পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম : ‘অর্থনৈতিক নদী’ হিসেবে খ্যাত হালদার নাজুকদশা নিয়ে বিশেষজ্ঞ, নীতি-নির্ধারকসহ বিভিন্ন মহলে আবারও আলোচনা-পর্যালোচনা, সমালোচনা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে হালদা নদীকে ঘিরে বিরাজমান সংকটজনক পরিস্থিতির জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের সীমাহীন অবহেলা ও নির্লিপ্ততাকে দায়ী করে তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও নদী গবেষকগণ। এমনকি হালদা নদী-বিনাশী অপতৎপরতা রোধে সার্ভেল্যান্স কাজের জন্য পাওয়া একমাত্র স্পিডবোটটিও অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কর্তাদের নৌ-ভ্রমণের কাজে অপব্যবহারের তীব্র সমালোচনা উঠেছে। সেমিনারে ক্রমাগত রুগ্ন ও বিপন্ন দশা থেকে ‘মাছের ব্যাংক’ হালদাকে অনতিবিলম্বে সুরক্ষায় একে জাতীয় নদী ঘোষণাসহ সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। দাবি উঠেছে জাতীয় অর্থনীতিতে যুগ যুগ ধরে অনন্য অবদানের জন্য হালদাকে ‘অর্থনৈতিক নদী’ ঘোষণার।
দেশের অপর যেকোন নদ-নদীর তুলনায় হালদার রয়েছে অনন্য বেশ কিছু প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। বিশ্বের তাবৎ নদী গবেষকদের কাছে ব্যতিক্রমী এ নদীটি চেনা-জানা। হালদা হচ্ছে এশিয়ার একমাত্র জোয়ার-ভাটা নির্ভর নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই, কাতলা, মৃগেল (কার্প) জাতীয় মিঠাপানির মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। মওসুমের প্রথম দু’তিন দফায় তুমুল বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের যুৎসই সময়েই রুই, কাতলা, মৃগেল জাতীয় মা মাছেরা দল বেঁধে হালদা নদীর বুকে ডুবভাসি করে ডিম ছাড়ে। সেই ডিম থেকে ফোটানো রেণু পোনা-বীজ জেলেদের হাতবদল হয়ে সমগ্র দেশে মাছচাষী ও খামারীদের কাছে পৌঁছে যায়। হালদার ডিম বা রেণু-পোনার মৃত্যুহার খুবই কম এবং তা দ্রুত বর্ধনশীল। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর প্রত্যক্ষ অবদান বার্ষিক অন্তত ৮শ’ কোটি টাকার। আর ফল-ফসল, কৃষি খামারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নদীটির অবদান কয়েক হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে অন্তত এক লাখ মানুষের। তবে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৯৪৫ সালে জেলেদের মাধ্যমে হালদা নদীর আহরিত ডিম থেকে ২৫শ’ কেজি রেণু পোনা উৎপাদিত হয়েছিল। বর্তমানে মিলছে বছরে মাত্র ৮/১০ কেজি রেণু।
উন্নয়ন, সম্পদ, অর্থনৈতিক অবদানসহ বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে হালদা নদী বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মিঠাপানির ‘জাতীয় মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র’ হিসেবে অনুপম ঐতিহ্যের দাবিদার। বিশেষজ্ঞরা হালদা নদীকে বলে থাকেন ‘মাছের ব্যাংক’। এই ‘ব্যাংকে’র মাছ দেশের জনগণের অপরিহার্য আমিষের সবচয়ে বড় যোগানদার। রুই কাতলা ছাড়াও ৫০টিরও বেশি প্রজাতির অর্থকরী মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। নদী বিশেষজ্ঞরা একে আল্লাহর অপার দান ও বিস্ময় হিসেবে দেখে থাকেন।
কিন্তু প্রধানত, মানুষের সৃষ্ট বিভিন্নমুখী অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের অনিবার্য পরিণতিতে হালদা নদী তার আপন বৈশিষ্ট্যগুলো হারাতে বসেছে। এতে করে মাছের ব্যাংক হালদা মরণদশায় রয়েছে। বিরামহীন ও মারাত্মক দূষণ, ভরাট, বেদখল, নদীর গতিপথে হরেক বাধা-বিপত্তির মধ্যদিয়ে হালদা নদী বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। তাছাড়া লবণাক্ততার বিস্তার এবং আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় বিপন্ন অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য বিচরণক্ষেত্রটি। এর নেতিবাচক প্রভাবে অকালে বা অসময়ে বিক্ষিপ্তভাবে ডিম ছাড়ছে মা মাছেরা। ডিম ছাড়ার হারও কমে আসছে। মাছের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিষিয়ে উঠেছে হালদার পরিবেশ। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-সমিতি, বিশেষজ্ঞম-লী, পরিবেশবাদী, আপামর চাটগাঁবাসীর উদ্যোগে হালদা প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রের সুরক্ষায় সভা- সেমিনার, কর্মশালা, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদি আয়োজন সত্ত্বেও হালদার ধ্বংসকরণ প্রক্রিয়া চলছেই।
বিশিষ্ট নদী গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া জানান, হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক ‘জিন ব্যাংক’। জাতীয় অর্থনীতিতে অশেষ গুরুত্ববহনকারী হালদা নদী বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বর্তমানে ব্যাপকাকারে দূষণের শিকার। এর মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার হরেক বর্জ্য, ট্যানারি বর্জ্য, উজানে তামাক চাষের বর্জ্য, কীটনাশকের ব্যবহার ইত্যাদি কারণে হালদা নদীটির ৯৮ কিলোমিটার গতিপথে মারাত্মক দূষণ ঘটছে। এতে করে হালদা নদীর মিঠা পানির প্রাকৃতিক প্রজনন তথা মাছের স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। নদীর গতিপথে রাবার ড্যাম ও বাঁক সৃষ্টি করায় নদীর প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধা পাচ্ছে। গতিপথে প্রায় ১৫ কিলোমিটার নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ‘হালদা নদী রক্ষা কমিটি’র সভাপতি ড. কিবরীয়া বলেন, সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং হালদা তীরবর্তী জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করেই হালদাকে অনতিবিলম্বে সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় হালদার বিপর্যয় রোধ হবে না।
হালদা নদী থেকে আহরিত নিষিক্ত ডিম হতে বিশেষ পদ্ধতিতে ফোটানো রুই, কাতলা, মৃগেল জাতীয় মিঠাপানির মাছের রেণুপোনা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় সরবরাহ হয়। এই রেণুপোনার মৃত্যুহার কম। এজন্য চাহিদাও বেশি। এ নদীর সাথে কৃষিজ উৎপাদনসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা- যোগ করলে একক নদী হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরী ও শহরতলীসহ নদীটির আশপাশ এলাকার প্রায় ৭০ লাখ অধিবাসীর জন্য সুপেয় পানির প্রধান উৎস হালদা। চট্টগ্রাম ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন ৪ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে নগরবাসীর জন্য পানির চাহিদা পূরণ করছে।
এদিকে রুই, কাতলা জাতীয় মা মাছ ধরা ‘কঠোরভাবে’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও রাউজান, হাটহাজারী উপজেলায় হালদা নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবৈধ মৎস্য শিকারীরা রাতের আঁধারে প্রতিনিয়ত জাল দিয়ে মা মাছ শিকার করছে। হালদা নদী থেকে অবৈধ ও বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলনের ফলে মা-মাছের নিরাপদ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। রাউজানের পশ্চিম নোয়াজিশপুর থেকে নগরীর মোহরা এলাকা পর্যন্ত ড্রেজার দিয়ে ও পাওয়ার পাম্প বসিয়ে নদীর দুই পাড়ে ডেলিভারি পাইপে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। হালদা জোয়ার-ভাটার নদী। সমুদ্র থেকে এর দূরত্ব ১০-১২ কিলোমিটার হওয়ায় জোয়ার-ভাটার প্রভাব রয়েছে এই নদীতে। লবণাক্ততা হালদার বর্তমান সময়ের প্রধান সমস্যা। লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হালদা ও এর শাখা নদীগুলোতে রাবার ড্যাম, বাঁধ ও সøুইস গেট নির্মাণ। বঙ্গোপসাগর মোহনা থেকে অনতিদূরে হওয়ায় হালদা নদীর উপর জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উজানে হালদার অবস্থান পাহাড়ি এলাকায়। সেখানে জুম চাষ, পাহাড়ের বৃক্ষ নিধন, জমি চাষ ইত্যাদি কারণে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পলি-বালি-মাটি পাহাড়ি ঢলের সাথে হালদার ভাটির দিকে নেমে আসে। কিন্তু হালদার দু’পাশের শাখা খাল ও ছড়াগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ তৈরি, রাবার ড্যাম এবং সøুইস গেট নির্মাণের কারণে উজানের পানির চাপ ও স্রোতের গতি কমে গেছে। ফলে উজান থেকে আসা পলি মাটি নদীতে তলানি হিসাবে জমা হয়ে প্রতিনিয়ত নদী ভরাট হচ্ছে। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের গভীরতা দিন দিন কমছে।
হালদা নদীতে বিভিন্নমুখী ব্যাপক দূষণের কারণে জীববৈচিত্র্যে বিচরণ কমে যাচ্ছে। মাছ ও অন্যান্য জলজ জীববৈচিত্র্যের খাদ্যের উৎস সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এককালে ৭৬ প্রজাতির মাছ হালদায় পাওয়া যেত। ইতোমধ্যে ১৫ প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হালদা অনেক ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীর আদর্শ আবাসস্থল ছিল। এরমধ্যে ছিল শুশুক, হুস্তুম (হুত্তুম) মাছ বা গাঙ্গেয় ডলফিন। শুশুক বা ডলফিন আইইউসিএন-এর রেড লিস্ট অনুযায়ী বিপন্ন তালিকার স্তন্যপায়ী প্রাণী। হালদার পরিবেশ বিপর্যয়, দূষণ এবং খাদ্যাভাবের ফলে হালদা থেকেও আশঙ্কাজনক ভাবে এদের সংখ্যা কমে গেছে।
নদীর স্বাভাবিক পানির স্বাভাবিক প্রবাহ হ্রাস পেলে দূষণ ও দখলের মাত্রাও বেড়ে যায়। হালদার উজানে ফটিকছড়ি, নারায়ণহাট ও নাজিরহাটের মত বেশ কিছু বড় বড় বাজার ও বাণিজ্যিক স্থান রয়েছে। প্রতিদিন এসব স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণ বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হয়। হালদা অববাহিকার জনবহুল এলাকার বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য, বাজারের বর্জ্য, পোল্ট্রি ফার্ম বর্জ্য ইত্যাদি হালদা নদীতে ফেলা হয়। এতে করে পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় মারাত্মক বিপর্যয়ের শিকার হালদা। একই সাথে চাষাবাদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর নির্মাণের মাধ্যমে হালদা নদী বেড় বা চওড়ায় ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। হালদা নদী রক্ষা কমিটি এ নদীকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা, বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী হিসেবে ‘জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য’ এবং ‘অর্থনৈতিক নদী’ হিসেবে সংরক্ষণের ঘোষণা, হালদার মা-মাছের সংখ্যা নিরূপণের জন্য শুমারি পরিচালনার সুপারিশ করেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।