দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
যে আরবের অধিবাসীরা পয়গাম্বরদের নাম পর্যন্ত জানত না, যারা নবুওত ও রিসালাতের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত ছিল না, যারা নবী ও রাসূলগণের নৈতিক অবস্থার সাথে পরিচিত ছিল না, যারা নবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সত্যতা, বিশ্বাস স্থাপন করতে পারত না এবং যারা নিজেদের দেবতা ও উপাস্যদের বিপরীতে হযরত ঈসা বিন মরিয়মের কাজ ও কথাকে হাস্যকর বলে মনে করত এবং যারা হযরত মূসা (আ.)-এর মর্যাদা ও ফজিলতের কথা শুনে নিজেদের গোস্বা সংবরণ করতে পারত না। এ শ্রেণির আরবরাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র শিক্ষা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হলো যে, কয়েক বছরের মাঝেই তারা এক একজন পয়গাম্বরের নাম পরিচয় এবং জীবনেতিহাস সম্পর্কে অবগত হলো। এমনকি নিজেদের সন্তান-সন্ততির নাম নবী ও রাসূলগণের নামের সাথে সম্পৃক্ত করে বরকত ও রহমত হাসিল করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এতে করেই ইসলাম বিস্তৃতির সাথে সাথে নবী ও রাসূলগণের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিধি বিশ্বজোড়া বিস্তৃত হয়ে ওঠে। এই মুসলমানরাই নবী ও রাসূলগণের সততা ও সত্যবাদিতার সাক্ষ্যের ঝা-া সমুন্নত করেছেন এবং পয়গাম্বরদের সম্মান ও মর্যদাকে নিজেদের অন্তরের মণিকোঠায় স্থান দান করেছেন। এমনকি তাদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনাকে দ্বীন ও ঈমানের প্রকৃষ্ট পরিচিতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নিতান্ত দুঃখের কথা হলো এই যে, নবী ও রাসূলগণের এই মর্যাদা ও সম্মানের যথাযথ স্বীকৃতি দুনিয়ার অন্য কোনো জাতির কর্মকা-ের পরিদৃষ্ট হয় না। একমাত্র ইসলামই পয়গাম্বরদের নামকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে শিখিয়েছে এবং প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব এবং কর্তব্যকে এভাবে তুলে ধরেছে যে, পয়গাম্বরদের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে এবং তাদের প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করতে হবে।
আল্লামা মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ তাছির মাসউদ লুধিয়া নুভী, তৎপ্রণীত। আকায়েদে আছলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত গ্রন্থে নবী ও রাসূলগণের ওপর ঈমান বিষয়ে তথ্য পূর্ণ আলোচনা করেছেন। যা নি¤েœ পরিবেশন করা হলো।
আল্লাহতায়ালা মানব গোষ্ঠীর হেদায়াতের জন্য যে সম্মানিত নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাদের নবী ও রাসূল বলে। সকল নবী ও রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করা অত্যাবশ্যক। যেমনÑ
(ক) আল্লাহতায়ালা বলেনÑ তোমরা বল : আমরা ঈমান আনলাম আল্লাহর ওপর, ওই কিতাবের ওপর যা আমাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে আর তার ওপর যা ইব্রাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক ও ইয়াকুব (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়েছে। (আল বাকারা-১৩৬) (খ) নবী ওই মানুষকে বলা হয় যাকে তার প্রতি প্রেরিত বাণীকে প্রচারের জন্য আল্লাহ প্রেরণ করেছেন। অনুরূপভাবে রাসূলের ওপর ওই দায়িত্ব (শরহুল মাকাসিদ-৩/২৬৮) (গ) আশআরিয়াহদের মতে, শরিয়তের পরিভাষায় নবী রাসূল হলেন ওই ব্যক্তি আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাগণের মধ্য হতে বাছাইকৃত যে বান্দাকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আরসালনাকা’ ... তোমাকে অমুক সম্প্রদায়ের নিকট রাসূল করে প্রেরণ করলাম, অথবা আমার পক্ষ হতে তাদের নিকট এ বাণী পৌঁছিয়ে দাও বা অনুরূপ শব্দাবলী দ্বারা সম্মোধন করবেন, যা উল্লিখিত অর্থ বহন করে যেমন বাআছতুকা, নাব্বিহুম ইত্যাদি (কাশ্বাফ ইস্তেলাহাতিল ফুনুন-২/১৬৮১) সুতরাং সকল নবী-রাসূলের ওপর ঈমান আনা, গাইব ইত্যাদির বিষয়ে প্রদত্ত খবরে তাদেরকে সত্যবাদী বলে মেনে নেয়া এবং সকল আদেশ-নিষেধে তাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। (শরহে আকাইদে সাফারিনিয়্যাহ ২/২৬৩)
আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে প্রেরিত ওই ব্যক্তিকে নবী বলে যার ওপর তাঁর ওহী অবতীর্ণ হয়। আর আল্লাহপাক তাকে আহকামের প্রচার ও মানব জাতির হেদায়াতের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তার ওপর নতুন কোনো কিতাব অবতীর্ণ হোক বা না হোক। মান-মর্যাদার নবীর তুলনায় রাসূল ঊর্ধ্বে। যে নবী কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাঁকে রাসূল বলে। যেমনÑ যে নবী নবুওয়াতের সাথে সাথে নতুন কোনো আসমানি কিতাবের বাহক হবেন, তিনি রাসূল। অথবা মানুষের সংশোধনের জন্য প্রেরিত ব্যক্তি নবী, আর নবুওয়াতের সাথে সাথে যেমন শত্রুর মোকাবিলা ও সম্মুখ সমরের জন্য প্রেরিত ব্যক্তি রাসূল নামে ভূষিত হবেন। এ হতে জানা গেল যে, সকল রাসূলই নবী, তবে সকল নবীই রাসূল হবেন না। উলামায়ে কেরাম নবী ও রাসূলের মধ্যে একাধিক পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে উত্তম হলো আল্লাহতায়ালা যাকে আসমানি খবরে অবহিত করেছেন যে, তিনি আল্লাহর নির্দেশ অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দেবেন, তিনি নবী রাসূল। আর যাকে ওই খবর অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ করেননি তিনি নবী বটে, কিন্তু রাসূল নন। কাজেই নবীর তুলনায় রাসূল খাস সুতরাং সকল রাসূলই নবী, সকল নবীই রাসূল নন। (আকীদায়ে ত্বহাবিয়্যাহ মাআশ শরহ-১৫৮)
প্রেরিত নবীর সংখ্যা বেশি, রাসূল কম। নবীগণের সংখ্যা লক্ষাধিক, আর রাসূলগণের সংখ্যা তিনশত তের অথবা তার কিছু কম/বেশি। হাদিসে আছে (ক) হযরত আবু উমামা হতে বর্ণিত হযরত আবু যর (রা.) বলেন, আমি একদা আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! নবীদের পূর্ণ সংখ্যা কত? রাসূল (সা.) বললেনÑ এক লাখ চব্বিশ হাজার, তন্মধ্যে তিনশত পনর জন রাসূল (আহমাদ)। (খ) হযরত আবু যর (রা.) বলেন, আমি আরজ করলাম হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! রাসূল কতজন? তিনি বললেন : তিনশত তের হতে উনিশের একটি দল। (আহমদ) অন্য বর্ণনায় আছে, দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। (নিবরাস-২৮১) (গ) হযরত আবু যর গিফারী (রা.) হতে সহীহ ইবনে হিব্বানে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ আমি একদা মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে দেখলাম, রাসূল (সা.) একাকী বসে আছেন। তিনি একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করলেন। উক্ত হাদিসের একাংশে আছে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! নবী ছিলেন কতজন? তিনি উত্তরে বললেন, এক লাখ চব্বিশ হাজার। আমি নিবেদন করলাম : তাঁদের তাদের মধ্যে রাসূল কতজন? তিনি বললেন, “তিনশত তেরজন”। আমি নিবেদন করলাম : তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে? তিনি জবাব দিলেন : আদম (আ.)। (শরহে আকাইদ সাফারিনিয়্যাহ-২/২৬৩)
নবী দুনিয়াতে কারো নিকট লেখাপড়া শেখেন না। সরাসরি আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে তাদের সকল ইলম দান করা হয়। এ কারণেই তারা সমকালীন যুগে সম্প্রদায়ের সকল ব্যক্তি হতে অধিকতর বিজ্ঞ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে :
(ক) যারা রাসূল-নবীয়ে উম্মির অনুসরণ করে অর্থাৎ এমন রাসূলের অনুকরণ করে, যিনি নশ্বর জগতের কোনো শিক্ষকের নিকট লেখাপড়া শিক্ষা করেননি। (আল আ’রাফ- ১৫৮) (খ) তিনি নিজ প্রবৃত্তির বশে কোনো কথা বলেন না। তার কথা ওহী বই কিছু নয়। মহান শক্তিধর সত্তা তাকে শিক্ষা দান করেছেন। (আন নাজম-৩-৫) (গ) আল্লাহতায়ালা আপনার ওপর কিতাব ও হিকমাত অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনাকে শিখিয়েছেন এমন সকল বিষয় যা আপনি জানতেন না। (আন নিসা-১১৩)
সকল নবী রাসূলের দ্বীন তথা মৌলিক আকিদা এক-অভিন্ন; শরীয়ত তথা কর্মপদ্ধতি এবং শাখাগত বিধিবিধান পৃথক পৃথক। ইরশাদ হয়েছে :
(ক) আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য ঐ দ্বীনই বিধিবদ্ধ করেছেন যা নূহ (আ.)-কে নির্দেশ করেছেন। যা আপনার নিকট ওহী করেছি ও যা ইবরাহীম, মূসা ঈসা (আ.)-কে নির্দেশ করেছি। আর তা হলো, তোমরা দ্বীন কায়েম কর ও সে ব্যাপারে পৃথক পৃথক হবে না। (আশ শুআরা-১৩) (খ) তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি কর্মধারা, বিধিবিধান ও পদ্ধতি নির্ধারণ করেছি। (আল মায়িদা-৪৮) (গ) আপনার পূর্বে প্রেরিত রাসূলগণকে জিজ্ঞেস করুন যে, আমি কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য ইলাহ ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করেছি। (আয যুখরুফ-৪৫) (ঘ) আয়াতের মর্ম হলোÑ তোমার ও অন্যান্য নবীর জন্য মৌলিকভাবে একটা দ্বীন বৈধ করেছি আর তা হলো, তাওহীদ সালাত, যাকাত, সিয়াম হাজ্জ ও সৎ কর্মের মাধ্যম আল্লাহর নৈকট্য লাভ, এসবই এক দ্বীন ও মিল্লাত হিসেবে বিধিবদ্ধ। নবীদের মধ্যে এ সকল বিষয়ে কোনো ইখতিলা ছিল না। মোট কথা, দ্বীনের মূল বিষয় ছিল এক, শাখা-প্রশাখা ছিল বিভিন্ন। উত্তম চরিত্র ও প্রশংসিত আচরণ গ্রহণ আর ঘৃণিত স্বভাব বর্জন করার ব্যাপারে তাদের একমত হওয়াটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। প্রত্যেক নবী স্বীয় নবুওয়াতের উদ্দেশ্যে ও আল্লাহর পক্ষ হতে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সফল হয়েছেন। কোনো নবীর ওপর একজন ব্যক্তিও যদি ঈমান না এনে থাকে তবুও তিনি সফল। ইরশাদ হয়েছে :
(ক) হে নবী! তুমি নসিহত কর। তুমি একজন নসিহতকারী মাত্র। তুমি তাদের ওপর দারোগা নও। তবে যে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও কাফির হয়ে যায়, আল্লাহতায়ালা তাকে কঠিন আজাব দেবেন। (আল গাশিয়াহ-২১-২৪) (খ) রাসূলদের ওপর আহকাম প্রকাশ্যভাবে পৌঁছে দেয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব নেই। (আল নাহাল-৩৫) দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়ে উম্মত এ বিষয়ের ওপর একমত যে, নবীগণ মিথ্যা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত, জনগণের মাঝে প্রচারণা ও উৎসাহ প্রদানের ব্যাপারে সদা সচেষ্ট ছিলেন। অন্যথায় নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে তাদের অনীহা ও অযোগ্যতা প্রমাণিত হবে। আর স্বেচ্ছায় বা ভুলক্রমে তাদের থেকে এ হেন উদাসীনতা প্রকাশ পাওয়া সর্বসম্মত মতে অসম্ভব।
নবীর দ্বারা কখনো ইজতিহাদী ত্রুটি হতে পারে। তা নবী নিষ্পাপ হওয়ার প্রতিবন্ধক নয়। স্মরণযোগ্য যে, নবী কখনো ইজতেহাদী ভুলের ওপর স্থিত থাকেন না। (বরং আল্লাহতায়ালা তাকে সংশোধন করে দেন। যত নবী ও রাসূল আগমন করেছেন, সকলের ওপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। সকল নবীর ওপর বিশ্বাস স্থাপনের পর একজন মাত্র নবীর ওপর মিথ্যা আরোপ করলেও ঈমান ধ্বংস হয়ে যাবে। ইরশাদ হয়েছে : (ক) নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে আর আল্লাহ ও রাসূলগণের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পায় এবং বলে আমরা কতিপয়কে অস্বীকার করব এবং এর দ্বারা একটা মধ্যবর্তী পন্থা গড়ে নেবার ইচ্ছা করে, ওরাই খাটি কাফির। (আননিসা-১৫০-১৫১) (খ) সকল নবী রাসূলকে তাদের প্রদত্ত সকল খবরের সত্যায়নসহ তাদের প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক। ... আল্লাহতায়ালাও তাদের আনীত সকল বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন অপরিহার্য করেছেন। (শরহে আকাইদে সাফারিনিয়্যাহ-২/২৬৪)
জগতের প্রথম নবী হযরত আদম (আ.) আর প্রথম রাসূল হযরত নূহ (আ.)। নবীগণের মর্যাদায় পার্থক্য আছে। যেমন (ক) কোরআনপাকের ঘোষণা আমি কতিপয় নবীকে (আ.) অন্য কতিপয় নবীর ওপর মর্যাদা দান করেছি। (আল ইসরা-৫৫) (খ) সবুর করুন, যেমন উলুল আযম নবীগণ সবুর করেছেন, তাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। (আল আহকাফ-৩৫) (গ) দীর্ঘ একটি হাদিসে নবী (সা.) বলেন... হে নূহ (আ.)! আপনি হলেন ভূপৃষ্ঠে সর্বপ্রথম রাসূল। (সহিহ মুসলিম-১/১১১) (ঘ) সর্ব প্রথম নবী হযরত আদম (আ.) সর্বশেষ হযরত মুহাম্মদ (সা.)। হযরত আদম (আ.)-এর নবুওয়াতের স্বপক্ষে কিতাবুল্লাহর ওই আয়াত উপস্থাপনযোগ্য যেখানে তার প্রতি আদেশ ও নিষেধ রয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী/সহধর্মিণী জান্নাতে অবস্থান কর। বিনা সংকোচে যা ইচ্ছা তাই ভক্ষণ কর, তবে এ বৃক্ষটির নিকটবর্তী হবে না। তাছাড়া উম্মতের ঐকমত্যে এ কথা নিশ্চিত প্রমাণিত যে, তার কালে আর কোনো নবী ছিলেন না। (নিবরাস-২৭৪) (ঙ) উলুল আযম রাসূল কে বা কাকে বলে এ ব্যাপারে একাধিক উক্তি দেখা যায়। সর্বোত্তম উক্তি হলো আল্লামা বাগাভী প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস ও হযরত কাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণনা করেনÑ উলুল আযম রাসূল হলেন হযরত নূহ, হযরত ইব্রাহীম, হযরত মূসা, হযরত ঈসা, হযরত মুহাম্মদ (সা.)। কোরআন মাজিদের এই আয়াতে যাদের নাম উল্লেখ আছে। (আল আহযাব-৭) (আকিদায়ে ত্বহাভিয়্যাহ মাআশশরহে-৩১১-৩১২) মানব গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তম হলেন নবীগণ। নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন রাসূলগণ। রাসূলগণের মধ্যে অধিকতর মর্যাদা সম্পন্ন হলেন উলুল আযম রাসূলগণ। উলুল আযম রাসূল হলেন হযরত নূহ (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহপাক ঈমানদার মুত্তাকিদের বর্ণনায় বলেনÑ (ক) যারা আপনার প্রতি নাজিলকৃত আপনার পূর্বে নাজিলকৃত কিতাবসমূহের ওপর ঈমান রাখে এবং যারা আখিরাতে বিশ্বাস রাখে তারাই তাদের রবের হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই একমাত্র সফলকাম। (আল-বাকারা-৪-৫)
নবী ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন ব্যতীত আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়ন গ্রহণ ও নির্ভরযোগ্য নয়। আল্লাহতায়ালার প্রতি ওই ব্যক্তির ঈমান নির্ভরযোগ্য যে নবীগণের ওপর ঈমান রাখে। ইরশাদ হয়েছে :
(ক) আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি (তারা আমার নির্দেশ মতো উম্মতদের বলেছেন) তোমরা আল্লাহতায়ালার উপাসনা কর আর তাগুত থেকে দূরে থাক। তাদের মধ্যে হতে কিছু লোকের ওপর পথভ্রষ্টতা স্থায়ী হয়েছে। (অর্থাৎ পথভ্রষ্টতার মধ্যে ডুবে রয়েছে।) অনন্তর তোমরা লক্ষ্য কর মিথ্যা আরোপকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল? (আন-নাহল-৩৬) (খ) এমন কোনো উম্মত নেই, যাদের মধ্যে সতর্ককারী বা ভীতি প্রদর্শনকারী অতিবাহিত হয় না। (ফাতির-২৪)
মহান আল্লাহ প্রত্যেক জাতি ও অঞ্চলে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। কোনো জাতি বা দেশ এমন নেই যেখানে কোনো নবী বা রাসূলের আগমন হয়নি। নবুওয়াত উপার্জনযোগ্য বস্তু নয় যে, উপাসনা-আরাধনার ফল হিসেবে কেউ তা লাভ করতে পারবে। বরং এটি একমাত্র আল্লাহর দান ও তার নির্বাচন। যাকে ইচ্ছা তিনি নবুওয়াত-রিসালাতের ভূষণে ভূষিত করেন। ব্যক্তিগত চেষ্টা-সাধনা, ইবাদত-বন্দেগীর এখানে কোনো প্রভাব নেই। ইরশাদ হয়েছে। (ক) আল্লাহতায়ালা স্বীয় বিশেষ রহমতে (নবুওয়াত) যাকে ইচ্ছাদান করেন। আল্লাহ মহান অনুগ্রহদাতা। (আল বাকারা-১০৫) (খ) কিন্তু মহান আল্লাহ রাসূলগণের মধ্যে হতে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন (আল ইমরান-১৭৯) মোটকথা নবুওয়াত আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, করুণা ও দান। যাকে ইচ্ছা দান করেন ও নবুওয়াতের সম্মানে সম্মানিত করেন। সুতরাং কেউ স্বীয় ইলম, যোগ্যতা ও উপার্জনের দ্বারা এ পদ লাভ করতে পারে না। যে ব্যক্তি নবুওয়াত ও রিসালাতকে উপার্জনযোগ্য ও সাধনা দ্বারা লভ্য বিশ্বাস করে সে যিন্দীক। (শরহে আকিদায়ে সাফারিনিয়্যাহ-২/২৬৮)
নবী-রাসূলকে কখনো তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় না। তাঁদের জন্মই হয় নবী হিসেবে এবং মৃত্যুর পরও নবীরূপে গণ্য থাকেন। মহান আল্লাহ সর্ববিষয়ে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী বিধায় এমন কাউকে নবুওয়াতের পদ দান করেন না যাকে ভবিষ্যতে বরখাস্ত করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, (ক) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বক্তব্য হলোÑ রাসূল ও নবীগণ ওহী লাভ করার পূর্বেও রাসূল ও নবী। অনুরূপভাবে পৃথিবীর জীবন সমাপ্তি লাভের পরও। তাঁরা সদা-সর্বদা মাসুম বা নিষ্পাপ। এ দাবির দলিল, ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর বাণী। মাতৃক্রোড়ে শৈশবকালে ঈসা (আ.) নবুওয়াতের ঘোষণা দিয়েছেন আর মহান আল্লাহ তা সত্যায়ন করেছেন। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর একজন গোলাম। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী করেছেন। শুধু শিশু বা বালক বলে পরিচিত কারো কাছে কিতাব বা ওহী আসে না, যতক্ষণ না তিনি নবী রাসূল হিসেবে মঞ্জুরিপ্রাপ্ত হন। উল্লিখিত আয়াতে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। যে এ বাণী/হুকুমকে অবিশ্বাস করবে সে অবশ্যই কাফির হয়ে যাবে। (তামহীদে আবু শাকুর সালেমী-৭৩)
সকল নবী সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত হয়ে থাকেন। তাঁরা জান্নাতের শুভ সংবাদ ও জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন। উচ্চ মানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, স্বীয় সম্প্রদায়ে পূর্ণতা-মর্যাদায় সকলের অগ্রণী হয়ে থাকেন। সর্ব প্রকার বানোয়াট হতে পবিত্র, দ্বীন প্রচার কার্যের পারিশ্রমিক গ্রহণ হতে বিরত, উম্মতকে আল্লাহর আয়াত পাঠ করে শুনাতে এবং কিতাব হিকমাতের শিক্ষা দানে রত ও ব্যস্ত থাকেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন- (ক) তিনি ছিলেন অঙ্গীকারে সত্যাশ্রয়ী, তিনি ছিলেন রাসূল-নবী। (মারইয়াম-৫৪) (খ) আমরা তোমার নিকট সত্য নিয়ে এসেছি এবং আমরা অবশ্যই সত্যবাদী। (আল হিজর-৬৪) (গ) আমি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী, বিশ্বস্ত। (আল-আ’রাফ-৬৮) (ঘ) অবশ্যই তোমাদের সমীপে সুসংবাদদানকারী ও সতর্ককারী আগমন করেছেন। (আল-মায়িদাহ-১৯)। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।