায় খাজা সলিমুল্লাহর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। পথিমধ্যে এক হিন্দুবাড়ি থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ফলে জনসভা প- হয়ে যায়। নবাব বাহাদুর ঢাকা ফিরে আসেন। নবাবকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় অন্যপন্থা অবলম্বন করা হলো। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাঁধানো হলো। হিন্দুরা সশস্ত্র, মুসলমানরা নিরস্ত্র, তাই মুসলমান বেঘোরে প্রাণ হারাতে লাগল। শ্রী নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার স্মৃতিচারণমূলক ‘দি অটো বায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থে এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। (সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদ : আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খ-, পৃ ২১৩)।
ইতিহাসবিদ কবি ফারুক মাহমুদ বলেন, হিন্দুদের চক্রান্তের ফলে ঢাকায় বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে বড়লাটের সাথে নবাবের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে বড়লাট নবাবকে অপমানজনক কথা বলেন। তার সহ্য হয়নি। নবাবের সাথে সব সময় একটি ছড়ি থাকত। সে ছড়ি দিয়ে নবাব বড়লাটের টেবিলে আঘাত করেন। এ নিয়ে চরম তির্যক বাদানুবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বড়লাটের ইঙ্গিতে তার দেহরক্ষী নবাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় নিñিদ্র প্রহরায় নবাবের লাশ ঢাকায় আনা হয়। তার আত্মীয়স্বজনকেও লাশ দেখতে দেয়া হয়নি। সামরিক প্রহরায় বেগম বাজারে তাকে দাফন করা হয়। (ওই; পৃ : ২২১)
এভাবেই বাংলার কীর্তিমানদের একে একে নিধন করা হয়েছে গোপূজারি ও ফিরিঙিদের নেতৃত্বে। সিরাজদৌলা, মির মদন, মজনু শাহ, তিতুমীর, শরিয়তউল্লাহ, রজব আলি, নজির আহমদ, জিয়াউর রহমান। আরও লাখ লাখ ইমানদার মুজাহিদ ওদের অস্ত্রাঘাতে চলে গিয়েছেন পরাপারে। আজও চলছে এই খেলা। ভারতীয় আগ্রাসন, গুম, খুন, গুপ্তহত্যা, পাচার হচ্ছে এদেশের তরুণ, যুবকরা। মুমিন মুসলমানরা দিবানিশি আতঙ্কে কাটাচ্ছে ভারতীয় মাফিয়া ডন ও তাদের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থার এর অপারেশনের ভয়ে। আর বাংলাদেশের তথাকথিত বাম-রাম-সেক্যুলাররা ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকে বরণ করছে, পাকাপোক্ত করছে তাদের আধিপত্যকে। ভারত সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে তারা রাষ্ট্রের ফুটপাত থেকে রাজপথ, গ্রাম থেকে ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দু, বিমান বন্দর, নৌবন্দর, স্থলবন্দর, প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, গণমাধ্যম, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই তুলে দেওয়া হচ্ছে ভারত সরকারের হাতে। দেশের একজন দিনমজুর, কৃষক, রিকশাওয়ালাকেও ট্যাক্স, ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু অবৈধভাবে ১৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, চাকরি-বাকরি করে সব লুটে নিচ্ছে। তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। বাংলাদেশের রিকশার জন্যও সড়ক ফি দিতে হয়ে, অথচ ভারতের পরিবহন, যানবাহন অবাধে দেশের অভ্যন্তর দিয়ে পূর্বাঞ্চলে, ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত করতে পারবে, পণ্য পরিবহন করতে পারবে। আমাদের নেতাদের ভাবনা হলো- ভারতের কাছে ফি চাওয়া অসভ্যতামি।
যারা বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে, মুসলমানদের বিপক্ষে, খাজা সলিমুল্লাহর বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিল, যারা মুসলমানদের পাইকারীহারে হত্যা করেছিল তাদের হাতেই তুলে দেয়া হয়েছে দেশের ভাগ্য। এজন্যই দেশ জাতি আজ ১০ নম্বর বিপদ সঙ্কেতের মুখোমুখি।
স্যার সলিমুল্লাহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়েন ১৯০৫ সালে। ১১১ বছর পর পেরিয়ে গেছে। দেশ কী আবার চলে যাচ্ছে বঙ্গভঙ্গ পূর্ব আমলে? এ প্রশ্ন এ সওয়াল আজ সচেতন নাগরিকের মনে। কিন্তু কেউ কিছু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেশপ্রেমিকদের। দেশপ্রেমিক মিডিয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অজানা অতঙ্কে আতঙ্কিত সবাই। এ বিষয়ে সাবেক পার্লামেন্টারিয়ান গোলাম মাওলা রনির বয়ান উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইসরাইল, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত, চীন প্রভৃতি দেশের শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা অথবা ওসব দেশের মাফিয়া ডনেরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো মুহূর্তে সর্বনাশ ঘটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে দক্ষতা-অভিজ্ঞতা ও কুখ্যাতি অর্জন করেছে তাতে সাধারণ মানুষের ভয় পাওয়ার প্রবণতা বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৬ জানুয়ারি ২০১৭, পৃ: ৬)। তার মতে, এজন্যই টকশোতে আলোচনা করতে গিয়ে আলোচকেরা খোলামেলা এবং সত্য কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত এবং ভীতিকর আড়ষ্ট।
সবার মনেই উদ্বেগ, ভয়ার্ত সবাই। চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী, সালাহউদ্দিন, ব্যারিস্টার আরমান, হুম্মাম কাদের চৌধুরীসহ অসংখ্য অগণিত মানুষের পতন ঘটিয়েছে ওরা। পিলখানার বিয়োগান্তক ঘটনা, শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডি, জামায়াত-বিএনপি নির্মূল, কথিত বন্দুকযুদ্ধ, দেশপ্রেমিক জওয়ান যুবাদের ঠা-া মাথায় হত্যা সবই সেই অদৃশ্য শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। তাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে সিকিম-কাশ্মির-হায়দারাবাদের মতো গ্রাস করা।
নবাব সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা ফজলুল হক, নওয়াব আলি চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাস উদ্দিন, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল হাশিম, কবি গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর আহমদ, হামিদ খান ভাসানী, শহিদ সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্ন সাধের সোনার বাংলা। শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মাখদুম, ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ, জালাল উদ্দিন মুবারক শাহ, সিকান্দার শাহ, শের শাহ, সুলায়মান খান কররানি, দাউদ খান কররানি, ইশা খাঁ, মুসা খাঁ, শায়েস্তা খানের পুণ্যস্মৃতি ধন্য আমার বাংলাদেশ। এই পবিত্র ভূমিকে রক্ষা করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তাই প্রতিবেশী সম্প্রসারণবাদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়। শহিদ জিয়াউর রহমান, মেজর এম এ জলিলের মতো গর্জে উঠতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। দেশরক্ষার এ আন্দোলনে শরিক হওয়া ইমানি দায়িত্ব। এদের অদৃশ্য হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারলেই নবাব স্যার সলিমুল্লাহ অসম্পূর্ণ স্বপ্ন সুচারুভাবে পূরণ করা হবে।
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।