Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাতৃভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করতে হবে -প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরিম-লে স্বীকৃত যে ভাষা, সেটাকেই পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষার স্বকীয়তাও রক্ষা করতে হবে।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আকতারী মমতাজ। মাতৃভাষা শিক্ষা নেওয়ার পর অন্য ভাষা শিখলেই প্রকৃত শিক্ষাটা হয় বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই এ বিষয়ে আমাদের সমাজকে আমি আরও একটু সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা, যেটা এত রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি, সেটা যেন ধারণ করতে পারি।
একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে প্রধানমন্ত্রী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে আহ্বান জানিয়ে বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি যে ইতিহাস, সেটা আমরা বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে আমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব আরও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর ১৬ জনকে একুশে পদক দেওয়া হয়। পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পদকপ্রাপ্তির সাইটেশন পাঠ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
ভাষা আন্দোলনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, সাঈদ হায়দার ও জসিম উদ্দিনকে এই পদক দেওয়া হয়। এই বিভাগে প্রয়াত সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার (মরণোত্তর) পুরস্কার গ্রহণ করেন তার জ্যেষ্ঠ সন্তান রোকেয়া বেগম। শিল্পকলায় অভিনেত্রী জাহানারা আহমেদ, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প-িত অমরেশ রায় চৌধুরী, সঙ্গীতে শিল্পী শাহীন সামাদ, নৃত্যে আমানুল হককে একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়। চিত্রকলায় শিল্পী প্রয়াত কাজী আনোয়ার হোসেনের (মরণোত্তর) পক্ষে সহধর্মিণী সুফিয়া আনোয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি মফিদুল হক আর সাংবাদিকতায় ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। গবেষণায় অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ ও মংছেন চীং মংছিনকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ভাষা এবং সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ এবং হাবিবুল্লাহ সিরাজীকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্বর্ণের তৈরি ৩৫ গ্রাম ওজনের পদক, দুই লাখ টাকা, সম্মাননাপত্র এবং একটি রেপ্লিকা পেয়েছেন।
অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তর এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
‘আমরা পারি’ এই আত্মবিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আসুন সকলে মিলে আমাদের মাতৃভূমিকে উন্নত সমৃদ্ধ করি, বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। কারো কাছে হাত পেতে নয়, আমাদের সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারি। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে নিয়ে যেতে হবে। আর তা সম্ভব যদি আমরা আর্থ-সামাজিক উন্নতি করতে পারি। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া মাতৃভাষাকে ধারণ করা এবং ভাষার মর্যাদাকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
মায়ের ভাষার মর্যাদার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মাতৃভাষার ওপর আর কী থাকতে পারে? আমাদের বাংলা ভাষার যে মাধুর্য, যে মর্যাদা তার প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে। এ সময় তিনি মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিমের বঙ্গবাণী কবিতার দুটি চরণ উদ্ধৃত করে বলেন, কবি বলেছেন, যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
আগে মাতৃভাষা শেখার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষা গ্রহণ ও কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন ভাষা শিখতে হয়। কিন্তু মাতৃভাষাকে ভুলে গেলে চলবে না। মাতৃভাষা শিখে তারপর অন্য ভাষাটা শিখলে কিন্তু প্রকৃত শিক্ষাটা হয়।
তিনি বলেন, আমাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের প্রয়োজনে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতবিনিময় করতে গেলে যে ভাষা, মানুষ পর্যায়ক্রমিকভাবে সে ভাষা গ্রহণ করে। কিন্তু অন্য ভাষা শেখার সঙ্গে আমাদের নিজের ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করতে হবে।
মায়ের ভাষা রক্ষায় রক্তাক্ত সংগ্রামের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, মায়ের ভাষায় কথা বলতে, মাকে মা বলার অধিকার আদায় করতে হয়েছে সংগ্রামের পথ বেয়ে। তিনি বলেন, বাঙালি জাতিকে জাতি হিসেবে ধ্বংস করতে ভাষার ওপর আঘাত হানা হয়। উর্দুকে ভাষা হিসেবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারির মর্যাদার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু দিবস নয়, ২১ আমাদের চেতনার উন্মেষ ঘটায়, আমাদের চেতনাবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে, যার পথ বেয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।
পদকপ্রাপ্তদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা বিরাট অবদান রেখেছেন। একুশে পদক পুরস্কার নয়, মর্যাদা। আপনারা যে অবদান রেখেছেন তার পুরস্কার হয় না। আপনাদের মর্যাদা দিচ্ছি যেন আগামী প্রজন্ম আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশকে ভালোবাসে, দেশের কল্যাণে কাজ করে। তিনি আরো বলেন, দেশে আজ অনেকেই আছেন যাদের আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি। তবে আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে মূল্যায়ন করার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমাদের ওপর বিরাট দায়িত্ব, সারাবিশ্বে যত মাতৃভাষা আছে তা সংরক্ষণ ও গবেষণার। ইতোমধ্যেই আমরা একটা মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠন করেছি। সেখানে বিভিন্ন মাতৃভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, গবেষণা করা হচ্ছে। সেটাও ইউনেস্কোর ক্যাটাগরি-২-তে উন্নীত হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা এবং ভাষা শহীদরা মর্যাদা পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত সাত বছরে সরকারের সাফল্য তুলে ধরে বলেন, গত সাত বছরে দেশকে একটি মর্যাদার আসনে এনে দিতে পেরেছি। দেশের মানুষের ভেতর মর্যাদাবোধ তৈরি হয়েছে, এটাই আমাদের বড় অর্জন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের মানুষের মধ্যে মর্যাদাবোধ ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, তাদের আত্মবিশ্বাসও ফিরে এসেছে। আমরা এখন মাথা উঁচু করে চলতে পারি। এ সবই একুশ আমাদের শিখিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ’৪৮-এর ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব থেকে শুরু করে ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত অবস্থায় জাতির পিতার বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ, ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, বরকত, রফিকদের মহান আত্মত্যাগ এবং তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেন। আমাদের সকল অর্জনই ত্যাগের মাধ্যমেই অর্জিত বলেও প্রধানমন্ত্রী এ সময় মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, ‘কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালামের মতো প্রবাসী বাঙালিদের প্রচেষ্টায় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।’
তিনি বলেন, ‘কানাডা প্রবাসী রফিক ও সালাম, আপনাদের মনে আছে ভাষা আন্দোলনেও রক্ত দিয়েছিল রফিক ও সালামরা। তারা একটা সংগঠনের মাধ্যমে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠালে (জাতিসংঘ) আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে নিয়মানুযায়ী সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আমরা প্রস্তাব পাঠাই। পরবর্তীকালে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসের ইউনেস্কো সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়।
একুশে পদকপ্রাপ্তদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আশা করি, আপনাদের মাধ্যমে দেশের মর্যাদা আরও বাড়বে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উজ্জীবিত হবে।
তিনি বলেন, দেশে আজ অনেকেই আছেন যাদের আমরা মূল্যায়ন করতে পারছি না। তাদের ও আপনাদের মূল্যায়ন এই পুরস্কারের মধ্য দিয়ে হয় না। তবে আমরা শুরু করেছি। আমরা চাই আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক পথে চলতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই পাঁচ কোটি লোককে নি¤œআয় থেকে নি¤œ-মধ্যম আয়ে তুলে আনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলতে চাই। আমরা নি¤œ-মধ্যম আয়ে থাকতে চাই না। ২০২১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চাই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের পরিবেশনায় জাতীয় সঙ্গীত এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত এবং আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশিত হলে সকলেই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাতৃভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করতে হবে -প্রধানমন্ত্রী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ