Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইশা’আতে ইসলাম বা ইসলাম প্রচারের নিয়মনীতি

| প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম : আল্লাহ জাল্লা শানহু মানব জাতির জন্য যে দীন অর্থাৎ জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন সেটাই ইসলাম। ইসলাম কোনো আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ গতানুগতিক এবং অনর্থক ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ, প্রগতিশীল, সর্বকালীন শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে; ইন্নাদ্্ দীনা ইন্নাল্লাহিল ইসলাম-নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হচ্ছে ইসলাম। (সূরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯)। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিজনকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষা কর। (সূরা তাহ্্রীম : আয়াত ৬)। এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা জানবার জন্য হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : হে রাসূল, নিজেকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষা করার বিষয়টি তো বুঝলাম কিন্তু পরিবার-পরিজনকে কীভাবে বাঁচাব? তিনি বললেন : আল্লাহ যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন সেসব নিষিদ্ধ কাজ করতে তাদের নিষেধ করবে আর যা করতে আদেশ করেছেন তা করতে বলবে। আমরা জানি ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমাদানের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাতে, অধিকাংশের মতে, ২৭ রমাদান রাতে প্রিয়নবী (সা.) প্রথম ওহী লাভ করেন। সেই রাতেই তিনি গৃহে ফিরে এসে তাঁর সম্মানিতা স্ত্রী হযরত খাদিজা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হার কাছে এ সম্পর্কে বললে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঈমান আনলেন। এভাবে নিজের গৃহ থেকে ইশা’আতে ইসলাম বা ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হলো। তারপর ঈমান আনলেন হযরত ‘আলী করামাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং হযরত যায়দ ইবনে হারিছা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু। এ দুজনই ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের পরিবার-পরিজনের অন্তর্ভুক্ত। বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদি.)।
প্রথম ওহি নাজিলের প্রায় তিন বছর পর থেকে নিয়মিত ওহি নাজিল হতে থাকে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে। ওহি নাজিলের এই পর্যায়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করার নির্দেশ দিলেন। ইরশাদ হলো : (হে রাসূল), আপনি উঠুন এবং সতর্ক করুন, আর আপনার রব-এর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। (সূরা মুদ্্দাস্সির : আয়াত-২-৩); (হে রসূল), আপনার নিকটাত্মীয়গণকে সতর্ক করে দিন। (সূরা শু’আরা : আয়াত ২১৪)।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইশা’আতে ইসলামের জন্য আল্লাহ জাল্লা শানুহু যেসব নির্দেশনা নাজিল করেছেন সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ইশা’আতে ইসলাম বা ইসলাম প্রচার করা বলতে প্রধানত ইসলামের বাইরের লোকজনের মধ্যে প্রচার করাকে বোঝায় এবং ইসলামের ভিতরে থেকে যারা ইসলামের বিধিনিষেধ অমান্য করে, গোমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যারা পথভ্রষ্টতার আবরণে নিজেদের আচ্ছন্ন করে ফেলে তাদের সংশোধন করার মধ্যেও ইশা’আতে ইসলামের আবেদন অনুরণিত হয়। এক্ষেত্রে হিদায়াতের আবেদন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এসব কাজ যারা করবেন তাদের অবশ্যই ইসলাম সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান থাকা এবং সেই অনুযায়ী নিজের আমল-আখ্্লাখ গড়ে ওঠা মানুষ হতে হবে।
আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসের দিকে নজর দেই তাহলে দেখতে পাব, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারককে বিধর্মীদের ইসলামের দিকে আহ্বান করার জন্য পাঠিয়েছেন, তারা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত সাহাবি।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই-এই সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানুষকে দান করেছেন হিদায়াত, দান করেছেন সত্য পথে চলার দিশা। হযরত আদম ‘আলায়হিস্্ সালাম থেকে সর্বশেষ নবী সাইয়েদুল মুরসালীন নূরে মুজাস্্সাম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল আল্লাহ পাঠিয়েছেন তারা সবাই আল্লাহর দেয়া দীন তথা জীবন ব্যবস্থা ইসলাম প্রচার করেছেন। এই ইসলামের পূর্ণতা লাভ হয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। তিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, বিশ্বজগতের জন্য রহমত, তিনি সিরাজাম মুনীরা-প্রদীপ্ত চেরাগ। অন্যান্য নবী-রাসূলকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রেরণ করেছিলেন নির্দিষ্ট কোনো জনপদের পথহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য কিংবা কোনো নবীর নিজ কওমকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য। আর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করলেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য সমস্ত মানব জাতির জন্য। তাঁকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু নবুওয়ত ও রিসালত দান করেন মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলায়হিস সালামের সৃষ্টির বহু পূর্বে, কিন্তু এ নবুওয়তের ধারায় তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় সবার শেষে, তিনি খাতামুন নাবিয়্যিন-নবীগণের সমাপ্তি বা সর্বশেষ নবী।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে যে নীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তাঁকে প্রচ- বাধার মোকাবিলা করতে হয়। তাঁর পরিবার-পরিজন ও নিজ গোত্রের লোকজনসহ তাঁকে বয়কট পর্যন্ত করা হয়। তাঁকে নানারকম প্রলোভনও দেখানো হয়। কিন্তু তিনি বলেন, আমার এক হাতে চাঁদ আরেক হাতে সূর্যও যদি এনে দেয়া হয় তবু আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করা থেকে একটুও পিছপা হব না।
তিনি ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য তায়েফ গিয়েছেন। তায়েফের মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া তো দিলোই না বরং পাথর মেরে মেরে তাঁর জিস্ম মুবারক ক্ষতবিক্ষত করে দিল। তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করল। তাঁর জিসম মুবারক  থেকে খুন ঝরে তাঁর না’ল (জুতো) মুবারক ভরে তাঁর কদম মুবারক তাতে আটকে গেল। সে এক করুণ অবস্থা। তবু তিনি তায়েফবাসীর জন্য দু’আ করলেন এই বলে : আল্লাহ গো। আমার দুর্বলতা, আমার নিরুপায়তা এবং মানব দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হেয়তার জন্য আপনার মহান দরবারে এই ফরিয়াদ করছি : হে রহমানুর রহীম, সমস্ত দুর্বলের রব আপনি। আপনিই আমার রব। যদি আমার ওপর ক্রুদ্ধ না হয়ে থাকেন তাহলে আমি কারও পরওয়া করি না। আপনার শান্তি, আপনার আফিয়াত আমার আশ্রয়। আমি আপনার সেই নূরের কামনা করছি, যে নূর মুবারকে আসমান-জমিন রওশন হয়েছে, যে নূরের ছটায় অন্ধকার বিদূরিত হয় এবং যে নূরের ছটায় দুনিয়া ও আখিরাতের কর্ম সম্পাদন হয়। সেই নূর মুবারকের উসিলায় আপনি আপনার গজব নাজিল করবেন না। একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি সাধন করাই আমার কর্তব্য, যতক্ষণ না আপনি সন্তুষ্ট হন। লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিকা।
সেদিন তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে অত্যাচারে জর্জরিত অবস্থায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ধৈর্য ধারণ করে যারা তাঁকে আঘাত করল তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করে ইসলাম প্রচারের কী নীতিমালা হওয়া উচিত তার অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলেন। তিনি সেদিন ক্ষমার পথ বেছে নিলেন। তিনি তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলেন। তিনি বললেন : হয়তো আল্লাহতায়ালা তায়েফবাসীদের কারও বংশে এমন মানুষ পয়দা করবেন যারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করবে না।
ইসলামের দিকে মানুষকে কীভাবে আহ্বান করতে হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : তোমার রবের পথে আহবান কর হিকমতের সঙ্গে এবং সুন্দর সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আর ওদের সঙ্গে বাক্যালাপ করবে সদ্ভাবে। (সূরা নহল : আয়াত ১২৫)।
এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে তিনটি পন্থা অবলম্বন করবার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ জাল্লা শানুহু আর তা হচ্ছে : হিকমত বা কৌশল, সদুপদেশ ও সদ্ভাবে আলোচনা। এখানে উল্লেখ্য, আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্তদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ  হচ্ছেন আম্বিয়ায়ে কেরাম। তারপর তাদের উম্মতদের মধ্যে যারা সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহ। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : যাদেরকে মহান আল্লাহ নিয়ামতম-িত করেছেন তারা হচ্ছেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালেহগণ। (সূরা নিসা : আয়াত ৬৯)। এই সালিহীন বা সালেহ্দের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন সাহাবায়ে কেরাম, আওলিয়ায়ে কেরাম ও মুত্তাকী-দীনদারগণ। ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম প্রচার করে আসছেন ইসলাম বিশেষজ্ঞগণ। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের মধ্যে এমন এক গোষ্ঠী হোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১০৪)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন